হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলো রোগীতে ভর্তি, ডাক্তার আর চিকিৎসাকর্মীরা প্রতিদিন দীর্ঘসময় কাজ করেও কুলাতে পারছেন না, ডাক পড়ছে শিক্ষানবিশ আর মেডিকেল ছাত্রদের। এরই মধ্যে মারা গেছেন শতশত স্বাস্থ্যকর্মী; যারা হাসপাতালে রোগীর সেবায় ছোটাছুটি করছেন, তাদের অনেকের বাসায় পরিবারের সদস্যরাই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত।
Published : 20 May 2021, 09:47 AM
এই চিত্র ভারতের, যে দেশে ১৩০ কোটি মানুষের বসবাস। এই চিত্র স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারীর, যখন বিশ্বের অনেক দেশের মত ভারতের স্বাস্থ্য খাতেরও দুর্বলতাগুলোও ফুটে বেরোচ্ছে বিকট চেহারা নিয়ে।
চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মীরা এমন এক ভয়ঙ্কর লড়াইয়ের মধ্যে নিজেদের আবিষ্কার করছেন, যেখানে লোকবলের সঙ্কট তীব্র, বরাদ্দও অপ্রতুল।
এর মধ্যেই সংক্রমণের বিপদ ঘাড়ে নিয়ে তাদের লড়তে হচ্ছে; মহামারীর ভয়াবহ বিস্তার আর সরকারের অব্যবস্থাপনা তাদের অসহায় পরিস্থিতিতে প্রতিদিন নিদারুণ শ্রম দিয়ে যেতে বাধ্য করছে। দিনের পর দিন তাদের এমন সব নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে, যার ওপর নির্ভর করছে কোন রোগী বাঁচবে, আর কে মরবে।
যখন কোনো শয্যা খালি নেই, হাসপাতালের গেইটে যখন বহু রোগী ভর্তি হওয়ার আশায় অপেক্ষ করছে- এই স্বাস্থ্যকর্মীদের তখন সিদ্ধান্ত নিতে হয়- কাকে আগে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হবে। অক্সিজেনের মজুদ যখন ফুরিয়ে আসে, তখন তাদের বেছে নিতে হয়- মুমূর্ষু রোগীদের মধ্যে কে পাবেন ওই অমূল্য সম্পদ।
কঠিন এই লড়াইয়ের মধ্যে অনেক রোগীর প্রাণ বাঁচানো যাচ্ছে না, তাদের চিকিৎসায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের মনের বোঝা কেবলই বাড়ছে।
সেই ভার কতটা অসহনীয়, নয়াদিল্লির সবচেয়ে বড় কোভিড-১৯ হাসপাতালে মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. ম্রাদুল কুমার দাগার কথায় তা স্পষ্ট।
“সারা জীবন ধরে আপনি নিজেকে প্রস্তুত করলেন শুধু একটা লক্ষ্যের জন্য, যেভাবে হোক, রোগীকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু এখন যদি আপনাকে বেছে নিতে হয় যে কাকে আগে বাঁচাবেন, অবস্থাটা একবার শুধু কল্পনা করুন।
“একজন চিকিৎসককে যখন এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তার চেয়ে হৃদয়বিদারক আর কিছু তার জন্য হতে পারে না। গত তিন সপ্তাহ ধরে আমাকে সেই কাজটাই করতে হচ্ছে।”
মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতজুড়ে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। মৃত্যুর এই তালিকায় থাকছেন সামনের সারিতে থাকা চিকিৎসাকর্মীরাও।
ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জা জয়লাল জানান, গত বছর কোভিড-১৯ মহামারী শুরুর পর থেকে এক হাজারের বেশি চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে এ রোগে। এর এক চতুর্থাংশেরই মৃত্যু হয়েছে এপ্রিলের শুরু থেকে গত দেড় মাসের মধ্যে।
তার অনুমান, ভারতের চিকিৎসকদের মধ্যে অন্তত ৪০ শতাংশ এরইমধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের বিষয়ে সাম্প্রতিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এমন এক স্বাস্থ্য পরিকাঠামোতে ভারতের স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজ করতে হয়, যেখানে সুযোগ-সুবিধা অপর্যাপ্ত এবং বৈষম্যও প্রকট। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ জিডিপির ৩.৫ শতাশ, যা বিশ্বের গড় হিসাবের অর্ধেক।
স্থানীয় প্রভাবশালীদের চোটপাট, এমনকি হামলার মুখেও স্বাস্থ্যকর্মীদের পড়তে হয় অনেক সময়। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, রোগীর পরিবারের ক্ষুব্ধ সদস্যরা একজন স্বাস্থ্যকর্মীকে হাসপাতালের হলে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলেছেন।
