মনের সিংহই খেয়েছে বাংলাদেশকে

ওয়ানডেতে ইংলিশরা এখন সত্যিকার অর্থেই সিংহ। ওভালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রথম ম্যাচেই যেমন বাংলাদেশের বোলিংকে আয়েশ করে চেটেপুটে খেল ইংলিশ সিংহরা। তবে ম্যাচ শেষে বোঝা গেল, বনের সিংহ নয়, বাংলাদেশকে আগেই খেয়ে ফেলেছিল মনের সিংহ!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিলন্ডন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 June 2017, 03:44 AM
Updated : 2 June 2017, 09:36 AM

মনের সিংহের আবির্ভাব বাংলাদেশ দলের টিম মিটিংয়ে। যেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, বোলার একজন কম নিয়ে ৮ ব্যাটসম্যান খেলানোর! ভয় থেকেই একজন বাড়তি ব্যাটসম্যানের সিদ্ধান্ত, যেটির বলি মেহেদী হাসান মিরাজ। চার বোলার নিয়ে খেলে দল পেলো না দিশা।

একদিন আগে এই মাঠেই ভারতের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে দলের অন্যতম সেরা পারফরমার ছিলেন মিরাজ। ভারতের বড় রানেও মিরাজ বল হাতে ছিলেন বেশ কিপটে। পরে ব্যাট হাতে দলের মহাবিপর্যয়ে করেছেন লড়াই। ইংলিশদের মিডল অর্ডারে তিন বাঁহাতি ওয়েন মর্গ্যান, বেন স্টোকস, মইন আলি। অফ স্পিনার মিরাজের খেলাটা তাই নিশ্চিত বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল।

তবে ওই যে ভয়! ভারতের বিপক্ষে যে ম্যাচে দারুণভাবে লড়লেন মিরাজ, সেই ম্যাচই সম্ভবত ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল চন্দিকা হাথুরুসিংহের মনে। ওই ম্যাচের ব্যাটিং বিপর্যয় দেখেই হয়ত ভড়কে গিয়েছিলেন কোচ। টিম ম্যানেজমেন্টের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, মূলত কোচের চাওয়াতেই ৮ ব্যাটসম্যানের একাদশ।

এমনিতে মাঠে যে একাদশ নামছে, সেটি সবার দল বলেই ধরে নেওয়ার রীতি। হেড কোচ, কোচিং স্টাফের অন্যরা, অধিনায়ক, সহ-অধিনায়ক, ম্যানেজার, দলের সঙ্গে থাকা নির্বাচক, ক্ষেত্র বিশেষে সিনিয়র ক্রিকেটার, সবার ভাবনা ও যুক্তি-তর্ক থাকবে। আলোচনা শেষে যেটি ঠিক হবে, যে একাদশ মাঠে নামবে, ধরে নিতে হবে সেটি সবারই দল। তবে বাস্তবতা হলো, হাথুরুসিংহের চাওয়ার বিরোধিতা করা বা তার সঙ্গে একমত না হওয়ার উপায় এখন বাংলাদেশ দলে খুব একটা নেই।

ম্যাচ শেষে মাশরাফি বিন মুর্তজার সংবাদ সম্মেলনে ৮ ব্যাটসম্যানের প্রসঙ্গ উঠেছে বারবার। অধিনায়কের সব ব্যাখ্যার সার-সংক্ষেপ, ওপরের ব্যাটসম্যানরা যেন নির্ভার হয়ে খেলতে পারে, সেই ভাবনাতেই এত বেশি ব্যাটসম্যান। আর শুরুতে ধস নামলে পরে খুব দারুণ ব্যাটিং করলেও ২৭০-২৮০ রান হবে। এই রানে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পেরে ওঠা যাবে না। তাই যত পারো, ঠেসে দাও ব্যাটসম্যান।

সাম্প্রতিক সময় দারুণ ব্যাট করতে থাকা বাংলাদেশ দলে কোচের এই ধস নামার ভয় পাওয়ার কারণ ভারত ম্যাচ। কিন্তু ৭ ব্যাটসম্যান নিয়ে ধস সামলানো না গেলে অষ্টম ব্যাটসম্যান কিভাবে রানের পাহাড় গড়বেন, সেটা যেমন বোধগম্য নয়, তেমনি ব্যাটিং স্বর্গে ৭ ব্যাটসম্যান দলকে ৩৩০ এনে দিতে না পারলে অষ্টম ব্যাটসম্যান কিভাবে পারবেন, সেটা বোঝাও মুশকিল!

