বিশ্বকাপের পথে মূল মন্ত্র ‘বাংলাদেশি ব্র্যান্ড’

নিয়মিত অধিনায়ক হিসেবে পথচলা শুরুর আগেই বোধহয় রেকর্ড একটা করে ফেলেছেন তামিম ইকবাল। অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর প্রথম টস করার জন্য এতটা অপেক্ষা আর কাকে করতে হয়েছে! তার ১০ মাস ১২ দিনের অপেক্ষার অবসান অবশেষে হতে যাচ্ছে। ফুরোচ্ছে আন্তর্জাতিক ম্যাচের জন্য দেশের ক্রিকেটের সুদীর্ঘ প্রতীক্ষাও। ২০২৩ বিশ্বকাপে চোখ রেখে নতুন করে শুরু হচ্ছে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের যাত্রা, যে অভিযানের মূল মন্ত্র ‘বাংলাদেশি ব্র্যান্ড’ গড়ে তোলা।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Jan 2021, 04:18 PM
Updated : 19 Jan 2021, 05:20 PM
পরিকল্পনা

প্রত্যেকটা দেশের ক্রিকেটের নিজস্ব একটা ধরণ আছে। আমি মনে করি না, আমাদের অন্য কাউকে অনুসরণ করার দরকার আছে। হয়তো আমরা ক্যারিবিয়ানদের মতো শক্তিশালী নই, অস্ট্রেলিয়ানদের মতো সুগঠিত নই। তবে আমাদের দলে এমন অ্যাডভান্টেজ আছে, যেটা অন্য দলে নেই।

গত ৬ মার্চ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ওয়ানডে দিয়ে নেতৃত্বকে বিদায় জানান মাশরাফি বিন মুর্তজা। ৮ মার্চ অধিনায়ক করা হয় তামিমকে। কে ভাবতে পেরেছিল, ওই বছর আর মাঠেই নামতে পারবে না বাংলাদেশ দল! কোভিডের অস্থির সময় পেছনে ফেলে ব্যক্তিগত অনুশীলনে ফেরার শুরু এবং এরপর নানা ধাপ পেরিয়ে, প্রেসিডেন্ট’স কাপ, বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি হয়ে এবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরছে দেশে। তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে বুধবার বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

ঘরোয়া টুর্নামেন্টগুলোর মতো যথারীতি এই সিরিজেও গ্যালারিতে থাকছে না দর্শক। কেবল আমন্ত্রিত অতিথি থাকবেন কিছু। দর্শকবিহীন মাঠে বাংলাদেশের খেলার অভিজ্ঞতাও হতে যাচ্ছে প্রথমবার।

মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে দিন-রাতের ম্যাচ শুরুর সময়টা একটু অদ্ভূত, বেলা সাড়ে ১১টা! ম্যাচে রাতের শিশির ও কুয়াশার প্রভাব কমাতে আর ব্রডকাস্টারদের চাওয়া পূরণ করতেই মূলত এই উদ্যোগ।

ম্যাচ শুরুর সময়টা যেমন নতুন, বাংলাদেশ ক্রিকেটেও এখন শোনা যাচ্ছে নতুন দিনের গান। যদিও মাশরাফি ছাড়া পুরনো সৈনিকদের প্রায় সবাই আছেন, জৈব-সুরক্ষা বলয়ের জন্য স্কোয়াডের আকার বিশাল হওয়ায় নবীন কয়েকজনেরও জায়গা হয়েছে দলে। তবে নতুন মুখের কারণে শুধু নয়, নতুন পরিকল্পনা আর নতুনভাবে এগিয়ে চলার ভাবনাতেও মিশে আছে নতুন দিনের শুরু। সিরিজ শুরুর আগের দিন ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে নতুন অধিনায়ক তামিম যেটিকে বললেন বাংলাদেশি ব্র্যান্ড।

“আমি সবসময় যেটাকে গুরুত্ব দিই, সেটা হচ্ছে বাংলাদেশি স্টাইল অব ক্রিকেট, বাংলাদেশি ব্র্যান্ড অব ক্রিকেট। প্রত্যেকটা দেশের ক্রিকেটের নিজস্ব একটা ধরণ আছে। আমি মনে করি না, আমাদের অন্য কাউকে অনুসরণ করার দরকার আছে। হয়তো আমরা ক্যারিবিয়ানদের মতো শক্তিশালী নই, অস্ট্রেলিয়ানদের মতো সুগঠিত নই। তবে আমাদের দলে এমন অ্যাডভান্টেজ আছে, যেটা অন্য দলে নেই।

“আমি যেটা তৈরি করতে চাই, সেটা হলো বাংলাদেশি ব্র্যান্ড অব ক্রিকেট খেলব আমরা। অন্য কাউকে অনুসরণ না করে আমরা এতে মনোযোগ দিতে চাই। আমাদের যে শক্তির জায়গা, তার উপরই আমাদের ব্র্যান্ড হবে। আমরা সেই ধরনের ক্রিকেট খেলব।”

