Published : 30 Apr 2025, 06:33 PM
রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরিময় দিনের শেষভাগে হঠাৎই টান টান উত্তেজনা। নাহ, ম্যাচের ফল নিয়ে সংশয় ছিল না। তবে এ দিনই ম্যাচের ফয়সালা হয়ে যাবে কি না, সেটি নিয়েই তৈরি হলো রোমাঞ্চ। আলো ততক্ষণে মরে এসেছে। জ্বলে উঠেছে ফ্লাডলাইট। সময় বাড়িয়ে চলতে থাকে শেষ উইকেটের অপেক্ষা। শেষ পর্যন্ত মুমিনুল হকের সরাসরি থ্রোয়ে রান আউট ভিনসেন্ট মাসেকেসা। জিম্বাবুয়ের নাটকীয় ব্যটিং ধসে তিন দিনেই শেষ ম্যাচ!
প্রথম দুই দিনে প্রায় শূন্য গ্যালারির পর বুধবার সাগরিকায় দেখা মেলে বেশ কিছু দর্শকের। তাদের বিনোদনের খোরাক জোগান মেহেদী হাসান মিরাজ। প্রথম ব্যাট হাতে করেন সেঞ্চুরি। পরে নেন ৫ উইকেট। তার অলরাউন্ড নৈপুণ্যে ইনিংস ও ১০৬ রানে জিতে সমতায় সিরিজ শেষ করল স্বাগতিকরা।
চট্টগ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ফ্লা. লে. মতিউর রহমান ক্রিকেট স্টেডিয়ামে দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১১১ রানে গুটিয়ে যায় জিম্বাবুয়ে।
দিনের শুরুতে চমৎকার ব্যাটিংয়ে মিরাজের সেঞ্চুরি ও অভিষিক্ত তানজিম হাসানের সঙ্গে দারুণ জুটিতে ৪৪৪ রানে অলআউট বাংলাদেশ। পেয়ে যায় ২১৭ রানের লিড। সেই ব্যবধান ঘোচাতে পারেনি জিম্বাবুয়ে। ৪২ রানের মধ্যে ৭ উইকেট হারিয়ে তৃতীয় দিনেই হেরে বসে তারা।
প্রথম ম্যাচে বিব্রতকর পরাজয়ের পর নিজেদের সামর্থ্যের জানান দিতে দাপুটে জয় প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের। ইনিংস ব্যবধানের জয়ে দেশের মাটিতে ছয় ম্যাচ পর টেস্ট জয়ের স্বস্তির ছোঁয়া পেলেন শান্তরা।
সেই জয়ের নায়ক মিরাজ। বুধবার দ্বিতীয় সেঞ্চুরিতে ক্যারিয়ার সেরা ১০৪ রান করেন তিনি। ১৬২ বলের ইনিংসে ৩৬ রান ছুঁয়ে টেস্টে ২ হাজার রান পূর্ণ করেন ২৭ বছর বয়সী অলরাউন্ডার।
সিলেট টেস্টে ১০ উইকেট নিয়ে দুইশ উইকেটের মাইলফলকও পূর্ণ করেছিলেন মিরাজ। এই সংস্করণে বাংলাদেশের হয়ে তার আগে দুই হাজার রান ও দুইশ উইকেটের 'ডাবল' আছে শুধু সাকিব আল হাসানের।
ম্যাচের হিসেবে সাকিবকেও ছাড়িয়ে গেছেন এই অলরাউন্ডার। ৫৪তম টেস্টে এই ডাবল পূর্ণ করেন সাকিব। মিরাজের এটি ৫৩তম ম্যাচ।
কীর্তিময় দিনে বল হাতেও জাদু দেখান মিরাজ। জিম্বাবুয়ের ব্যাটিংয়ে ধস নামিয়ে ৫ উইকেট নেন অভিজ্ঞ অফ স্পিনার।
একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট নেওয়া বাংলাদেশের তৃতীয় ক্রিকেটার মিরাজ। তার আগে এই কীর্তি গড়েন সাকিব আল হাসান (২ বার) ও সোহাগ গাজী।
দিনের শুরুতেই অবশ্য ভাগ্যের সহায়তা পান মিরাজ। ভিনসেন্ট মাসেকেসার বলে তার ক্যাচ ছেড়ে দেন টাফাডজোয়া সিগা। ১৭ রানে বেঁচে গিয়ে আর ভুল করেননি মিরাজ। জিম্বাবুয়ের নির্বিষ বোলিংয়ে সুযোগ পেলেই বাউন্ডারি মারতে থাকেন।
