এ অবস্থায় যুক্তরাজ্যের একদল বিশেষজ্ঞ মৃদু উপসর্গ দেখা গেলেই কমিউনিটিতে গণপরীক্ষার ব্যবস্থা থেকে সরে এসে হাসপাতালে গুরুতর রোগীদের চিকিৎসায় আরও বেশি মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। অর্থাৎ, করোনাভাইরাসকে সঙ্গী করেই মানুষকে এখন বাঁচতে শিখতে হবে।
ওই বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অধ্যাপক অ্যান্ড্রু পোলার্ডও আছেন, যার নেতৃত্বে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। গত মঙ্গলবার ব্রিটিশ এমপিদের সামনে তিনি সর্বশেষ গবেষণার তথ্যউপাত্ত তুলে ধরেন বলে গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়।
পোলার্ড বলেন, টিকা করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টকে পুরোপুরি ঠেকাতে পারছে না। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, পুরো জনসংখ্যার মধ্যে সুরক্ষা তৈরি বা হার্ড ইমিউনিটির ধারণা এখানে কেবলই ‘মিথ’।
কোভিড মহামারী বিষয়ে গঠিত যুক্তরাজ্যের সর্বদলীয় পার্লামেন্টারি গ্রুপের সামনে তিনি বলেন, “মোট জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশকে যদি হামের টিকা দেওয়া যায়, তাহলে হামের ভাইরাস আর ছড়ানোর পথ পায় না। কিন্তু সমস্যা হল, এটা হামের ভাইরাস নয়।
“যারা টিকা নিয়েছেন, তাদেরও সংক্রমিত করছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। তা মানে হল, যারা টিকা নিচ্ছেন না, কোনো না কোনো সময় তারাও ভাইরাসের শিকার হতে পারেন। আর আমাদের হাতে এমন কিছু নেই, যা এই সংক্রমণ পুরোপুরি ঠেকাতে পারে।”
বিবিসি লিখেছে, যদি সব শিশুকেও টিকা দিয়ে ফেলা হয়, তাতেও করোনাভাইরাসের বিস্তার পুরোপুরি বন্ধ করার নিশ্চয়তা মিলবে না বলেই পোলার্ডের ভাষ্য।
আর ভবিষ্যতে এ ভাইরাসের নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্টও আবির্ভূত হতে পারে, যেটা হয়ত টিকা পাওয়া ব্যক্তিদের সংক্রমিত করার ক্ষেত্রে আরও বেশি সক্ষমতা দেখাবে।
ভাইরাসের বিরুদ্ধে পুরোপুরি সুরক্ষা দিতে না পারলেও বর্তমানে মানুষের হাতে থাকা করোনাভাইরাসের টিকাগুলো কোভিডের অসুস্থতা গুরুতর হয়ে ওঠা কার্যকরভাবে ঠেকিয়ে দিতে পারছে। তাতে মৃত্যু ঝুঁকিও কমে আসার প্রমাণ পাওয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
লন্ডন ইমপেরিয়াল কলেজের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষার তথ্য দিয়ে গার্ডিয়ান বলেছে, ২৮ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে যারা টিকা পেয়েছেন, তাদের করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি টিকা না পাওয়া ব্যক্তিদের তুলনায় ৪৯ শতাংশ কম।
আবার পুরোপুরি টিকা নেওয়া কেউ যদি কোনো কোভিড রোগীর সংস্পর্শে আসেন, তার ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস পজিটিভ আসার সম্ভাবনা টিকা না পাওয়া ব্যক্তিদের অর্ধেক।
কিন্তু হার্ড ইমিউনিটির ধারণার মূল শর্তই হল মোট জনসংখ্যার বেশিরভাগের শরীরে একটি নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হতে হবে। অর্থাৎ, ভাইরাসের সংস্পর্শে এলেও তারা আক্রান্ত হবেন না।
কোনো জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে কার্যকর ওই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হলে ভাইরাসও আর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য কোনো বাহক খুঁজে পাবে না। আর সেক্ষেত্রে ওই জনগোষ্ঠীর মধ্যে আর ওই নির্দিষ্ট ভাইরাসের অস্তিত্ব থাকবে না। অর্থাৎ, ওই জনগোষ্ঠীর মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে।