‘বাংলাদেশি ব্র্যান্ড’ কথাটি অবশ্য নতুন নয়। ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কায় নিদাহাস ট্রফির সময়ও জোরেসোরে উচ্চারিত হয়েছে এটি। টি-টোয়েন্টিতে ‘পাওয়ার’ ক্রিকেটের ঘাটতি, ‘ইম্প্যাক্ট’ ক্রিকেটারের অভাব পূরণ করতে বাংলাদেশ বেছে নিয়েছিল নিজেদের শক্তির জায়গায় আস্থা রেখেই ‘স্মার্ট’ ক্রিকেট খেলার পথ। সেবার যথেষ্ট সফলও হয়েছিল দল। কিন্তু পরে আর ‘ব্র্যান্ড’ গড়ে তোলা যায়নি, ধরে রাখা যায়নি। মিলিয়ে যায় তা সময়ের সঙ্গে।

ওয়ানডেতেও ‘বাংলাদেশি ব্র্যান্ড’ গড়ে তোলার তাড়না হয়তো সেই একই প্রেক্ষাপট থেকেই। ওয়ানডে ক্রিকেট এখন যে উচ্চতায় উঠে গেছে, পাওয়ার ক্রিকেট এই সংস্করণেও যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, বাংলাদেশকে তাল মেলাতে হলে কোনো পথ তো বের করতেই হবে! কেমন হবে সেই ব্র্যান্ড, কতদিন তা টিকবে, সময়ই দেবে উত্তর।

এই ব্র্যান্ড বা নতুন শুরু, সবই ২০২৩ বিশ্বকাপে দৃষ্টি রেখে। তবে আগের বিশ্বকাপগুলোর সঙ্গে এবার পার্থক্য হচ্ছে, শুধু দল গোছানোয় মন দিলেই চলবে না, ধারাবাহিকভাবে জিততেও হবে। এই সিরিজসহ বেশির ভাগ সিরিজই আইসিসি ওয়ানডে সুপার লিগের অংশ! স্বাগতিক ভারত ও ওয়ানডে লিগের অন্য শীর্ষ ৭ দল সরাসরি খেলবে বিশ্বকাপে। অন্য দুটি দলকে খেলে আসতে হবে বাছাইপর্ব।

তামিম সরাসরিই জানিয়ে দিলেন, বাছাইপর্বের ঝামেলায় যাওয়ার কোনো ইচ্ছে তাদের নেই।

“এখন থেকে ২০২৩ বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত খুব বেশি হলে ২৭-২৮টা ওয়ানডে খেলব আমরা। তাই পয়েন্টের জন্য আমাদের জন্য প্রতিটি ম্যাচ জেতা এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ্। যেন বাছাইপর্ব খেলতে না হয় সেটা নিশ্চিত করতে চাইব আমরা।”

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জয়টা এমনিতে প্রত্যাশিতই। ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে সবশেষ ৫ ওয়ানডেই জিতেছে বাংলাদেশ, সবশেষ ১০ ম্যাচে জয় ৮টি। এর মধ্যে দেশের মাটিতে সিরিজ জয় যেমন আছে, ক্যারিবিয়ানে সিরিজ জয়ও আছে। এবার জয় আরও বেশি কাম্য প্রতিপক্ষের শক্তি বিবেচনায়।

কোভিডের শঙ্কা ও ব্যক্তিগত কারণ মিলিয়ে শীর্ষ ১২-১৩ জন ক্রিকেটারকে ছাড়া বাংলাদেশে এসেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথম ওয়ানডেতে অন্তত ৬-৭ জন খেলবেন অভিষেক ম্যাচ। নেতৃত্ব দেবেন যিনি, সেই জেসন মোহাম্মেদ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলবেন আড়াই বছর পর। মূল দল থাকলে হয়তো সফরেই আসতে পারতেন না তিনি।

তবে কঠিন এই চ্যালেঞ্জের জন্য টাটকা প্রেরণার উৎস ক্যারিবিয়ানরা পেয়েই গেছে। একগাদা শীর্ষ ক্রিকেটারকে ছাড়াই অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে যেভাবে সিরিজ জিতে ফিরল ভারত, সেটি দেখেই উজ্জীবিত জেসন।

“অবশ্যই আমাদের অনেকে প্রথমবার খেলতে নামবে। তবে নিজের ভেতর ও দলের মধ্যে যদি বিশ্বাস থাকে যে জিততে পারি, তাহলে অবশ্যই আমরা অনেক কিছু অর্জন করতে পারি। ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্টেও সেটি দেখা গেছে। আমাদেরও একই মানসিকতা আছে যে কালকে ভালো ক্রিকেট খেলব। আশা করি, ফলও আমাদের পক্ষে আসবে।”

অনেক আলোচনার ম্যাচের আলোচিত অধ্যায় আছে আরেকটি। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে এই ম্যাচ দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরছেন সাকিব আল হাসান। ২০১৯ বিশ্বকাপের পর প্রথম ওয়ানডে খেলবেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন।

সাকিবের নতুন অধ্যায় আর দলের নতুন ভাবনা মিলিয়ে বড় একটি পরিবর্তন হতে যাচ্ছে সাকিবের ব্যাটিং পজিশনে। তিন নম্বরে দারুণ সাফল্য পেলেও আপাতত সাকিব ব্যাট করবেন চারে, তিনে খেলানো হবে নাজমুল হোসেন শান্তকে। ছয়-সাতে একজন আগ্রাসী ব্যাটসম্যানের ঘাটতি পূরণে নতুন ভূমিকায় দেখা যাবে সৌম্য সরকারকেও।

এই সব কিছুতেই ফুটে উঠছে ‘ব্র্যান্ড’ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা। অপেক্ষা এবার মাঠের ক্রিকেটে সেটির প্রতিফলনের।