শুরুতে ধীর ব্যাটিং করলেও শেষ দিকে ঝড় তুলে দলকে জেতানোর চেষ্টা করলেন মোহাম্মদ নাঈম শেখ, তবে খুলনা টাইগার্সের জয়ের জন্য যথেষ্ট হলো না তার লড়াই।
Published : 22 Jan 2025, 11:22 PM
৩ বলে প্রয়োজন তখন ১৩ রান। আগের দুই বল ছক্কায় উড়িয়ে ম্যাচ তুমুল জমিয়ে দিয়েছেন মোহাম্মদ নাঈম শেখ। পরের বলটিও বল সপাটে চালালেন তিনি। ব্যাটের বাইরের কানায় লেগে বল চলে গেল পেছনে। থার্ড ম্যানে ডান দিকে ঝাঁপিয়ে দুর্দান্ত ক্যাচ নিলেন দাভিদ মালান। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন নাঈম। খুলনার ওপেনার বুঝতে পারলেন, সেখানেই শেষ ম্যাচ!
শেষ ওভারের সমীকরণ ছিল ভীষণ কঠিন। প্রয়োজন ছিল ২৫ রান। সেটি আরও কঠিন হয়ে গেল রিপন মন্ডলের প্রথম বলে নাঈম রান নিতে না পারায়। তবু হাল ছাড়লেন না তিনি। পরের দুই বল ডিপ মিড উইকেট ও লং অন দিয়ে উড়িয়ে দিলেন তিনি সীমানার ওপারে। রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে শেষ ওভারে ২৬ রান আটকাতে ব্যর্থ হওয়ার দুঃস্মৃতি নিয়ে ফরচুন বরিশাল দলে তখন নিশ্চিতভাবেই শঙ্কার ঝড়।
তবে রিপনও তো সহজে হার মানার পাত্র নন! দুই ছক্কার হজমের পর খেই না হারিয়ে নাঈমকে আউট করে দেন তিনি। ক্যাচ নেওয়া মালানকে ঘিরে উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে বরিশাল। নতুন ব্যাটসম্যান আমের জামাল চার মারেন প্রথম বলেই। তবে ম্যাচ তখন নাগালের বাইরে। শেষ বলে রিপন দেন কেবল সিঙ্গল। নাটকীয়তায় ভরা ম্যাচে ফরচুন বরিশাল জিতে যায় ৭ উইকেটে।
শেষ দিকে চেষ্টা করলেও খুলনার পরাজয়ে দায় দেওয়া যায় নাঈমকেও। রান তাড়ায় শুরু থেকে টেস্ট মেজাজে ব্যাটিং করে দলের ওপর চাপটা যে তিনিই বাড়ান! এক পর্যায়ে তার রান ছিল ৪০ বলে ৩২!
