বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ
প্রতিপক্ষের বিশাল সংগ্রহের পর বাংলাদেশের ব্যাটিং ব্যর্থতা, চিরায়ত গল্পের পুনর্মঞ্চায়নই যেন দেখা যাচ্ছে চট্টগ্রাম টেস্টে।
Published : 30 Oct 2024, 08:31 PM
‘মুশফিক ভাই, বোলিং করেন’- সীমানার কাছে ফিল্ডিংয়ে আসা মুশফিকুর রহিমকে বললেন পূর্ব গ্যালারিতে একাই বসে থাকা দর্শক। ভিয়ান মুল্ডার, সেনুরান মুথুসামির জুটিতে তখন তরতরিয়ে বাড়ছে দক্ষিণ আফ্রিকার রান। মূল বোলারদের কেউই তাতে বাধ দিতে পারছেন না দেখে মাহমুদুল হাসান জয়ের হাতেও বল দেন নাজমুল হোসেন শান্ত। সমুদ্রে ডুবন্ত কেউ যেমন খড়কুটো ধরেও বাঁচতে চায়, ঠিক তেমনভাবেই ওই দর্শক যেন মুশফিককে বোলিংয়ে দেখতে চাইলেন। যিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৪৬৬ ম্যাচের কোনোটিতেই একবারের জন্যও হাত ঘুরাননি!
জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামে বুধবার দুপুরের এই ঘটনা যে চিত্র সামনে আনে সেটার পরিষ্কার ছাপ আছে পরিসংখ্যানে। বাংলাদেশের মূল দুই স্পিনার তাইজুল ইসলাম ও মেহেদী হাসান মিরাজ রান দিয়েছেন দুইশর কাছাকাছি করে। দুই জন মিলিয়ে ৯১.২ ওভার বোলিং করে কেবল ৭ ওভার মেডেন নিতে পেরেছেন! ৩৬৯ রান দিয়ে নিয়েছেন ৫ উইকেট।
৫ সেশনের বেশি সময় বোলিং করেও ৬টির বেশি উইকেট নিতে পারেনি বাংলাদেশ। তৈরি করতে পারেনি খুব বেশি সুযোগ। দুয়েকটা ব্যতিক্রম ছাড়া একদম নির্বিঘ্নেই এগিয়ে গেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানরা। চারজন ব্যাটসম্যান ছাড়িয়ে গেছেন নিজের আগের সেরা, তাদের তিনজন পেয়েছেন ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। যিনি পাননি তিনি অপরাজিত ছিলেন ৭০ রানে। আটে নেমে ওয়ানডে ঘরানার ব্যাটিংয়ে যেভাবে এগোচ্ছিলেন মুথুসামি তাতে ইনিংস ঘোষণা না করলে তিনিও তিন অঙ্কের উষ্ণ ছোঁয়া পেতেই পারতেন।
৬ উইকেটে ৫৭৫ রানে দক্ষিণ আফ্রিকা ইনিংস ঘোষণার পর শেষ বেলায় সেই ব্যাটিং স্বর্গে দেখা গেল বাংলাদেশের টপ অর্ডারের ভোগান্তি। এতে অবশ্য বিস্ময়ের সুযোগ খুব একটা নেই। কারণ টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের নিয়মিত চিত্রই এটি। দেশে কিংবা বাইরে, যে উইকেটে প্রতিপক্ষ গড়ে রানের সৌধ, সেখানেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ। এই সমস্যার সমাধানে আরও ধৈর্য ধরার কথা বললেন দলের স্পিন কোচ মুশতাক আহমেদ।
যে পিচে ৬ উইকেট নিতে বাংলাদেশের লাগল প্রায় ১৪৫ ওভার সেখানেই স্বাগতিকরা ৪ উইকেট হারাল স্রেফ ৯ ওভারে!
