অপেক্ষা এবার তামিমের ব্যাটে বড় রানের

গত ১ বছরে দলের সর্বোচ্চ রান তার, এই সময়ে ওপেনিংয়ে সেরা স্ট্রাইক রেটও তার, তবে বাংলাদেশ অধিনায়কের সেঞ্চুরি নেই ১৭ ইনিংস ধরে।

ক্রীড়া প্রতিবেদকসিলেট থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 March 2023, 01:41 PM
Updated : 21 March 2023, 01:41 PM

লিটন দাসের ব্যাট ছুঁয়ে বল বেশ দ্রুতগতিতে ছুটে গেল শর্ট ফাইন লেগে। নন স্ট্রাইক প্রান্ত থেকে রান নিতে ছুটলেন তামিম ইকবাল। মুহূর্ত খানিক পরই হয়তো বুঝলেন, ভুল করে ফেলেছেন। ততক্ষণে হয়ে গেছে অনেক দেরি। ফিল্ডারের সরাসরি থ্রোয়ে যখন বেলস উড়ে গেল, তামিম তখন ক্রিজের ধারেকাছেও নেই। থাকার কথাও নয়। রান হয় না ওখানে কোনোভাবেই। আইরিশদের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে অসম্ভব রানের পেছনে ছুটে এমন আত্মহত্যা তামিমের বড় রানে ফেরার সম্ভাবনাকে দীর্ঘায়িত করল আরও। 

ওয়ানডেতে তামিমের ফিফটি নেই ৬ ইনিংস ধরে। খুব বাজে সময় বা অফ ফর্ম এটিকে সেভাবে বলা যায় না। এই ৬ ইনিংসের মধ্যে ১৯, ২৩, ৩৫ ও ২৩ রানের ইনিংস আছে। রান পাচ্ছেন না বলার উপায়ও তাই নেই। তবে তামিমের মতো একজনের নামের পাশে তো সংখ্যাগুলো বেমানান। থিতু হয়ে যাওয়ার পর তো তার কাছে বড় ইনিংসই চায় দল। পরপর দুই সিরিজে অধিনায়কের বড় ইনিংস খেলতে না পারা চোখে লাগে বৈকি। 

এমনিতে তার নেতৃত্বে বড় কোনো খামতি এখনও সেভাবে ফুটে ওঠেনি। মাঠের ভেতরে-বাইরে নেতৃত্বের কাজটি ঠিকঠাক করছেন বলেই মনে হচ্ছে। তবে অধিনায়ককে তো আগে পারফর্মও করতে হবে। 

তামিম অবশ্য এখানে আপত্তিও জানাতে পারেন। ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড সিরিজে বড় রান না পেলেও ঠিক এই দিনটি থেকে সবশেষ ১ বছরের পারফরম্যান্স বিবেচনায় নিলে ওয়ানডেতে দলের সবচেয়ে বেশি রান তারই। এই সময়ে ১২ ইনিংসে করেছেন ৪৩ গড়ে ৪৩০ রান। এই সময়ে দলের সবচেয়ে বেশি পঞ্চাশ ছোঁয়া ইনিংসও তার (৪টি)। স্ট্রাইক রেট ৮১.৫৯। 

এই সময়ে রানের তালিকায় দুইয়ে থাকা লিটন দাস ১ ইনিংস বেশি খেলে রান করেছেন ৩৫.৬৩ গড়ে ৩৯২। ফিফটি তিনটি, স্ট্রাইক রেট ৮১.৬৬। 

তামিমের দুঃসময় তাই বলার জো নেই। তবে প্রত্যাশা সবটুকু পূরণ হচ্ছে কিনা বা তার সামর্থ্য ও অভিজ্ঞতার প্রতিফলন পারফরম্যান্সে পুরোপুরি পড়ছে কি না, এই প্রশ্ন তোলাই যাই। বিশেষ করে, বড় ইনিংসের ক্ষেত্রে। 