শেষ পর্যন্ত ৫৯ বলে ৭৭ রানের ইনিংস খেললেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত দলেই থাকতে হয় নাঈমকে।
বরিশালের জয়ের বড় কৃতিত্ব রিশাদ হোসেনের। ওপরের সারির ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার দিনে আট নম্বরে নেমে ৩৯ রানের ক্যামিও ইনিংস খেলেন তিনি। পরে বল হাতে ১ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি অসাধারণ ফিল্ডিংয়ে একটি রানআউটও করেন তরুণ লেগ স্পিনার।
রিশাদের ঝড়ো ইনিংসের সঙ্গে মাহমুদউল্লাহর দায়িত্বশীল ফিফটিতে ১৬৭ রানের পুঁজি দাঁড় করায় বরিশাল। খুলনা যেতে পারে ১৬০ পর্যন্ত।
আট ম্যাচে বরিশালের এটি ষষ্ঠ জয়। সমান ম্যাচে পঞ্চম পরাজয়ের স্বাদ পেল খুলনা।
মিরাজের জোড়া ছোবল, শুরুতেই চাপে বরিশাল
টস জিতে বোলিং নিয়ে প্রথম ওভারে জোড়া আঘাত করেন খুলনার অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ। দ্বিতীয় বলে ভুল লাইনে খেলে এলবিডব্লিউ হন তামিম ইকবাল। তিন নম্বরে নেমে দাভিদ মালান বোল্ড হন প্রথম বলেই।
শুরুতেই দুই উইকেট হারানো বরিশালের চাপ আরও বাড়ে তৃতীয় ওভারে। পয়েন্টে আমির জামালের চমৎকার ফিল্ডিং ও থ্রোয়ে রান আউট হয়ে যান মুশফিকুর রহিম।
১৬ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে কঠিন বিপদে পড়ে যায় বরিশাল।
হৃদয়-মাহমুদউল্লাহর প্রতিরোধ
চতুর্থ উইকেট জুটিতে শুরুর চাপ সামাল দেন তাওহিদ হৃদয় ও মাহমুদউল্লাহ। দুজন মিলে ৪৪ বলে যোগ করেন ৪৭ রান। অষ্টম ওভারে নাসুম আহমেদের বলে ম্যাচের প্রথম ছক্কা মারেন মাহমুদউল্লাহ। পরের ওভারে জিয়াউর রহমানের বল ছক্কায় ওড়ান হৃদয়।
দশম ওভারে আক্রমণে ফিরে জুটি ভঙেন মিরাজ। অফ স্টাম্পের বাইরের বল ছক্কার খোঁজে হাওয়ায় ভাসিয়ে পয়েন্টে ধরা পড়েন হৃদয়। ৪ চার ও ১ ছক্কায় ৩০ বলে করেন ৩৬ রান।
এরপর মোহাম্মদ নাবি ও ফাহিম আশরাফও বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। মাত্র ৮৭ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে অল্পেই গুটিয়ে যাওয়ার শঙ্কা পড়ে যায় বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা।
শেষে রিশাদের ঝড়
আট নম্বরে নেমে ইনিংসের গতি বদলে দেন রিশাদ। একের পর এক চার-ছক্কায় শেষের ৬ ওভারে ৭৬ রান করে বরিশাল।
পঞ্চদশ ওভারে জিয়াউর রহমানের বলে টানা তিনটি চার মারেন রিশাদ। পরের ওভারে মিরাজের বল ছক্কায় ওড়ান মাহমুদউল্লাহ। চলতি বিপিএলে দ্বিতীয় ও সব মিলিয়ে টি-টোয়েন্টিতে ২৫তম ফিফটি করতে ৪৪ বল খেলেন অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান।
পঞ্চাশ ছুঁয়েই ফিরে যান মাহমুদউল্লাহ। ওই ওভারেই জিয়ার বল ছক্কায় ওড়ান রিশাদ। পরে সালমান ইরশাদের বল সীমানার ওপারে পাঠান জাহান্দাদ খান।
শেষ ওভারে আমির জামালের বল কানায় লেগে চার পাওয়ার পর লং অফ দিয়ে ছক্কা মারেন তানভির ইসলাম। স্ট্রাইক ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় রান আউট হন রিশাদ। ১৯ বলে ৩৯ রানের ইনিংসে ৫ চারের সঙ্গে তিনি মারেন একটি ছক্কা।