দিনের শেষ ঘণ্টায় রান পাহাড়ের জবাব দিতে নেমে ব্যাটিং ধসে এখন আগে ফলোঅন এড়ানোর পথ খুঁজতে হচ্ছে বাংলাদেশের। দক্ষিণ আফ্রিকাকে আবার ব্যাটিং করাতে শেষ ৬ উইকেটে তাদের করতে হবে আরও ৩৩৮ রান। সফরকারীদের সংগ্রহ তো বটেই এই রানও দৃষ্টি সীমানার অনেক বাইরে।
উইকেটের আচরণ বদলায়নি একটুও। তাই উইকেট-কন্ডিশন নিয়ে খুব বেশি ভাবতে হবে না তাদের। কিন্তু নিজেদের চিরায়ত অবস্থা বদলানোর চ্যালেঞ্জটাই বড় ব্যাটসম্যানদের জন্য।
পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করে আসার পর ভারতে গিয়ে হতাশ করে বাংলাদেশ। চেন্নাইয়ে স্বাগতিকদের ৩৭৬ রানের জবাবে তারা অলআউট হয় মাত্র ১৪৯ রানে। পরে দ্বিতীয় ইনিংসে স্বাগতিকরা ২৮৭ রানে ছেড়ে দেওয়ার পর ২৩৪ রানে থামে বাংলাদেশ।
কানপুর টেস্টেও অভিন্ন চিত্র। ইয়াশাসভি জয়সওয়াল, ভিরাট কোহলি, লোকেশ রাহুলরা যে উইকেটে তুলাধুনা করেন বাংলাদেশের বোলারদের, সেই উইকেটেই একের পর এক অসহায় আত্মসমর্পন করেন জাকির হাসান, শান্ত, মুমিনুল, মুশফিকরা।
দেশে ফিরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম টেস্টে টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে মাত্র ১০৬ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। তাদের পরে খেলতে নেমে সেই বোলিং সহায়ক উইকেটেই ৩০৮ রান করে প্রোটিয়ারা। বিরুদ্ধ কন্ডিশনে ব্যাটিংয়ের দারুণ প্রদর্শনী করেন কাইল ভেরেইনা, মুল্ডাররা।
এই তিন টেস্ট শুধু নয়, টেস্টে পথচলার শুরু থেকেই বাংলাদেশের ব্যাটিং-বোলিংয়ে দেখা যায় এমন চিত্র। ঘরের মাঠে চলতি বছরের শুরুতে শ্রীলঙ্কা কিংবা ২০২২ সালে ভারত সিরিজসহ নিয়মিতই প্রতিপক্ষের বড় স্কোরে চাপা পড়ে অল্পে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ।
চট্টগ্রাম টেস্টেও জেগেছে একই শঙ্কা। পাঁচ সেশনের বেশি সময় ফিল্ডিং করে নিজেদের ইনিংসে প্রথম ওভারেই ড্রেসিং রুমে ফিরে গেছেন সাদমান ইসলাম। পরে দ্রুতই তার সঙ্গী হয়েছেন জাকির, মাহমুদুল হাসান জয় ও নাইটওয়াচম্যান হাসান মাহমুদ।
দেশের ক্রিকেটে মজার ছলে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে নামলেই উইকেট বদলে যায়।’ এই কথার বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। তবে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স বারবার এই কথা যেন মনে করায়।
দলের আরেকটি হতাশাময় দিনের শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে এই প্রসঙ্গে পরিস্থিতি বুঝে মৌলিক জায়গাগুলো ঠিক রাখার কথা বললেন মুশতাক।
“ক্রিকেট একটা আজব খেলা, বুঝলেন! ওয়ানডে বা টেস্ট, যাই হোক, এখানে মৌলিক জায়গা ঠিক রাখতে হবে। আপনাকে পরিস্থিতি ও কন্ডিশন বুঝে মূল বিষয়গুলো ঠিক রেখে খেলতে হবে। এই খেলাটা মূলত বিশ্বাসের। আমি মনে করি, দলের তরুণ ক্রিকেটাররা শিখছে।”
মিরপুর টেস্টে বাংলাদেশের অবশ্যম্ভাবী পরাজয়ের আগে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বেশ জোর দিয়ে বিশ্বাসের মন্ত্র জানান স্পিন কোচ। আরেকবার কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে বিশ্বাসেই জোর দিলেন তিনি।