মিরাজ থাকলেই বাংলাদেশ ম্যাচ জিতে যেত, সেটির নিশ্চয়তা অবশ্যই নেই। বরং ৫-৬ জন বিশেষজ্ঞ বোলার নিয়েও ওভালে ৩০৫ রানের পুঁজিতে ইংল্যান্ডকে আটকানো কঠিন। এই মাঠেই গত জুনে ঠিক ৩০৫ রান করেছিল শ্রীলঙ্কা। ইংল্যান্ড জিতে গিয়েছিল ৪০ ওভারেই। তার আগের জুনে এখানে নিউ জিল্যান্ডের ৩৯৮ রান তাড়া করেও প্রায় জিতে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। শেষ পর্যন্ত হেরেছে মাত্র ১৩ রানে।

বোলার বেশি থাকলেও থাকলেও তাই ইংল্যান্ড জিততে পারত। মিরাজ তো মুত্তিয়া মুরালিধরন বা সাকলায়েন মুশতাক নন যে একাই ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেবেন। আসলে মিরাজ এখানে মানসিকতার নিয়ামক মাত্র। তার জায়গায় তাসকিন, সানজামুল বা হতে পারতেন যে কোনো বোলারই। মূল ব্যপারটি হলো, ব্যাটিং বিপর্যয়ের ভয় থেকেই বাংলাদেশ ৮ ব্যাটসম্যান নিয়ে খেলেছে। ভয়ডরহীন এই ইংল্যান্ডকে যেখানে তাদের চেয়েও বেশি সাহসী ক্রিকেট খেলে চমকে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল, উল্টো বাংলাদেশ মাঠেই নেমেছে ভয় নিয়ে, রক্ষণাত্মক ভাবনায়।

এক সময় বাংলাদেশ দলের মানসিকতা অবশ্য এরকমই ছিল। ভাবনাই ছিল পশ্চাৎপদ। প্রতিপক্ষের ভুলের আশায় ম্যাচের পর ম্যাচ কেটে যেত। তবে সেসব দিন বাংলাদেশের ক্রিকেটে অতীত বলেই মনে হচ্ছিলো। মাশরাফির অনুপ্রেরণাদায়ী ও আগ্রাসী নেতৃত্ব তো ছিলই, মানসিকতার বদলে বড় কৃতিত্ব হাথুরুসিংহেরও। সেই কোচকেই কিনা এই ম্যাচের আগে কাবু করে ফেলল মনের সিংহ। হাঁটলেন রক্ষণাত্মক পথে।

টিম কম্বিনেশন নিয়ে নানা প্রসঙ্গ ও প্রশ্নে মাশরাফি বরাবরই বলে আসছেন, অধিনায়ক হিসেবে সবসময়ই অন্তত ৫ জন বিশেষজ্ঞ বোলার নিয়ে খেলতে পছন্দ করেন। ঢাকা লিগ বা বিপিএল, যেখানে তার মতামতই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মাশরাফি প্রায় সবসময়ই অন্তত ৫ বোলার নিয়েই খেলেন। অথচ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এদিন তিনি মাঝের ওভারগুলোতে উইকেট এনে দেওয়ার বোলার খুঁজে বেড়ালেন।

সাব্বির বোলিং পেয়ে ব্রেক থ্রু এনে দিয়েছিলেন দলকে। মোসাদ্দেক-সৌম্যকে বোলিং করিয়েছেন অধিনায়ক। হয়ত করাতে পারতেন মাহমুদউল্লাহকে। কিন্তু তারা কেউই তো উইকেট শিকারি নন, পার্ট টাইমার। ম্যাচ জেতাতে হতো মূল বোলারদেরই। কিন্তু তাদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বোলিংয়ে এনেও লাভ হয়নি। উইকেট নেওয়ার মত আর কেউ ছিলও না অধিনায়কের হাতে।

৮ ব্যাটসম্যানের সিদ্ধান্ত কোচের বলে হারের সব দায় অবশ্যই তার নয়। ক্রিকেটে কোনো সিদ্ধান্ত কাজে লাগবে, কোনোটি লাগবে না। প্রতি ম্যাচেই সেরকম কিছু কিছু হয়। নির্বাচক, কোচ, অধিনায়ক, সবার সিদ্ধান্ত কিংবা পছন্দ কখনো কাজে লাগে, কখনো নয়। এটিই ক্রিকেটের নিয়ম। তবে সিদ্ধান্তের পেছনের কারণটি গুরুত্বপূর্ণ। এই ম্যাচে ৮ ব্যাটসম্যান খেলানোর কারণ যেমন ছিল ধসের ভয়। হঠাৎ এই মানসিকতার প্রত্যাবর্তনই শঙ্কাজনক।

স্রেফ ইংলিশ সিংহের শিকার হলে সমস্যা এমনিতে খুব ছিল না। কিন্তু মনের সিংহের ভয়, মেনে নেওয়ার মত নয়!