তারা বলছেন, ওমিক্রন বেশিরভাগ মানুষকে সংক্রমিত করে ফেললে হয়ত অর্জিত হবে সেই বহু আলোচিত হার্ড ইমিউনিটি; তখর আর এ ভাইরাস বড় কোনো বিপদ ঘটাতে পারবে না।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য সেই সম্ভাবনা খুব একটা দেখছেন না।
মহামারী শুরুর পর থেকে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আর চিকিৎসকদের একটি অংশ এই হার্ড ইমিউনিটির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করে আসছেন।
এ ধারণার মূল শর্তই হল, মোট জনসংখ্যার বেশিরভাগের শরীরে একটি নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হতে হবে। অর্থাৎ, ভাইরাসের সংস্পর্শে এলেও তারা আক্রান্ত হবেন না।
কোনো জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে কার্যকর ওই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হলে ভাইরাসও আর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য কোনো বাহক খুঁজে পাবে না। আর সেক্ষেত্রে ওই জনগোষ্ঠীর মধ্যে আর ওই নির্দিষ্ট ভাইরাসের অস্তিত্ব থাকবে না। অর্থাৎ, ওই জনগোষ্ঠীর মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে।
তত্ত্বীয়ভাবে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হতে পারে দুভাবে। এক, যদি ওই জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সেরে ওঠেন, এবং প্রাকৃতিকভাবে তাদের শরীরে ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর ও স্থায়ী অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। দুই, যদি টিকা দিয়ে ওই জনগোষ্ঠীর সবার মধ্যে ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ তুলে ধরে রয়টার্স এক প্রতিবেদনে লিখেছে, রূপ পরিবর্তন বা মিউটেশনের মাধ্যমে গত বছর খুব দ্রুততার সঙ্গে করোনাভাইরাসের নতুন কয়েকটি ধরন তৈরি হওয়ায় হার্ড ইমিউনিটির আশা ক্ষীণ হয়ে আসছে।
যারা ইতোমধ্যে টিকা নিয়েছেন কিংবা কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন তারাও নতুন ধরনগুলোর মাধ্যমে আবারও সংক্রমিত হচ্ছেন।
তাদের যুক্তি ছিল, যেহেতু এই ধরনটি অতি দ্রুত ছড়াচ্ছে এবং তুলনামূলক মৃদু অসুস্থতার কারণ হচ্ছে, এর ফলে দ্রুতই অনেক মানুষ কম ক্ষতিকর উপায়ে সার্স-সিওভি-২ ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিরোধ তৈরি করবে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা নেওয়া ব্যক্তি কিংবা ইতোপূর্বে কোভিড থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের সংক্রমণে আগের ধরনগুলোর চেয়ে বেশি মাত্রায় সফল হচ্ছে অতি সংক্রামক ধরন ওমিক্রন। যে কারণে ভবিষ্যতেও এ ভাইরাস মানব দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ভেদ করতে পারবে- এমন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. ওলিভিয়ার লে পোলেইন বলেন, “মহামারীতে যে অভিজ্ঞতা আমরা পেয়েছি তাতে বলা যায়, একটি সীমার পর সংক্রমণ থেমে যাবে এমন তত্ত্বীয় মীমাংসায় পৌঁছানো বাস্তবসম্মত নয়।”
তবে শরীরে ইতোপূর্বে তৈরি হওয়া প্রতিরোধ কোনো ফল দেয় না- তেমনও বলা যাবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা নেওয়া এবং সংক্রমিত হওয়ার মধ্য দিয়ে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ বাড়ছে। এর ফলে যারা সংক্রমিত হয়েছেন কিংবা আবারও সংক্রমিত হচ্ছেন, তাদের ক্ষেত্র রোগটি কম গুরুতর হচ্ছে।
হামের মতো নয়
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিকভাবে কোভিড-১৯ টিকাগুলো সংক্রমণ ঠেকানোর চেয়ে বরং রোগের কারণে মৃত্যু এবং গুরুতর অসুস্থতা ঠেকানোর লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছিল।
তবে ২০২০ সালের শেষভাগে পরীক্ষামূলক ব্যবহারে দুটি টিকা রোগের বিরুদ্ধে ৯০ শতাংশ কার্যকর দেখা গেলে ব্যাপক হারে টিকা দিয়ে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের আশা জ্বলে উঠে। এভাবে টিকা দিয়ে হামও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছিল।
তবে সার্স-সিওভি-২ ভাইরাসের ক্ষেত্রে তেমনটা কল্পনা করার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে জানান হাভার্ড টি এইচ চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ মার্ক লিপস্টিচ।
তিনি বলেন, “প্রথমটি হচ্ছে ইমিউনিটি, বিশেষ করে সংক্রমণের ক্ষেত্রে যা গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা, এখন পর্যন্ত আমাদের হাতে থাকা টিকাগুলো থেকে যেটা তৈরি হয়, তা খুব দ্রতই দুর্বল হয়ে যায়।”
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, ভাইরাসটি এমনভাবে দ্রুত রূপ বদল বা মিউটেট করতে পারে যে আগের সংক্রমণ বা টিকা গ্রহণের ফলে তৈরি হওয়া সুরক্ষা এড়িয়ে যেতে পারে – এমনকি প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল না হলেও।
ওমিক্রনের সংক্রমণ দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে বাড়িয়ে তুলবে এবং বিশেষ করে পরবর্তীতে যে ধরন আসবে তার বিরুদ্ধে তা কার্যকর হবে- এমন ধারণার বিষয়েও তিনি সতর্ক করেন।
“বড় জোর এমন হতে পারে যে, আপনি হয়তো ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়েছেন, আপনাকে হয়ত সেটা আবারও ওমিক্রনে সংক্রমিত হওয়া থেকে রক্ষা দিতে পারে।”
ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কনট্রোলের শীর্ষ ইনফ্লুয়েঞ্জা বিশেষজ্ঞ পাসি পেনটিনেন বলেন, যেসব টিকার উন্নয়নে কাজ চলছে, সেসব যদি করোনাভাইরাসের আগামী ধরনগুলো কিংবা একাধিক ধরনের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে পারে, তখন এ পরিস্থিত বদলাতে পারে। তবে সে জন্য সময় লাগবে।
তারপরও, স্বাভাবিক জীবনে ফেরার একটা টিকেট হিসেবে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের আশা ঝেড়ে ফেলা অনেকের জন্যই বেশ কঠিন।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের কম্পিউটেশনাল সিস্টেম বায়োলজির অধ্যাপক ফ্রাঁসোয়া ব্যালো রয়টার্সকে বলেন, “গণমাধ্যমে এ বিষয়গুলোই বলা হচ্ছিল: ‘জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ টিকা পেলে আমরা হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করব।’ সেটা তো হল না। এরপর বলা হল- ৮০ শতাংশ। এটাও ঘটল না।”
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, করোনাভাইরাস শেষ পর্যন্ত একটি এনডেমিকে (সাধারণ রোগ) পরিণত হয়ে জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্থায়ীভাবে থাকবে এবং মাঝেমধ্যেই স্থানভেদে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।
ওমিক্রনের আবির্ভাবের কারণে এখন প্রশ্ন উঠছে, কবে নাগাদ সেটা হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংক্রামক রাগ বিশেষজ্ঞ ড. ওলিভিয়ার লে পোলেইন উত্তরে বলছেন, “সেই জায়গায় আমরা একদিন পৌঁছাব, তবে এই মুহূর্তে আমরা সেই পর্যায়ে নেই।”