অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনে পাকিস্তানকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা

ভানুকা রাজাপাকসার দুর্দান্ত ইনিংস, প্রমোদ মাদুশানের চমৎকার বোলিং আর ভানিন্দু হাসারাঙ্গার অলরাউন্ড নৈপুণ্যে এশিয়া কাপ জিতল লঙ্কানরা।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Sept 2022, 05:56 PM
Updated : 11 Sept 2022, 05:56 PM

চামিকা করুনারত্নের দারুণ ইয়র্কার এলোমেলো করে দিল হারিস রউফের স্টাম্প। বোলার মেলে দিলেন ডানা। ডাগআউটে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড়রা ছুটে গেলেন মাঠের মাঝে। কেউ কেউ তুলে নিলেন স্টাম্প। মেতে উঠলেন তারা বাঁধনহারা উল্লাসে। এশিয়া কাপের শিরোপা জয় বলে কথা!

অথচ শ্রীলঙ্কার ইনিংসের অর্ধেক পেরোনোর আগে কে ভেবেছিল এমন কিছু? পাকিস্তানের পেসারদের আগুনে বোলিংয়ে এক পর্যায়ে ৫৮ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল দলটি। সেখান থেকে কী অসাধারণভাবেই না ঘুরে দাঁড়াল তারা। বিধ্বংসী এক ইনিংসে দলকে লড়াইয়ের পুঁজি এনে দিলেন ভানুকা রাজাপাকসা। পরে অসাধারণ বোলিং আর উজ্জীবিত ফিল্ডিংয়ে পাকিস্তানকে গুঁড়িয়ে দিল লঙ্কানরা।

দুবাইয়ে রোববারের ফাইনালে পাকিস্তানকে ২৩ রানে হারিয়ে ষষ্ঠবারের মতো এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের ট্রফি জিতল শ্রীলঙ্কা। রেকর্ড সাতবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতের সঙ্গে কমাল ব্যবধান।

নড়বড়ে অবস্থান থেকে ১৭০ রানের পুঁজি গড়ে শ্রীলঙ্কা। প্রথম ১০ ওভারে ৫ উইকেটে ৬৭ থেকে পরের ১০ ওভারে স্রেফ ১ উইকেট হারিয়ে তারা তোলে ১০৩ রান।

জবাবে মোহাম্মদ রিজওয়ানের মন্থর ফিফটির পর পাকিস্তান শেষ বলে অল আউট হয় ১৪৭ রানে।

৪৫ বলে ৬ চার ও ৩ ছক্কায় অপরাজিত ৭১ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচের সেরা রাজপাকসা। ২১ বলে ৩৬ রানের ঝড়ো ইনিংসের পর বল হাতে ৩ উইকেট নেন ভানিন্দু হাসারাঙ্গা। ক্যারিয়ার সেরা বোলিংয়ে ৩৪ রানে ৪ উইকেট নিয়ে বড় অবদান রাখেন প্রমোদ মাদুশান।

এশিয়া কাপে পাকিস্তানের তৃতীয় শিরোপার অপেক্ষা আরও বাড়ল। এই নিয়ে পাঁচবার ফাইনালে খেলে তিনবারই তারা হারল শ্রীলঙ্কার কাছে। সবশেষ তারা শিরোপা জিতেছিল ২০১২ সালের আসরে, ৫০ ওভারের সংস্করণে বাংলাদেশকে ২ রানে হারিয়ে।

শ্রীলঙ্কা এবারের আসর শুরু করেছিল আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১০৫ রানে অল আউট হয়ে বড় হার দিয়ে। এরপর টানা চার ম্যাচে তারা রান তাড়ায় হারায় বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, ভারত ও পাকিস্তানকে। বাবর আজমের দলকে আবার হারিয়ে শিরোপা জিতল দাসুন শানাকার দল।

টি-টোয়েন্টিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে এই নিয়ে টানা পাঁচ ম্যাচ জিতল শ্রীলঙ্কা। চলতি বছর এই সংস্করণে প্রথমবার তারা আগে ব্যাট করে জিতল; প্রথমে ব্যাটিং করে আগের সাত ম্যাচের সবগুলো তারা হেরেছিল।

আসরে শ্রীলঙ্কা তাদের আগের চার ম্যাচেই বোলিং নিয়েছিল টস জিতে। ফাইনালে টস জিতে অনুমিতভাবে বোলিং নেন পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর। শ্রীলঙ্কা অধিনায়ক শানাকা জানান, টস জিতলে তিনিও বোলিং নিতেন।

সুপার ফোরে পাকিস্তানকে ৫ উইকেটে হারানো ম্যাচের একাদশ নিয়েই খেলতে নামে শ্রীলঙ্কা। ওই ম্যাচে বিশ্রাম দেওয়া শাদাব খান ও নাসিম শাহকে ফেরায় পাকিস্তান।