এই যে টানা ৬ ইনিংসে ফিফটি নেই তার, এর ঠিক আগের ৫ ইনিংসে তাকালেই চিত্রটা আরও ভালোভাবে ফুটে ওঠে। একটিতে তিনি অপরাজিত ৫০ করে দলের জয় সঙ্গে নিয়ে ফেরেন। বাকি ৪ ইনিংসে রান ছিল ৩৩, ৩৫, ৬২, ৫০। বারবারই থিতু হয়ে ইনিংস লম্বা করতে না পারার সেই ধারাবাহিকতা। 

ওয়ানডেতে তার সবশেষ সেঞ্চুরিটি ২০২১ সালের জুলাইয়ে জিম্বাবুয়েতে। এরপর পেরিয়ে গেছে ১৭ ইনিংস। 

অধিনায়কত্বের ৩২ ইনিংসে তামিমের সেঞ্চুরি ওই একটিই। এই পরিসংখ্যান তার মনে অস্বস্তির কাঁটা হয়ে বিদ্ধ করার কথা। 

স্ট্রাইক রেট নিয়ে প্রশ্ন তো অনেক দিন ধরেই তার সঙ্গী। তিনি জবাবও দিয়েছেন নানা সময়ে, কখনও ব্যাট হাতে, কখনও মুখে। তবে প্রশ্নগুলো যায়নি। গত এক বছরে তার ৮১.৫৯ স্ট্রাইক রেটও এই সময়ের ক্রিকেটে একজনের ওপেনারের জন্য যথেষ্টই কম। 

এই এক বছরে ওপেনিংয়ে অন্তত ১০টি ইনিংস খেলেছেন, এমন ওপেনারদের মধ্যে শুবমান গিলের স্ট্রাইক রেট ১০৯.১৪, কুইন্টন ডি ককের ১০৭.৪৪, রোহিত শর্মার ১০৪.৫৩। তামিমের নাম এই তালিকায় ১৫ নম্বরে। 

বাংলাদেশের টপ অর্ডারের অন্যদের স্ট্রাইক রেটের অবস্থাও অবশ্য এই এক বছরে খুব দারুণ কিছু নয়। এই সময়ে ওপেনিংয়ে লিটনের স্ট্রাইক রেট (৭৯.৮৯) তামিমের চেয়েও কম। ওপেনিং থেকে তিন নম্বর মিলিয়ে ১২ ইনিংস খেলা নাজমুল হোসেন শান্তর স্ট্রাইক রেট ৭২.১২। 

টপ অর্ডারে তাই তামিমের স্ট্রাইক রেটই এগিয়ে। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতা তো আর আদর্শ মানদণ্ড নয়! বিশ্বকাপের দিকে তাকিয়ে এখানেও উন্নতি তাই জরুরি। তামিমের মতো অভিজ্ঞ একজনের কাছ থেকে দ্রুত রান ও বড় ইনিংস, দুটিই চাইবে দল। 

স্ট্রাইক রেটের আলোচনায় অবশ্য সাধারণ পরিসংখ্যানের বাইরেও অনেক ব্যাপার থাকে। উইকেট, কন্ডিশন ও ম্যাচের পরিস্থিতি অনেক সময়ই আলোচনায় আড়াল হয়ে যায়। এই এক বছরে দেশের বাইরে ৭ ইনিংসে তামিমের স্ট্রাইক রেট ৮৭.২৩, কিন্তু দেশের মাঠে ৬৬.৪৩। 

এবারের ইংল্যান্ড সিরিজে যেমন প্রথম ম্যাচের উইকেট খুব সহজ ছিল না। পরের ম্যাচে বাংলাদেশ তিন উইকেট হারিয়ে ফেলে তিন ওভারের মধ্যেই। উইকেট আগলে রাখাই তখন মূল কাজ ছিল। তার পরও অবশ্য সেদিনের ৬৫ বলে ৩৫ রানের ইনিংসটি দৃষ্টিকটূ ছিল। শুরুর মন্থরতা তিনি পুষিয়ে দিতে পারেননি পরে।

