বরাবরের মতোই নানান অসঙ্গতি ও বিতর্ককে সঙ্গী করে আশার ভেলায় চেপে শুক্রবার শুরু হচ্ছে বিপিএলের দশম আসর।
Published : 18 Jan 2024, 10:34 PM
কুয়াশাভেজা সকালে অনুশীলনে ব্যস্ত সিলেট স্ট্রাইকার্স। তাদের অনুশীলনের মাঝপথেই হাজির দুর্দান্ত ঢাকার ক্রিকেটাররা। কিছুক্ষণ পর এলো চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সও। সিলেট মাঠ ছাড়ার আগ পর্যন্ত অবশ্য অপেক্ষা করল তারা। আবার তাদের অনুশীলন শেষ হওয়ার আগেই মাঠে উপস্থিত হলো খুলনা টাইগার্স!
মিরপুরে বিসিবি একাডেমি মাঠের বৃহস্পতিবারের চিত্র এটি। বিপিএলের প্রতি আসরেই সাধারণ ঘটনা বলা যায় একে। একইসঙ্গে কয়েকটি দলের অনুশীলন চলায় একরকম ঝঞ্ঝাট তৈরি হয় একাডেমি মাঠে। ব্যতিক্রম নয় এবারও।
মাঠ সমস্যাসহ টুর্নামেন্ট ঘিরে নানান অব্যবস্থাপনা, ঘাটতি, বিতর্ক সঙ্গী করেই শুক্রবার শুরু হচ্ছে বিপিএলের দশম আসর। উদ্বোধনী ম্যাচে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের প্রতিপক্ষ এবারের নবাগত দল ঢাকা।
অনুশীলনের সমস্যা সমাধানে গত আসরে সাকিব-মাসকো ক্রিকেট একাডেমিতে অনুশীলন করেছে কুমিল্লা ও ফরচুন বরিশাল। এবার বিকেএসপিকে বেছে নিয়েছে খুলনা। আর পুবেরগাঁও ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠ ভাড়া নিয়েছে সিলেট, চট্টগ্রাম ও বরিশাল। ঢাকা অনুশীলন করেছে একাডেমি মাঠেই আর রংপুর রাইডার্স প্রস্তুতি সেরেছে বসুন্ধরা স্পোর্টস কমপ্লেক্সে।
তবু টুর্নামেন্ট শুরুর আগের দিন বলেই হয়তো একাডেমি মাঠে জমে যায় চার দলের ভিড়। একসঙ্গে এত ক্রিকেটারের অনুশীলন চলতে থাকায় বিক্ষিপ্তভাবে এদিক-ওদিক থেকে উড়ে আসতে থাকে বল। শঙ্কা জাগে হুট করে যে কারও গায়ে বল লাগা নিয়েও। বিপিএলের প্রতি আসরেই অবশ্য দেখা যায় এসব।
এই সব নিয়মিত চিত্রের বাইরে এবার নতুন করে বেশ জোর দিয়েই যুক্ত হয়েছে ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে বিপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজিদের রাজস্ব ভাগের বিষয়টি। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রাজস্বের ভাগ না পেলে আগামী বছর দল নেবে না তারা।
অন্যান্য যে কোনো সমস্যা বা ঘাটতি প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময় অজুহাত হিসেবে দেশের বাস্তবতা, আর্থ-সামাজিক অবস্থার কথা বলা হয় বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের পক্ষ থেকে। সেসব মাথায় রেখে দেশীয় ঘরানায় বিপিএল চালিয়ে নেওয়ার কথা প্রায়ই বলেন তারা।
ব্যতিক্রম হয়নি এবারও। বিসিবি কার্যালয়ের সামনে বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে এবার রাজস্ব ভাগাভাগির প্রসঙ্গেও সেই পুরোনো কথাই যেন নতুন করে বললেন বিপিএলের গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য সচিব ইসমাইল হায়দার মল্লিক।
“রাজস্ব ভাগের মডেলে আমরা প্রথম দুটি বিপিএল করেছি। তখন কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। আমরা যখন শুরু করেছিলাম তখন শুধু আইপিএল ছিল। এখন আরও লিগ হয়। এর বেশিরভাগই আবার ভারতীয় ফ্র্যাঞ্চাইজিরা চালায়। সেক্ষেত্রে টিকে থাকার মতো একটা টুর্নামেন্ট আনতে গেলে কিন্তু আমাদের আর্থ সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় রাখতে হয়। এটা আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।”
“(আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজিরা) অনেকবারই আমাদের প্রস্তাব করেছে। তবে বোর্ডের সিদ্ধান্ত এরকম যে, আমাদের টুর্নামেন্ট আমাদের দেশীয় ঘরানায়ই চালাতে চাই। আমরা এরকম কিছু করতে চাই না যে, টুর্নামেন্টের রাইটস আমাদের হাতে থাকবে না। অন্য কারও কাছে চলে যাবে।”
পরের আসর নিয়ে শঙ্কার জায়গা তৈরি হলেও এবার ইতিবাচক দিকও থাকছে বেশ কিছু। দীর্ঘ দিন ধরে অসন্তোষের পর এবারের আসরে বাড়তে পারে টিভি সম্প্রচারের মান। এরই মধ্যে আনা হয়েছে উন্নতমানের ক্যামেরা। দেখা যেতে পারে স্পাইডার ক্যাম, ড্রোন ক্যামসহ উন্নতমানের সব প্রযুক্তি।