জয়লাল বলেন, “যারা হাসপাতালে রোগী নিয়ে আসেন, তাদের সবাই উত্তেজিত থাকেন। খুব সামান্য বিষয়ও বড় মারামারিতে গড়ায় এবং লোকজন পরিস্থিতি বুঝতে চায় না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাস্থ্যকর্মীদের সবকিছু মানিয়ে নিতে বলা হয়।”
কিন্তু স্বাস্থ্যকর্মীদের যখন নিজের চোখের সামনে তার সহকর্মীর মৃত্যু দেখতে হয়, যে মৃত্যু হয়ত এড়ানো যেত, এর চেয়ে অসহায় পরিস্থিতি আর হতে পারে না।
মে মাসের শুরুতে একদিন দিল্লির বাত্রা হাসপাতালে অক্সিজেন ফুরিয়ে যায়, নতুন সরবরাহ পেতে পেতে লেগে যায় ৮০ মিনিট। ওই সময়ের মধ্যে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন ১২ জন রোগী। তাদের মধ্যে ছিলেন ওই হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের প্রধান ডা. আর কে হিমথানি।
স্ত্রীসহ নিজে আক্রান্ত হওয়ার আগে ১৪ মাস এই চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে গেছেন।
ওই হাসপাতালের পরিচালক ডা. শিব চরণ লাল গুপ্তের সঙ্গে ডা. হিমথানির ৩০ বছরের বন্ধুত্ব। হাসপাতালের অক্সিজেন যখন ফুরিয়ে আসছিল, ডা. গুপ্ত তখন হলওয়ে ধরে ছোটাছুটি করছিলেন, আর সরকারি কর্মকর্তা ও গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে সহায়তার আবেদন জানাচ্ছিলেন।
ডা. হিমানথির মরদেহ যখন বের করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তার দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা মাস্ক আর অ্যাপ্রন পরা অবস্থায় জড়ো হন হাসপাতাল গেইটে। বুকে হাত বেঁধে, অশ্রুসজল চোখে তারা শেষ বিদায় জানান। সেখান থেকেই তাদের ফিরে যেতে হয় হাসপাতালের কাজে।
ডা. গুপ্ত বলেন, “অক্সিজেন পরে এল, কিন্তু আমার বন্ধুসহ ১২ জনকে আর বাঁচানো গেল না। সেদিন থেকে ভেতরটা খুব খালি খালি লাগে, খুব অসহায় মনে হয়। আমি অনেকদিন ঘুমাতেও পারিনি।”
ভারতে স্বাস্থ্যখাতের লোকবল সঙ্কট নতুন কিছু নয়। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুয়ায়ী, এই দেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক, নার্স ও ধাত্রীসহ মাত্র ১৭ জন স্বাস্থ্যকর্মী আছেন, যেখানে ৪৪.৫ জন দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী থাকা দরকার।
আর এলাকাভেদে স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যাতেও আছে বৈষম্য। যেখানে ভারতের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ গ্রামে থাকে, সেখানে স্বাস্থ্যকর্মীদের ৬০ শতাংশই কাজ করেন শহরে।
বিহার ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্যগুলোর একটি। সেখানে প্রতি হাজার মানুষের জন্য হাসপাতালের বিছানা আছে ০.২৪টি, যা বিশ্বের গড় হিসাবের ১০ ভাগের এক ভাগ।
এ রাজ্যের রোহতাস জেলার একটি সরকারি হাসপাতালে কাজ করেন নার্স লাচমি কুমারী। ৮০ শয্যার এই হাসপাতাল কোভিড-১৯ আক্রান্ত জটিল রোগীতে ভর্তি।
লাচমি বলেন, “আমি চোখ বন্ধ করলেও মনে হয় কেউ আমাকে সাহায্যের জন্য ডাকছে। যখন একটু ঘুমানোর সুযোগ পাই, তখনও দেখি চারপাশে শুধু মানুষ, সবাই সাহায্য চাইছে। ওই তাগিদই এখনও আমাকে সচল রেখেছে।”
বিহারের রাজধানী পাটনার একটি সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. লোকেশ তিওয়ারি জানান, কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের অর্ধেকই পরিবারের কোনো না কোনো সদস্যকে হারিয়েছেন এ রোগে।
তিনি জানান, এ হাসপাতালের ৪০০ সাধারণ শয্যা আর নিবিড় পরিচর্যার ৮০টি শয্যায় সবসময়ই রোগী থাকছে। চাপ সামলাতে গিয়ে চিকিৎসক ও নার্সদের অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন। হাসপাতালের পক্ষ থেকে তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের কাউন্সেলিং করতে হচ্ছে।