অন্য প্রান্তে তাইজুল রাখেন নির্ভরতার ছাপ। দুজন মিলে গড়ে তোলেন ৬৩ রানের জুটি।
দিনের দশম ওভারে ভাঙে অষ্টম উইকেটের বন্ধন। মাসেকেসার ঝুলিয়ে দেওয়া বলে ড্রাইভ করার চেষ্টায় ক্রিজ থেকে বেরিয়ে যায় তাইজুলের পা। বেলস ফেলে তার বিদায়ঘণ্টা বাজান সিগা। ৪৫ বলে ২০ রান করেন তাইজুল।
তখনও ফিফটিই হয়নি মিরাজের। সেঞ্চুরির কথা হয়তো চিন্তাও করছিলেন না তিনি। তবে দশ নম্বরে নেমে দারুণ ব্যাটিং করেন তানজিম। তার ব্যাটিংয়ে ভরসা পেয়ে মিরাজও এগোতে থাকেন তিন অঙ্কের দিকে।
প্রথম সেশনে শুধু তাইজুলের উইকেট হারিয়ে ১১৩ রান করে বাংলাদেশ। ঘরের মাঠে প্রায় দুই বছর ও ১৫ ইনিংস পর তারা করে ফেলে চারশ রান।
মধ্যাহ্ন বিরতির পর ফিরে শর্ট বলের ফাঁদ পাতেন ব্লেসিং মুজারাবানি। তানজিমের হেলমেটে লাগে একটি বাউন্সার। হালকা লাফানো বলে চোখ সরিয়ে নেওয়ায় অন্য এক ডেলিভারি আঘাত করে মিরাজের কাঁধে।
এরপর পাল্টা আক্রমণের পথ বেছে নেন মিরাজ। রাউন্ড দা উইকেট থেকে মুজারাবানির বুক উচ্চতার বাউন্সারে চমৎকার পুল শটে ছক্কা মারেন তিনি। একইসঙ্গে পৌঁছে যান নব্বইয়ে। তবে কিছুক্ষণ পর তিন অঙ্ক নিয়ে পড়ে যান শঙ্কায়।
মাধেভেরের বলে রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে বেকায়দায় পড়ে যান তানজিম। তার গ্লাভস ছুঁয়ে যাওয়া বল সিলি মিড অফে সহজ ক্যাচ নেন নিক ওয়েলচ। ২ চার ও ১ ছক্কায় ৮০ বলে ৪১ রান করেন তানজিম। তার বিদায়ে ভাঙে ৯৫ রানের নবম উইকেট জুটি।
তখনও সেঞ্চুরি থেকে ২ রান দূরে। ওই ওভারের শেষ বলে ঠেকিয়ে দেন হাসান মাহমুদ। পরের ওভারের প্রথম বলে দুই রান নিতে গিয়ে প্রায় বিপদ ডেকে আনেন মিরাজ। তবে বাজে থ্রো করায় বেঁচে যান তিনি।
ওভারের পাঁচ বল নিরাপদে কাটিয়ে দেন হাসান। পরের ওভারে কাঙ্ক্ষিত সিঙ্গেল নিয়ে তিন অঙ্ক স্পর্শ করেন মিরাজ। চার বছর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এই মাঠেই নিজের প্রথম সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি।
শতক ছুঁয়ে আর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। মাসেকেসার বলে ক্রিজ ছেড়ে খেলার চেষ্টায় স্টাম্পড হন মিরাজ।
জিম্বাবুয়ের তৃতীয় বোলার হিসেবে টেস্ট অভিষেকে পাঁচ উইকেট পান মাসেকেসা। ১১৫ রানে ৫ উইকেট নেন ২৮ বছর বয়সী লেগ স্পিনার।
২১৭ রানের লিড নিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে স্পিন দিয়ে বোলিং শুরু করে বাংলাদেশ। সপ্তম ওভারে দলকে প্রথম সাফল্য এনে দেন তাইজুল। দ্বিতীয় স্লিপে ব্রায়ান বেনেটের ক্যাচ নেন সাদমান ইসলাম।
এক বল পর শট না খেলে ছেড়ে দেন নিক ওয়েলচ। বল প্যাডে লাগতেই জোরাল আবেদন হয়। তবে সাড়া দেননি আম্পায়ার। রিভিউ নিয়ে আগের ইনিংসের ফিফটি করা ব্যাটসম্যানকে ফেরায় বাংলাদেশ।