গত কয়েক আসরে টুর্নামেন্টের শুরু থেকে পাওয়া যায়নি পূর্ণাঙ্গ ডিআরএস৷ এবার কুমিল্লা-ঢাকার প্রথম ম্যাচ থেকেই থাকছে এই প্রযুক্তি। একইসঙ্গে আইসিসির প্লেয়িং কন্ডিশনের নতুন সংযোজন ওভার টাইমার (প্রতি ওভার পর নতুন ওভার শুরুর জন্য ১ মিনিট সময়), স্টাম্পিংয়ের ক্ষেত্রে টিভি আম্পায়ারের ক্যাচ আউট না দেখার মতো সিদ্ধান্তগুলোও কার্যকর থাকবে বিপিএলে৷
অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের ব্যস্ততার মাঝেও এবার বিপিএলে থাকবে টি-টোয়েন্টির বিশ্ব তারকাদের উপস্থিতি৷ পুরো আসরের জন্য না হলেও কয়েক ম্যাচের জন্য কুমিল্লার হয়ে খেলতে আসার কথা রয়েছে সুনিল নারাইন, আন্দ্রে রাসেল, রাশিদ খান, মোহাম্মদ রিজওয়ানদের৷ এছাড়া রংপুর রাইডার্সে বাবর আজম, নিকোলাস পুরান, ফরচুন বরিশালে শোয়েব মালিক, ডেভিড মিলার, খুলনা টাইগার্সে এভিন লুইস, চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সে দেখা যেতে পারে ফিল সল্টকে।
এবার নেতৃত্বেও আছে কিছুটা চমক। তিনবারের চ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক ইমরুল কায়েসকে এবার এই দায়িত্ব দেয়নি কুমিল্লা। তার বদলে বিপিএলে প্রথমবার নেতৃত্ব দেবেন লিটন দাস। তার মতোই বিপিএল অধিনায়কত্বের অভিষেকের অপেক্ষায় খুলনার এনামুল হক।
চার আসর পর আবার এই ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে নিজ দলকে (বরিশাল) নেতৃত্ব দেবেন তামিম। চাপ এড়াতে দায়িত্ব নেননি সাকিব আল হাসান। রংপুরের দায়িত্বে তাই নুরুল হাসান সোহানই থাকছেন। চোটের কারণে অনিশ্চয়তা থাকলেও শেষ পর্যন্ত মাশরাফি বিন মুর্তজাকেই অধিনায়ক ঘোষণা করেছে সিলেট। ঢাকা অধিনায়ক হিসেবে বেছে নিয়েছে মোসাদ্দেক হোসেনকে।
বিপিএলে এবার প্রথমবারের মতো প্রতিটি দলেই প্রধান কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন দেশিরা। কুমিল্লায় মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, সিলেটে রাজিন সালেহ, রংপুরে সোহেল ইসলাম থাকছেন আগের মতোই। দল বদলে দুর্দান্ত ঢাকার দায়িত্ব নিয়েছেন খালেদ মাহমুদ, সহকারী থেকে বরিশালের প্রধান কোচের গুরুভার পেয়েছেন মিজানুর রহমান। আর প্রধান কোচ হিসেবে বিপিএল অভিষেকের অপেক্ষায় তালহা জুবায়ের (খুলনা) ও তুষার ইমরান (চট্টগ্রাম)৷
ধারাভাষ্যের মান নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে বিপিএল। টুর্নামেন্টের উইকেট নিয়েও কম কথা হয়নি। গত ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের নিদারুণ ব্যর্থতার পর ফের ঘরোয়া টুর্নামেন্টগুলোর উইকেট উঠে আসে আলোচনার কেন্দ্রে। আগামী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চোখ রেখে ক্রিকেটাররাও এবার বিপিএলে চেয়েছেন ভালো উইকেট। প্রত্যাশা কতটা পূরণ হবে সেটা সময়ই বলে দেবে।
নানান অসঙ্গতি এক পাশে রেখে এসব পরিবর্তনের আশার ভেলায় চড়েই ভালো টুর্নামেন্টের আশায় আয়োজকরা। আর তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন মাঠে জমজমাট লড়াই। তা কতটা উপহার দিতে পারবেন সেটিই এখন দেখার।
উদ্বোধনী দিন দুপুর আড়াইটায় শুরু হবে প্রথম ম্যাচ। পরে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় মাঠে গড়াবে সিলেট-চট্টগ্রাম ম্যাচ। শুক্রবারে খেলা শুরু হবে দুপুর ২টা ও সন্ধ্যা ৭টায়। সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে ম্যাচ শুরুর সময় দুপুর দেড়টা ও সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা।
শুরু থেকে থাকছেন দুই জন বিদেশি আম্পায়ার- ইংল্যান্ডের ডেভিড মিলনস ও পাকিস্তানের আসিফ ইয়াকুব। পরে আসতে পারেন আরও। নেই কোনো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান।
৪৬ ম্যাচের টুর্নামেন্টের ফাইনাল হবে আগামী ১ মার্চ। খেলা হবে তিনটি ভেন্যু ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে। মাঠে বসে বিপিএলের ম্যাচ দেখতে টিকেটের জন্য সর্বনিম্ন ২০০ টাকা থেকে শুরু করে গুনতে হবে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫০০ টাকা।