কোভিড চিকিৎসায় স্টেরয়েড এড়িয়ে চলার পরামর্শ ভারতে

বিশ্বে ওমিক্রনের দাপটের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় সংশোধিত নির্দেশিকা দিয়েছে ভারতের কোভিড টাস্কফোর্স, যাতে স্টেরয়েডের ব্যবহার এড়িয়ে চলতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে চিকিৎসকদের।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Jan 2022, 07:07 PM
Updated : 18 Jan 2022, 07:07 PM

এনডিটিভি লিখেছে, গতবছর মার্চ-মে সময়ে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপের মধ্যে রোগী বাঁচাতে স্টেরয়েডের অতিব্যবহার নিয়ে ভারতের কোভিড টাস্কফোর্সের প্রধান হতাশা প্রকাশ করার পর নতুন এই নির্দেশিকা এল।

সেখানে বলা হয়েছে, কোভিড চিকিৎসার জন্য আগেভাগেই প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত মাত্রায় স্টেরয়েডের মত ওষুধ দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহার করলে মিউকরমাইকোসিস বা কালো ছত্রাকের মত ‘সেকেন্ডারি সংক্রমণ’ এর ঝুঁকি’ বেড়ে যায়।

‘হালকা, মাঝারি এবং গুরুতর’- তিন ধরনের সংক্রমণের ক্ষেত্রে ওষুধের ডোজ নির্ধারণ করে দিয়ে নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, যদি কাশি দুই-তিন সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয়, তাহলে রোগীদের যক্ষ্মা এবং অন্যান্য রোগের পরীক্ষা করাতে হবে।

ভারতে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভয়াবহ সংক্রমণ ও মৃত্যুর মধ্যে স্টেরয়েডের ‘অতি ব্যবহার’ ও ‘ভুল ব্যবহার’ নিয়ে গত সপ্তাহে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন নীতি আয়োগের সদস্য (স্বাস্থ্য) এবং কোভিড টাস্ক ফোর্সের প্রধান ড. ভি কে পাল।

ওই সময় ভারতে নতুন আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছিল কালো ছত্রাক বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস হিসেবে পরিচিত ‘মিউকরমাইকোসিস’। এই ছত্রাক সাইনাস, মস্তিষ্ক ও ফুসফুসে আক্রমণ করে। ডায়াবেটিস, এইডস বা ক্যান্সারে যারা আক্রান্ত, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দারুণভাবে দুর্বল, তাদের ক্ষেত্রে এ সংক্রমণ প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।

ভারতে এই ছত্রাকে আক্রান্ত হওয়ার পেছনে মূল কারণ হল কৃত্রিম অক্সিজেন সরবরাহের অপরিচ্ছন্ন পদ্ধতি। সেই সঙ্গে ভূমিকা ছিল কোভিডে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় বাছবিচার না করে স্টেরয়েডের ব্যবহার।

শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যখন করোনাভাইরাসকে ঠেকাতে সর্বশক্তি ব্যবহার করে, তখন শরীরেরও কিছু ক্ষতি হয়। সেই ক্ষতি কমাতে অনেক ক্ষেত্রে সহায়ক হয় স্টেরয়েড। কোভিড রোগীদের ক্ষেত্রে স্টেরয়েড ফুসফুসের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে, তাতে মৃত্যুঝুঁকি কমে যায়।

কিন্তু স্টেরয়েড দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও দমিয়ে রাখে, যাদের ডায়াবেটিস আছে এবং যাদের নেই, সবার রক্তেই চিনির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।

বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, এক বা একাধিক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত এবং বিনা সতর্কতায় স্টেরয়েড ব্যবহার করেন, তাদের এই ছত্রাকের শিকার হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা রোগীদের একটি বড় অংশ নতুন করে পুরোপুরি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন- এ নিয়ে চিকিৎসকদের শঙ্কা রয়েছে।

মুম্বাইভিত্তিক ডায়াবেটোলজিস্ট ড. রাহুল বকশি বিবিসিকে বলেছিলেন, “দুশ্চিন্তার বিষয়টি হচ্ছে, মহামারী পার হওয়ার পর ভারতে ডায়াবেটিসের একটি সুনামি দেখা দিতে পারে।”