“যখন দেখবেন কেউ স্বাভাবিকভাবেই হাঁটাচলা করছিল, অথচ ধপ করে পড়ে যাচ্ছে এবং ঘণ্টাখানেকের মধ্যে মারা যাচ্ছে, তার প্রভাব আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর পড়বে।”
মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে চিকিৎসাকর্মীদের মৃত্যুর মধ্যে কর্মী সঙ্কট ঘোচাতে সম্প্রতি ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ ঘোষণা করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ও শেষবর্ষের শিক্ষার্থীদেরও তিনি কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় কাজে লাগাতে নির্দেশ দিয়েছেন কর্মকর্তাদের। তাদের আর্থিক প্রণোদনাসহ ভবিষ্যতে সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথাও বলেছেন।
মোদীর নিজের রাজ্য গুজরাটের আনান্দ জেলার ২২ বছর বয়সী শিক্ষানবিশ চিকিৎসক আলিশা আখানিকেও এখন কোভিড রোগীদের সেবায় কাজ করতে হচ্ছে।
তার ভাষায়, “টর্নেডো যখন একদম চরমে, আমাদেরকে তার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। সময়টা কঠিন, আর সবকিছু অনিশ্চিত। তবে এর মাধ্যমে আমরা হয়ত ভালো চিকিৎসক হয়ে উঠব।”
৪০ শয্যার আইসিইউতে বেশিরভাগ সময় রাতের পালার দায়িত্বে থাকেন আখানি। সকাল ৮টায় বের হয়ে সোজা হস্টেলে ফিরে গোসল, তারপর নাস্তা সেরে ঘুম।
আবারও হাসপাতালে ডিউটি শুরুর আগে মাথা থেকে সব মুছে ফেলতে গান শোনেন, নয়তো ব্যাডমিন্টন খেলেন কিংবা ব্যায়াম করেন। এক বছরের শিক্ষানবিশ পর্ব শেষে পরীক্ষায় বসার জন্য পড়ালেখার সময়ও তাকে বের করতে হয়।
তিনি জানান, কোনো কোনো রাতে পাঁচজন রোগীও মারা যায়। রাত জেগে দায়িত্ব পালন করে ভোরের দিকে যখন মানসিক শক্তি ক্ষয়ে যায়, তখন কোনো রোগীর মৃত্যু মেনে নেওয়াও খুব কঠিন।
কখনো কখনও খুব কাছের মানুষেরও মৃত্যু হয়। একবার ৫০ বছর বয়সী এক আত্মীয়ার অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে আখানি তার স্বামীকে ফোন করেন।
“আমরা নিশ্চিত ছিলাম না তিনি রাতটা পার করতে পারবেন কিনা। উনার স্বামীকে ফোন দিয়ে জানাতে হল, তিনি হয়ত টিকবেন না, ভালো হয় আপনি বাচ্চাদের কাছে ডেকে যদি এই সময়টা পরিবারের সঙ্গে থাকেন।”
কখনো কখনো পরিবারের লোকজন একান্ত স্বজনকে শেষ বিদায় জানাতেও চিকিৎসকদের সহায়তা চান।
৪৮ বছর বয়সী মনোবিদ ও সংগীতের শিক্ষক সংঘমিত্র চট্টোপাধ্যায় যখন কলকাতার একটি হাসপাতালে শুয়ে মৃত্যুর দুয়ারে, তার ছেলে সোহাম চট্টোপাধ্যায় চিকিৎসকদের অনুরোধ করছিলেন, তারা শেষবার অন্তত ভিডিও কলে মায়ের সঙ্গে তাকে কথা বলিয়ে দিতে পারবেন কি না।
ডাক্তাররা তার সেই ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন। সংঘমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ঘিরে ছিলেন নার্সরা। চিকিৎসক যখন কল দিলেন, সোহাম চট্টোপাধ্যায় তার মায়ের জন্য সত্তর দশকের হলিউডের একটি গান গেয়ে শোনালেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। সোহামের যখন মন খারাপ থাকত, ওই গানটাই যে তার মা তাকে গেয়ে শোনাতেন!
অনেকবার বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানে কিংবা খাবার টেবিলেও তারা মা-ছেলে একসঙ্গে গেয়েছেন ওই গান। সেই গানের কথাগুলো এরকম- ‘আজ সন্ধ্যায় কথা দিলাম, আমাদের দেখা হবে বার বার।’
সেদিন ভিডিও কলে মায়ের সঙ্গে সোহামের শেষ দেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ডা. দীপশিখা ঘোষ। এক টুইটে তিনি বলেছেন সেদিনের কথা।
“আমি ফোনটা ধরে দাঁড়িয়েছিলাম, তার দিকে এবং তার মায়ের দিকে দেখছিলাম, আমিও গাইছিলাম তাদের সঙ্গে।
“পরে তিনি (সোহাম) জানতে চাইলেন মায়ের শেষ অবস্থা কী, আমাকে ধন্যবাদ দিলেন, তারপর ফোন কেটে দিলেন।”