আসরে দ্বিতীয়বার আগে ব্যাটিংয়ে নেমে ইনিংসের তৃতীয় বলেই উইকেট হারায় শ্রীলঙ্কা। নাসিমের দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে বোল্ড হয়ে ফেরেন কুসল মেন্ডিস। ১৪২ কিলোমিটার গতির বল অফ স্টাম্পের বাইরে পড়ে ভেতরে ঢুকে এলোমেলো করে দেয় স্টাম্প। গোল্ডেন ডাক এর তেতো স্বাদ পান ডানহাতি ব্যাটসম্যান।

আসরে দুটি ফিফটি করলেও ৬ ইনিংসের মধ্যে তিনবারই প্রথম ওভারে আউট হলেন মেন্ডিস।

আগের ম্যাচে অপরাজিত ফিফটি করা ওপেনার পাথুম নিসানকাও বেশিক্ষণ টেকেননি (১১ বলে ৮)। চতুর্থ ওভারে হারিস রউফের বল আকাশে তুলে দেন তিনি। মিড অফ থেকে কিছুটা পেছনে দৌড়ে ক্যাচ নেন বাবর।

তিন নম্বরে নামা ধনঞ্জয়া ডি সিলভা কয়েকটি চোখ ধাঁধানো শটে চার মারেন। তবে দানুসকা গুনাথিলাকা টিকতে পারেন স্রেফ ৪ বল। নিজের পরের ওভারে ১৫১ কিলোমিটার গতির ডেলিভারিতে তার স্টাম্প এলোমেলো করে দেন রউফ।

প্রথম ৬ ওভারে শ্রীলঙ্কার রান ছিল ৩ উইকেটে ৪২।

পাওয়ার প্লে শেষ হতে দুই প্রান্তে স্পিনারদের হাতে বল তুলে দেন বাবর। সাফল্যও ধরা দেয় দ্রুত। ‘পার্ট টাইম’ অফ স্পিনার ইফতিখার আহমেদের বলে আলগা শট খেলে বোলারকে ফিরতি ক্যাচ দেন সেট ব্যাটসম্যান ধনঞ্জয়া। ২১ বলে ৪টি চারে ২৮ রান করেন তিনি।

শাদাব খান নিজের দ্বিতীয় ওভারে ফিরিয়ে দেন শানাকাকে। লেগ স্পিনারকে স্লগ সুইপ করার চেষ্টায় বলের লাইন মিস করে বোল্ড হন লঙ্কান অধিনায়ক।

নবম ওভারে তখন ৫৮ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বিপদে শ্রীলঙ্কা।

এরপরই শুরু রাজাপাকসার পাল্টা আক্রমণ। শুরুটা হাসারাঙ্গাকে সঙ্গী করে। দুই জন দারুণ কিছু শট খেলে এগিয়ে নেন দলকে। ত্রয়োদশ ওভারে ম্যাচের প্রথম ছক্কা আসে হাসারাঙ্গার ব্যাটে। ৩৩ বলে স্পর্শ করে তাদের জুটির পঞ্চাশ।

রউফকে টানা দুই চার মেরে হাসারাঙ্গা কট বিহাইন্ড হয়ে যান পরের বলে। ২১ বলে ৫ চার ও ১ ছক্কায় তিনি করেন ৩৬ রান। জুটিতে ৫৮ রান আসে ৩৬ বলে।

রাজাপাকসা এরপর আরেকটি পঞ্চাশোর্ধ জুটি গড়েন করুনারত্নের সঙ্গে।

দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে খরুচে ছিলেন নাসিম। ১৭তম ওভারে তার শেষ তিন বলের মধ্যে একটি করে ছক্কা মারেন রাজাপাকসা ও করুনারত্নে।

বিপজ্জনক হয়ে ওঠা রাজাপাকসাকে ফেরানোর সুযোগ আসে পরের ওভারে। রউফের বলে লং অনে ক্যাচ ফেলেন শাদাব। ৪৬ রানে জীবন পেয়ে ৩৫ বলে ফিফটি পূর্ণ করেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান।

পঞ্চাশ ছোঁয়ার পর শেষের আগের ওভারে তিনি জীবন পান আরেক দফা। ডিপ মিডউইকেট বাউন্ডারিতে ক্যাচ নিতে দৌড়ে যান দুই ফিল্ডার। আসিফ আলির সঙ্গে সংঘর্ষে আঘাত পান শাদাব। আউটের বদলে বল ফিল্ডারের হাতে পড়ে হয়ে যায় ছক্কা!