“ভুলে গেলে চলবে না, পাকিস্তানে তারা অনেক ভালো খেলেছে। ২৬ রানে ৬ উইকেট পড়ার পরও ম্যাচ জিতেছে। বারবার এটা বলায় আমি দুঃখিত। কিন্তু এটাই প্রমাণ, যা আমরা কোচরা দেখিয়ে বলি- তোমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারো। বিশ্বাস রেখে স্কিলে উন্নতি করতে হবে।”
মাঠের বাইরে কোচিং প্যানেল বারবার বিশ্বাসের বার্তা দিলেও, মাঠে এর প্রতিফলন ঘটাতে প্রায়ই ব্যর্থ ক্রিকেটাররা। তাহলে কি ক্রিকেটারদের নিজেদের মধ্যেই আছে বিশ্বাসের অভাব? মুশতাক সেটি মানতে রাজি নন।
তবে ক্রিকেটারদের ঘাটতির জায়গাগুলো দেখিয়ে দেন পাকিস্তানের সাবেক লেগ স্পিনার।
“আমার মনে হয় না, তাদের আত্মবিশ্বাস কম। সত্যিকার অর্থে যদি বলি, প্রক্রিয়া অনুসরণের ঘাটতি আছে। প্রক্রিয়া হলো, পরিস্থিতি বুঝতে পারা। গেম অ্যাওয়ারনেসের কথাও বলব। কখন বল ছাড়তে হবে, কখন একটু দেখে খেলতে হবে, এই পাঁচ ওভার সাবধান থাকতে হবে- এগুলো। তাদের আত্মবিশ্বাসের কমতি দেখি না। পরিস্থিতি বুঝতে হবে। যত দ্রুত বুঝবে, তারা তত দ্রুত শিখবে।”
যেখানে ভুগলেন সাদমান, জাকিররা সেখানেই সাত ঘণ্টার বেশি সময় ব্যাটিং করে ২৬৯ বলে ১৭৭ রানের চমৎকার ইনিংস খেলেন টনি ডি জর্জি। ১২ চার ও ৪ ছক্কার ইনিংস খেলার পথে বেশ কয়েকবার পানিশূন্যতায় ভোগেন বাঁহাতি ওপেনার, বারবার টান লাগে পেশিতে। তবু নিজের উইকেট বিলিয়ে দেননি জর্জি।
শেষ পর্যন্ত ক্যারিয়ার সেরা দেড়শ পেরিয়ে যাওয়ার পর তাকে ফেরান তাইজুল। দিনের খেলা শেষে জর্জি বলেন, মানসিক শক্তির জোরেই এতটা পথ এগোতে পেরেছেন তিনি।
“আমি বলব, (বড় ইনিংস খেলার পথে) মানসিক শক্তিই বড়। কারণ ব্যাটিংয়ে নামার পর পুরো বিষয়টা হলো সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া ও নিজের পরিকল্পনায় অটল থাকা। নির্দিষ্ট বোলারের বিপক্ষে উইকেটে কোন জিনিসটা কাজ করছে, তা বুঝতে পারা এবং এর বাইরে না যাওয়া। এই সংস্করণে এর বেশি কিছু প্রয়োজন নেই।”
বাংলাদেশে প্রথমবার খেলতে এসে মাত্র দ্বিতীয় টেস্টেই ব্যাটিংয়ের এপ্রোচ কী হবে, তা বুঝে গেছেন জর্জি। কিন্তু বাংলাদেশের এই শেখার প্রক্রিয়াই যেন শেষ হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম টেস্টের টপ-অর্ডারের তিন ব্যাটসম্যানের প্রত্যেকের আছে প্রথম শ্রেণিতে ত্রিশের বেশি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা। টেস্ট ক্রিকেটেও প্রায় দুই বছরের অভিজ্ঞতা আছে তিন জনেরই। এছাড়া অনুশীলনেও নিয়মিত ঘাম ঝরাচ্ছেন সবাই। তবু মিলছে না প্রত্যাশিত ফল।
এই প্রসঙ্গে আরও ধৈর্য ধরার কথা বলেন মুশতাক।
“একদিনে একটি গাছ বড় করতে পারবেন? পানি দিতে হবে, বিশ্বাস রাখতে হবে যে গাছটি বড় হবে। একজন মালি হিসেবে আমরা এটাই করতে পারি। কোচ হিসেবে আমরাও এটি করি। একদিনে গাছ বড় করতে পারবেন না। একদিন না একদিন, দ্রুত হোক অথবা দেরিতে, তারা ছায়াও দেবে, ফলও দেবে।”