চিকিৎসায় ব্যবহৃত স্টেরয়েডই এই কোভিড পরবর্তী ডায়াবেটিসের মূল কারণ, নাকি এক্ষেত্রে কোভিডেরও সরাসরি কোনো ভূমিকা আছে, তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে চিকিৎসকদের মধ্যে আলোচনা চলছে।

ভারতের সংশোধিত নির্দেশিকা অনুসারে, শ্বাসকষ্ট বা হাইপোক্সিয়া না থাকলে শ্বাসযন্ত্রের উপরের অংশ যেমন- নাক, নাকের ছিদ্র, মুখ, গলা, স্বরযন্ত্রে সংক্রমণের উপসর্গগুলোকে ‘মৃদু বা হালকা’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করতে হবে। সেজন্য বাড়িতে আইসোলেশন ও রোগীর যত্ন নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

মৃদু কোভিডে যারা ভুগছেন তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট, বেশি জ্বর, বা পাঁচ দিনের বেশি কাশি থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

যাদের রক্তে অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯০ থেকে ৯৩ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করছে এবং যাদের শ্বাসকষ্ট রয়েছে, তাদের অসুস্থতা ‘মাঝারি’ মাত্রার বিবেচনা করে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের রোগীদের কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন দিতে হবে।

শ্বাস-প্রশ্বাসের হার প্রতি মিনিটে ৩০ এর বেশি হলে, ঘরের মধ্যেই যদি রোগীর  রাক্তে অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯০ এর নিচে নেমে যায়, তেমন রোগীদের আইসিইউতে রেখে অক্সিজেন দেওয়ার প্রয়োজন হবে। এ ধরনের অবস্থাকে ‘গুরুতর’ বিবেচনা করতে হবে।

এ ধরনের রোগীদের কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের সহায়তা দিতে হতে পারে। সেজন্য ‘নন-ইনভেসিভ ভেন্টিলেশন’ হেলমেট বা ফেইস মাস্ক ইন্টারফেস ব্যবহার করা যায়।

ডেল্টার সংক্রমণের সময় স্টেরয়েডের মত রেমডিসিভিরও ব্যবহার করা হয়েছিল ব্যাপক হারে, যদিও এই ওষুধ কোভিডের চিকিৎসায় আদৌ সুফল দেয় কি না, সেই প্রশ্নের চূড়ান্ত মীমাংসা হয়নি। 

সংশোধিত নির্দেশিকায় ‘মাঝারি থেকে গুরুতর’ রোগীদের ক্ষেত্রে ‘রেমডিসিভির’ ওষুধের জরুরি ব্যবহারের অনুমতি অব্যহাত রাখা হয়েছে। তবে দেখতে হবে, সেই রোগীদের কিডনি বা যকৃতের কোনো সমস্যা যেন না থাকে। আর যারা কৃত্রিম অক্সিজেন নিচ্ছেন না, বা বাড়িতে ‘সেরকম ব্যবস্থা’ নেই, সেসব রোগীদের এ ওষুধ ব্যবহারে ক্ষেত্রে সতর্ক করা হয়েছে।

গুরুতর রোগীদের ক্ষেত্রে আইসিইউতে ভর্তির ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জরুরি ব্যবহারের জন্য ‘টোসিলিজুমাব’ ওষুধের ব্যবহার করতে পারবেন ভারতের ডাক্তাররা। 

যাদের ফুসফুসে সংক্রমণ অনেক বেশি ছড়িয়ে গেছে, স্টেরয়েড ব্যবহারেও কাজ করছে না, তাদের শরীরে সক্রিয় কোনো ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক বা যক্ষ্মার সংক্রমণ না থাকলে টোসিলিজুমাব ব্যবহার করা যেতে পারে।

যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি, বা যাদের ‘হৃদরোগ, হাইপারটেনশন, করোনারি আর্টারি ডিজিজ, ডায়াবেটিস, এইচআইভি, যক্ষ্মা, ফুসফুসের সমস্যা, কিডনি বা লিভারের রোগ, স্থূলতা রয়েছে, তাদের কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার এবং মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি বলে জানিয়েছে ভারতের কোভিড টাস্কফোর্স।