খুলনার মন্থর শুরু
চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্যে শুরু থেকেই রানের জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকেন খুলনার ব্যাটসম্যানরা। দ্বিতীয় ওভারে জাহান্দাদের বলে ক্যাচ আউট হন ইমরুল কায়েস। রানের খাতা খোলার আগেই ফেরেন অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান।
তিন নম্বরে নেমে রানের গতি বাড়াতে ব্যর্থ হন মিরাজ। আরেক ওপেনার নাঈম যেন টি-টোয়েন্টির বাস্তবতাই ভুলে যান। পাওয়ার প্লেতে মোটে ৪টি বাউন্ডারি মারতে পারে খুলনা। স্কোরবোর্ডে জমা হয় ৩১ রান।
তানভিরের পরপর দুই ওভারে ছক্কা মেরে রান রেট বাড়ানোর চেষ্টা করেন মিরাজ। তবে বেশি দূর যেতে পারেননি তিনি। একাদশ ওভারে মোহাম্মদ নাবির বলে বড় শটের খোঁজে ডিপ মিড উইকেটে ধরা পড়েন খুলনা অধিনায়ক। ২৯ বলে করেন ৩৩ রান।
দুই ওভার পর রিশাদের বলে আউট হন অ্যালেক্স রস। ৮ বলে তিনি করেন ৪ রান। ১৩.১ ওভারে খুলনার স্কোর তখন মাত্র ৩ উইকেটে ৭৪ রান। নাঈমের নামের পাশে তখন ৪০ বলে ৩২ রান।
নাঈম-আফিফের পাল্টা আক্রমণ
পাঁচ নম্বরে নেমে প্রথম বলেই ছক্কা মারেন আফিফ হোসেন। দুই বল পর মারেন বাউন্ডারি। জাহান্দাদের পরের ওভারে ৬ রানের বেশি নিতে পারেনি তারা। ফলে পাঁচ ওভারে বাকি থাকে ৭৬ রান। তখনই যেন হুশ ফেরে নাঈমের। শুরু করেন চার-ছক্কার মার।
ষোড়শ ওভারে বোলিংয়ে এসে নাঈমের কাছে চারের পর ছক্কা হজম করেন রিপন। এক বল পর স্ট্রাইক পেয়ে ওয়াইড লং দিয়ে ছক্কায় ওড়ান আফিফ। পরের ওভারে দুটি 'নো' বল করেন ফাহিম। তবে ফ্রি হিট কাজে লাগাতে পারেননি দুই ব্যাটসম্যান। ওভারের শেষ দুই বলে চার-ছক্কা মারেন নাঈম। ৪৯ বলে পূর্ণ হয় তার পঞ্চাশ।
স্পেলের শেষ ওভার করতে এসে আফিফকে ফেরান জাহান্দাদ। এক বল পর রিশাদের দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়ে রানআউট হন মাহিদুল ইসলাম।
তখনই মনে হচ্ছিল ম্যাচ হেলে পড়েছে বরিশালের দিকে। তবে নাঈম হাল ছাড়েননি। শেষ ওভার পর্যন্ত লড়াই করলেও অবশ্য ফল পক্ষে আনতে পারেনি বাঁহাতি ওপেনার। শেষ ১৯ বলে ৪৫ রান করেন তিনি। তা যথেষ্ট হয়নি জয়ের জন্য।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
ফরচুন বরিশাল: ২০ ওভারে ১৬৭/৯ (হৃদয় ৩৬, তামিম ০, মালান ০, মুশফিক ৫, মাহমুদউল্লাহ ৫০, নাবি ১, ফাহিম ৯, রিশাদ ৩৯, জাহান্দাদ ১০, তানভির ১২*, রিপন ১*; মিরাজ ৪-০-৩৫-৩, জামাল ৪-০-৪২-০, নাসুম ৪-০-২৫-১, সালমান ৪-০-১৯-২, জিয়াউর ৪-০-৪৫-১)
খুলনা টাইগার্স: ২০ ওভারে ১৬০/৬ (নাঈম ৭৭, ইমরুল ০, মিরাজ ৩৩, রস ৪, আফিফ ২৭, মাহিদুল ২, বসিস্টো ০*, জামাল ৫*; নাবি ৪-০-১৯-১, জাহান্দাদ ৪-০-২০-২, ফাহিম ৪-০-৩৬-০, রিপন ৪-০-৪৩-১, তানভির ২-০-২০-০, রিশাদ ২-০-১৭-১)
ফল: ফরচুন বরিশাল ৭ রানে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: রিশাদ হোসেন