ক্যাচ ফসকায়, ম্যাচ ফসকায়

তাসকিন আহমেদের একটি ব্যাপার দারুণ। মাঠের ভেতরে-বাইরে প্রায় সময়ই মুখ হাসি হাসি। এমনকি তার বলে ক্যাচ হাতছাড়া হলেও হাসেন। সেই হাসি নিয়মিতই দেখা যায়। কারণ তার বলে নিয়ম করে ক্যাচ মিস হয়। নিজের দুঃখেও তাসকিন হাসতে পারেন, কিন্তু দল তো হাসে না। এত ক্যাচ হাতছাড়া করা দল হাসতে পারে না!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিক্রাইস্টচার্চ থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Jan 2017, 05:41 AM
Updated : 23 Jan 2017, 02:56 PM

‘ক্যাচ মিস তো ম্যাচ মিস’, ক্রিকেটের বহু পুরোনো কথা। খুব ‘ক্লিশে’ এই কথাও নতুন করে বারবার মনে করিয়ে দেওয়ার ‘মহান’ ব্রত নিয়ে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ দল। যত ক্যাচ হাতে জমে, তার চেয়ে বেশি ফসকায়।

আরও অনেক সম্ভাবনা জাগানো ক্যাচের অপমৃত্যু হয় ‘ক্যাচ’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার আগেই। কারণ বাংলাদেশের ফিল্ডাররা চেষ্টাই করে না! চেষ্টা না করার একটা মজার ব্যাপার আছে, ওসব আর ক্যাচ ফসকানোর তালিকায় থাকে না। দিন বা ম্যাচ শেষে ক্যাচ হাতছাড়া করার তালিকটাটা তাই আরও দীর্ঘ হয় না।

তার পরও তালিকা যত লম্বা থাকে, অন্য যে কোনো দলের জন্য তা ‘ঈর্ষণীয়’। চলতি ক্রাইস্টচার্চ টেস্টের প্রথম ইনিংসে সহজে নেওয়ার ক্যাচই বাংলাদেশে ছেড়েছে ৬টি। ‘প্রায়’ সুযোগ বা সুযোগ বানানো যেত, সে রকমগুলো হিসাব করলে সংখ্যাটা হবে গোটা দশেক।

এই পর্যন্ত গোটা সফরে ১৭টি ক্যাচ নিতে পারেনি বাংলাদেশ, যেগুলো নেওয়া যেত অনায়াসেই। ‘প্রায়’ সুযোগগুলো বিবেচনায় নিলে সংখ্যাটি যথারীতি দ্বিগুণও হয়ে যেতে পারে।

ক্যাচের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ধারাবাহিক স্লিপে। সহজ হোক বা কঠিন, বেশি সহজ বা বেশি কঠিন, বাংলাদেশের স্লিপ কর্ডনে বা আশে পাশে যত ক্যাচ যায়, সব ঘাসের ছোঁয়া পায়। মাঝেমধ্যে যখন ফিল্ডাররা দু-একটি ধরে ফেলে, সেটিই বড় খবর।

এই একটি জায়গায় দলের সবার অদ্ভুত মিল। ইমরুল কায়েস হোক বা সৌম্য সরকার, মাহমুদউল্লাহ হোক বা দলের সেরা ফিল্ডার সাব্বির রহমান - স্লিপে ক্যাচ ছাড়ার ক্ষেত্রে ‘কেউ কারে নাহি ছাড়ে, সমানে সমান’।

সহজাত স্লিপ ফিল্ডার বাংলাদেশ কখনোই পায়নি। সেটি পাওয়া একটু কঠিনও। এই ছেলেরা বেড়ে ওঠে ন্যাড়া মাঠে, ইট-খোয়াযুক্ত মাঠে। যেখানে ডাইভ দেওয়া মানে চোটকে স্বাগত জানানো। আরেকটু বড় হয়ে যখন ক্লাব ক্রিকেট, এমনকি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলা শুরু, তখন মাঠ ভালো হলেও স্লিপ নিষ্ফলা। মন্থর উইকেটে বল স্লিপ পর্যন্ত আসেই না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুরুর কয়েক ওভারের পর থেকেই চলে স্পিন। তাই আকাশ থেকে টুপ করে না পড়লে বা মাটি ফুঁড়ে কেউ না উঠলে, এই দেশের ক্রিকেটীয় সিস্টেম ভালো স্লিপ ফিল্ডারের জন্ম দিতে পারে না।

তবে এই বাস্তবতার পাশেই জাগে আরেকটি প্রশ্ন, হাতে চলে আসা সাধারণ ক্যাচগুলি নিতে তো ভালো স্লিপ ফিল্ডার হওয়ার প্রয়োজন নেই! অথচ সাব্বিরের মত ফিল্ডার পর্যন্ত সহজতম ক্যাচ ছাড়েন স্লিপে। কারণ হতে পারে দুটি। প্রথমত, স্নায়ুর চাপ; ক্যাচ মিস করার ভয়ে মিস করা। দ্বিতীয়ত, মানসিকতা। স্লিপ ফিল্ডিংকে আপন করে না নেওয়া।