চা বিরতির পর নেমে প্রথম ইনিংসে দারুণ ব্যাটিং করা শন উইলিয়ামসকে বেশিক্ষণ টিকতে দেননি নাঈম হাসান। দ্বিতীয় স্লিপে সহজ ক্যাচ নেন সাদমান।
২২ রানে ৩ উইকেট হারানোর পর প্রতিরোধের চেষ্টা করেন বেন কারান ও ক্রেইগ আরভাইন। দুজন মিলে গড়েন ৪৭ রানের জুটি।
মিরাজের বলে প্রথম স্লিপে আরভাইনের ক্যাচ ছেড়ে তাদের কাজ সহজ করেন শান্ত। ক্যাচটি এতটাই সহজ ছিল যে পরে শান্তকে বলতে শোনা যায়, 'জীবনে অনেক (ক্যাচ) ফেলছি, কিন্তু এরকম ফেলি নাই।'
১৬ রানে জীবন পেয়েও অবশ্য বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি আরভাইন। মিরাজের বলে ক্রিজ ছেড়ে খেলার চেষ্টায় বোল্ড হন জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক। একই ওভারের শেষ বলে পেছনের পায়ে খেলতে গিয়ে এলবিডব্লিউ মাধেভেরে।
মিরাজের পরের ওভারে সিলি মিড অফে ক্যাচ দেন টাফাডজোয়াকে সিগা। তখনও বাকি ৪ উইকেট। উইকেটের পেছন থেকে জাকের আলি বলতে থাকেন, 'আরও ১৩ ওভার আছে ভাই, আজকেই শেষ করি।' উইকেটরক্ষকের কথা রাখেন মিরাজ, তাইজুলরা।
সপ্তম উইকেটে ২০ রান যোগ করেন কারান ও ওয়েলিংটন মাসাকাদজা। পরপর দুই ওভারে দুজনকেই ফেরান মিরাজ। কারানকে কট বিহাইন্ড করে ক্যারিয়ারের ১৩তম পাঁচ উইকেট পূর্ণ করেন অফ স্পিনার।
স্লিপে দাঁড়িয়ে বোলারদের তাড়া দিতে থাকেন শান্ত, 'আজকেই (বাসায়) যেতে চাই আমি। শেষ কর ভাই। শেষ কর।' অধিনায়কের চাওয়া পূরণের কাজটি সহজ করে দেন রিচার্ড এনগারাভা। তাইজুলের বলে ছক্কা মারতে গিয়ে ডিপ মিড উইকেটে ক্যাচ দেন তিনি।
পরে সেই শেষ মুহূর্তের উত্তেজনা। দশম উইকেটে ২০ বলের বেশি খেলে ফেলেন মুজারাবানি ও মাসেকেসা। তখনই মুমিনুলের সরাসরি থ্রোয়ে শান্তদের আনন্দময় সমাপ্তি।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
জিম্বাবুয়ে ১ম ইনিংস: ২২৭
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: (আগের দিন ২৯১/৭) ১২৯.২ ওভারে ৪৪৪ (মিরাজ ১০৪, তাইজুল ২০, তানজিম ৪১, হাসান ০*; এনগারাভা ১৪-২-৫৭-০, মুজারাবানি ২৬-৫-৮৩-১, মাসাকাদজা ৩৪-৫-৯০-১, মাসেকেসা ৩১.২-০-১১৫-৫, মাধেভেরে ১৫-১-৩৫-১, বেনেটে ৯-১-৪৯-১)
জিম্বাবুয়ে ২য় ইনিংস: ৪৬.২ ওভারে ১১১ (বেনেট ৬, কারান ৪৬, ওয়েলচ ০, উইলিয়ামস ৭, আরভাইন ২৫, মাধেভেরে ০, সিগা ০, মাসাকাদজা ১০, এনগারাভা ৫, মাসেকেসা ২, মুজারাবানি ৭*; তাইজুল ১৬.২-৩-৪২-৩, হাসান ২-২-০-০, মিরাজ ২১-৮-৩২-৫, নাঈম ৭-১-৩৪-১)
ফল: বাংলাদেশ ইনিংস ও ১০৬ রানে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: মেহেদী হাসান মিরাজ
ম্যান অব দা সিরিজ: মেহেদী হাসান মিরাজ
সিরিজ: দুই ম্যাচ সিরিজ ১-১ সমতায় শেষ