এবার আয়ারল্যান্ড সিরিজের দুই ম্যাচে ৩৩৮ রান ও ৩৪৯ রান তুলে বাংলাদেশ রানের রেকর্ড গড়লেও শুরুতে উইকেট চ্যালেঞ্জিং ছিল দুই দিনই। প্রথম ম্যাচে শুরুর ১০-১৫ ওভারে উইকেটে বল একটু থমকে এসেছে, বাউন্স ছিল একটু অসম। পরের দিকে সহজ হয়ে আসে কিছুটা। 

দ্বিতীয় ম্যাচে শুরুর সময় আকাশ ছিল মেঘলা, আবহাওয়া স্যাঁতস্যাঁতে। উইকেটে সবুজ ঘাসের ছোঁয়াও ছিল। আয়ার‌ল্যান্ডের নতুন বলের দুই পেসার দারুণ সুইং বোলিংয়ে বেশ পরীক্ষা নেন তামিম-লিটনের। সেই চ্যালেঞ্জিং সময়টা পার করে দেন দুজনই। এরপর যখন তামিমকে মনে হচ্ছিল ছন্দ পেতে শুরু করেছেন, তখনই ওই রান আউট। 

লিটন শুরুতে ২২ বলে ৬ রান করলেও পরে পুষিয়ে দেন। এই ইনিংসের আগে টানা ৭ ইনিংস ফিফটি ছিল না তার। সেই ধারা কাটিয়ে উঠে খেলেন ৭১ বলে ৭০ রানের ইনিংস। সেঞ্চুরি পাওনা হয়ে গেছে অবশ্য তার কাছেও। সবশেষ ওয়ানডে সেঞ্চুরির পর তার পেরিয়ে গেছে ১৬ ইনিংস। 

তবে অধিনায়ক বলে তামিমের দায়িত্বটুকু বেশি। অধিনায়ক বলে তার দিকে নজরও বেশি। অধিনায়ক বলে তার কাছে প্রত্যাশাটাও বেশি।    

রান-গড়-স্ট্রাইক রেট, এসব পরিসংখ্যানের নানা বাস্তবতার বাইরে আরেকটি ব্যাপার আছে খেলার ধরন। তামিম আপাতত নিজের সেরা ছন্দে নেই, সেটা ফুটে উঠছে তার ব্যাটিংয়ে। গত ডিসেম্বরে ভারতের বিপক্ষে সিরিজটি তিনি খেলতে পারেননি চোটের কারণে। এরপর ইংল্যান্ড সিরিজের তিন ম্যাচ আর এবার আয়ারল্যান্ড সিরিজে তাকে খুব সাবলিল দেখা যায়নি। 

তিনি নিজেও হয়তো তাগিদটা অনুভব করছেন। দ্বিতীয় ওয়ানডের আগের দিন দলের অনুশীলন না থাকলেও বৃষ্টিময় দিনে তিনি কোচদের নিয়ে ইনডোরে ব্যাটিং করেন ঘণ্টা দেড়েক। কিন্তু পরদিন রান আউট হয়ে শেষ হয় বড় কিছুর সম্ভাবনা। 

আপাতত এই সিরিজে শেষ সুযোগ শেষ ম্যাচে। এই সিরিজে বাংলাদেশের বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা অনেকটা সফল হয়েছে। নবীন তাওহিদ হৃদয় নিজেকে মেলে ধরেছেন আবির্ভাবেই, ছয় নম্বরে নতুন ভূমিকায় অসাধারণ করছেন মুশফিকুর রহিম। দলের শরীরী ভাষা, মানসিকতায় ভয়ডরহীন ও আগ্রাসী ক্রিকেটের ছাপ মিলছে। বিশ্বকাপের দিকে তাকিয়ে সার্বিকভাবে আশার জায়গা আছে কিছু। অপেক্ষা এবার অধিনায়কের ব্যাটে দাপুটে সেঞ্চুরির!