সহজাত স্লিপ ফিল্ডার যেহেতু কেউ নেই, একজন ইমরুল বা মাহমুদউল্লাহকে দাঁড় করাতে হয় ধরে-বেঁধে। সেই ফিল্ডারও বলির পাঠা হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে স্লিপে দাঁড়ান। দারুণ কিছু করা বা শেখার তাগিদ ভেতরে থাকে না।

ভালো ফিল্ডার হওয়ার প্রথম শর্ত ফিল্ডিং উপভোগ করা। স্লিপ ফিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে সেটি আরও বেশি সত্যি। কিন্তু বাংলাদেশ দলে স্লিপ ক্যাচিং অনেকটা শাস্তির মত। স্লিপে দাঁড়ানো মানে যন্ত্রণা। মুখ ভোঁতা করে স্লিপের দায়িত্বে নিতে যান সবাই। দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় দলে খেলা ক্রিকেটারদেরও তাই স্লিপ ক্যাচিংয়ে বিন্দুমাত্র উন্নতির চিহ্ন চোখে পড়ে না। আত্মসমর্পণের মানসিকতায় তো আর স্লিপ ক্যাচিংয়ের শৌর্যবীর্য হয় না!

কাড়ি কাড়ি ডলার খরচ করে রাখা বিদেশি ফিল্ডিং কোচের কাজের প্রতিফলনও তাই পড়ে না মাঠে। ইংল্যান্ডের মত দলের কোচ ছিলেন রিচার্ড হ্যালসল। ফিল্ডিং কোচ হিসেবে দারুণ সুনাম ছিল। বাংলাদেশে আসার পরও তার কাজ, পরিশ্রম ও মানসিকতায় বিসিবি ও টিম ম্যানেজমেন্ট খুশিই ছিল বলে জানা যায়। ফিল্ডিং কোচ থেকে সহকারী কোচ হিসবে পদোন্নতি পেয়েছেন সেই কারণেই। কিন্তু একটা পর্যায়ে দায় তো নিতে হবে তাকেও।  বাংলাদেশের ছেলেদের ফিল্ডিংয়ের এই অবস্থা নতুন কিছু নয়। একটু উন্নতিও না করাতে পারলে আর তিনি ভালো ফিল্ডিং কোচ কেন?

একটি ক্যাচ হাতছাড়া মানে শুধু একজন ব্যাটসম্যানকে জীবন দেওয়াই নয়, নিজেদের জীবনও কেড়ে নেওয়া। শুষে যায় জীবনীশক্তি, কেড়ে নেয় প্রাণচাঞ্চল্য, বাজে প্রভাব পড়ে শরীরী ভাষায়। বোলারও একসময় হতাশ হয়ে পড়ে, বোলিং হয় এলোমেলো। এই সব স্রোত গিয়ে মেশে পরাজয়ের মোহনায়।

সবচেয়ে আশঙ্কার ব্যাপার, এই চিত্র বদলের আশাও কম। বয়সভিত্তিক বা ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো ফিল্ডার বেশ কজনই আছেন। কিন্তু ভালো স্লিপ ফিল্ডার নেই একজনও! এমনকি দলের তরুণতম দুই সৈনিক মেহেদী হাসান মিরাজ ও নাজমুল হোসেন শান্তও সামিল হয়ে গেছেন পূর্বসূরিদের পতাকাতলে। স্লিপ, গালিতে ক্যাচ ছাড়ার হাতেখড়ি হয়ে গেছে দুজনেরই। তাই খুব ঝুঁকি না নিয়েই বলা যায়, এই অবস্থা চলছে, এমনই চলবে।

অতি ইতিবাচক মানসিকতার লোকেরা অবশ্য বলতে পারেন, চলতি সফরে নিউ জিল্যান্ডও অনেক ক্যাচ ছেড়েছে। খুবই সত্যি। তবে এটাও সত্যি, নিউ জিল্যান্ড বরাবরই বিশ্বের অন্যতম সেরা ফিল্ডিং দল। একটি দুটি ম্যাচ বা সিরিজ বাজে যায়। বাংলাদেশের একটি-দুটি সিরিজ ভালো হয়!

তাছাড়া ক্যাচ ছাড়লেও এই কন্ডিশনে ঠিকই ফিরে আসার উপায় বের করে কিউইরা। সেই শক্তি-অস্ত্র তাদের আছে। বাংলাদেশ সুযোগ সৃষ্টিই বা করতে পারে কতটি? হাতছাড়া করা মানে তাই নিজেদের পায়েই কুড়াল মারা।

বাংলাদেশ ক্যাচ ছাড়ে, বাংলাদেশ ম্যাচ হারে।