এখন, তত্ত্বীয়ভাবে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হতে পারে দুভাবে। এক, যদি ওই জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সেরে ওঠেন, এবং প্রাকৃতিকভাবে তাদের শরীরে ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর ও স্থায়ী অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। দুই, যদি টিকা দিয়ে ওই জনগোষ্ঠীর সবার মধ্যে ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়।
কিন্তু করোনাভাইরাসে যারা একবার আক্রান্ত হয়েছেন, তারা পরে আবারও আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। অর্থাৎ, তাদের শরীরে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, অথবা করোনাভাইরাসের অন্য ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে তা কার্যকর নয়। আবার টিকা দিয়েও সংক্রমণ এড়িয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা পুরোপুরি মিলছে না।
অর্থাৎ, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের কোনো সম্ভাবনা বিজ্ঞানীরা আর দেখছেন না।
তার মতে, বুস্টার ডোজ তখনই দেওয়া উচিত, যখন হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা কিংবা মৃত্যুর হার নতুন করে বাড়তে দেখা যাবে।
তাছাড়া টিকা দেওয়ার পর শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তা দীর্ঘস্থায়ী না হলেও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা টিকা নেওয়ার ওই অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিন মনে রাখতে পারবে বলেই তার বিশ্বাস। সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে ভাইরাসের সংস্পর্শে এলেও একটি মাত্রায় তার বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে পারবে।
‘লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন’ এর সংক্রামক রোগ ও মহামারীবিদ্যার অধ্যাপক ড. ডেভিড হেইম্যানের ধারণা, কোভিড পরিস্থিতি এখন প্যানডেমিক (মহামারী) থেকে এনডেমিকে (সার্বজনীন রোগ) পরিণত হওয়া পথে রয়েছে।
সম্প্রতি ভারতে করোনাভাইরাস যেভাবে ছড়িয়েছে, তাতে তার ধারণা, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই হয়ত এ রোগ থেকে যাবে। তবে ভবিষ্যতে এর ভয়াবহতার মাত্রা হয়ত কমে আসবে।
ডা. হেইম্যানের যুক্তি, বেশি সংখ্যায় মানুষের আক্রান্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি গড়ে উঠছে। এছাড়া টিকা দেওয়ার গতিও বাড়ছে, তাই ভবিষ্যতে প্রাদুর্ভাব দেখা গেলেও ব্রাজিল কিংবা ভারতের মতা বিপর্যয় হয়ত ঘটবে না।
‘সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’ এর ‘এপিডেমিলোজি ইনটেলিজেন্স সার্ভিস’ এর সাবেক সদস্য এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ডেভিড হেইম্যানের ভাষায়, মানব সমাজে আগে অনেক রোগের ক্ষেত্রে যেমন দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও সেই স্বাভাবিক পরিণতিই হয়ত দেখা যাবে।
“অনেকটা যক্ষ্মা কিংবা এইচআইভির মত। আমরা এখন এসবের মাঝেই বসবাস করতে শিখে গেছি এবং এসবের ঝুঁকি কিভাবে যাচাই করতে হয় এবং কীভাবে প্রতিরোধ করতে হয় সেসব আমরা জেনে গেছি।”
ডিউক ইউনিভার্সিটি এবং নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল হেলথ এর অধ্যাপক ড. মাইকেল মার্সনও একই ধরনের কথা বলেছেন নিউ ইয়র্ক টাইমসকে।
তার ধারণা, করোনাভাইরাসও হয়ত ভবিষ্যতে স্থানীয় সংক্রামক রোগে পরিণত হবে, যা জীবনের জন্য ততটা হুমকি হয়ে দেখা দেবে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল প্রোগ্রামস অন এইডস এর সাবেক এই পরিচালক বলেন, “বাচ্চাদের যেমন দেখা যায়, এটা হয়ত তেমন সাধারণ সর্দিজ্বরের মত হয়ে উঠবে।”