ইনিংসের শেষ দুই বলে নাসিমকে চার-ছক্কায় স্কোর ১৭০-এ নিয়ে যান রাজাপাকসা। সপ্তম উইকেট জুটিতে ৫৪ রান আসে ৩১ বলে।

২৯ রানে ৩ উইকেট নিয়ে পাকিস্তানের সফলতম বোলার রউফ।

বোলিংয়ে শ্রীলঙ্কার শুরুটা হয় ভূতুড়ে। কোনো ‘বৈধ’ বল করার আগেই দিলশান মাদুশাঙ্কা দিয়ে ফেলেন ৯ রান! এই পেসার প্রথমেই করে বসেন ‘নো’ বল। এরপর টানা চারটি ওয়াইড। যার একটিতে বাই থেকে আসে ৪।

১১ বলের ঘটনাবহুল ওভার থেকে আসে ১২ রান।

আগের ম্যাচে টি-টোয়েন্টি অভিষিক্ত মাদুশান এ দিন চতুর্থ ওভারে বল পেয়েই কাঁপিয়ে দেন পাকিস্তানকে। ২৮ বছর বয়সী ডানহাতি পেসার পরপর দুই বলে বিদায় করে দেন বাবর ও ফখর জামানকে। লেগ স্টাম্পের বাইরের বলে শর্ট ফাইন লেগে ক্যাচ দেন বাবর। ফখর হন বোল্ড।

আসর জুড়ে নিজের ছায়া হয়ে থাকা বাবর ৬ ইনিংসে স্রেফ ১১.১৩ গড়ে করলেন ৬৮ রান।

পাকিস্তানের বিপদ আরও বাড়ত পারত। পরের ওভারে মাদুশাঙ্কার বল ইফতিখারের ব্যাট ছুঁয়ে গিয়েছিল। আবেদন করেনি শ্রীলঙ্কার কেউ, নেয়নি রিভিউও।

তখন ১ রানে খেলছিলেন ইফতিখার। তিনি ও মোহাম্মদ রিজওয়ান এরপর এগিয়ে নেন দলকে। যদিও আস্কিং রান রেট বাড়তে থাকে পাকিস্তানের। শেষ ১০ ওভারে তাদের দরকার ছিল ১০৩ রান।

দ্বিতীয় স্পেলে ফিরেই জমে যাওয়া ৭১ রানের জুটি ভাঙেন মাদুশান। ছক্কার চেষ্টায় ডিপ স্কয়ার লেগে ধরা পড়েন ইফতিখার (৩১ বলে ৩২)।

তেমন কিছু করে দেখাতে পারেননি মোহাম্মদ নওয়াজ। ৬ রান করে তিনি বাউন্ডারিতে ক্যাচ দেন করুনারত্নের বলে।

মন্থর ব্যাটিংয়ে এক প্রান্তে উইকেট আঁকড়ে থাকা রিজওয়ান ৪৭ বলে ফিফটি পূর্ণ করেন করুনারত্নেকে ছক্কায় উড়িয়ে।

শেষ ৪ ওভারে পাকিস্তানের দরকার ছিল ৬১ রান। ১৭তম ওভারে আক্রমণে ফিরে রিজওয়ান, আসিফ ও খুশদিল শাহকে ফিরিয়ে পাকিস্তানের আশা প্রায় শেষ করে দেন হাসারাঙ্গা। রিজওয়ান ৫৫ রান করতে বল খেলেন ৪৯টি।

আগের ম্যাচেও ৩ উইকেট নিয়েছিলেন হাসারাঙ্গা। পাকিস্তানের বিপক্ষে পাঁচ টি-টোয়েন্টিতে এই লেগ স্পিনিং অলরাউন্ডারের উইকেট হলো ১৪টি।

এরপর শুধু পরাজয়ের ব্যবধান কমাতে পারে পাকিস্তান। শেষ বলে রউফকে বোল্ড করে জয় নিশ্চিত করেন করুনারত্নে।

এবারের আসর হওয়ার কথা ছিল শ্রীলঙ্কায়। তবে দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আর্থিক সঙ্কটের জন‍্য টুর্নামেন্ট সরিয়ে নেওয়া হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতে। সেখান থেকে ট্রফি যাচ্ছে শ্রীলঙ্কাতেই।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

শ্রীলঙ্কা: ২০ ওভারে ১৭০/৬ (নিসানকা ৮, মেন্ডিস ০, ধনঞ্জয়া ২৮, গুনাথিলাকা ১, রাজাপাকসা ৭১*, শানাকা ২, হাসারাঙ্গা ৩৬, করুনারত্নে ১৪*; নাসিম ৪-০-৪০-১, হাসনাইন ৪-০-৪১-০, রউফ ৪-০-২৯-৩, শাদাব ৪-০-২৮-১, ইফতিখার ৩-০-২১-১, নওয়াজ ১-০-৩-০)

পাকিস্তান: ২০ ওভারে ১৪৭ (রিজওয়ান ৫৫, বাবর ৫, ফখর ০, ইফতিখার ৩২, নওয়াজ ৬, খুশদিল ২, আসিফ ০, শাদাব ৮, রউফ ১৩, নাসিম ৪, হাসনাইন ৮*; মাদুশাঙ্কা ৩-০-২৪-০, থিকশানা ৪-০-২৫-১, মাদুশান ৪-০-৩৪-৪, হাসারাঙ্গা ৪-০-২৭-৩, করুনারত্নে ৪-০-৩৩-২, ধনঞ্জয়া ১-০-৪-০)

ফল: শ্রীলঙ্কা ২৩ রানে জয়ী

ম্যান অব দা ম্যাচ: ভানুকা রাজাপাকসা

ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট: ভানিন্দু হাসারাঙ্গা