জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘অবমাননা’ এবং মুক্তিযুদ্ধের ‘ইতিহাস বিকৃতির’ অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদকে সব ধরনের অ্যাকাডেমিক কাজ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন।
রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় এই সিদ্ধান্তে নেওয়া হয় জানিয়ে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “সম্প্রতি অবসর প্রস্তুতি ছুটিতে (পিআরএল) যাওয়া অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ধরনের অ্যাকাডেমিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারবেন না।“
এর আগে একই অভিযোগে এই অধ্যাপককে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি প্রশাসনিক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল।
তার লেখা ‘হিস্টোরাইজিং ১৯৭১ জেনোসাইড: স্টেট ভার্সেস পারসন’ বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের ‘ইতিহাস বিকৃতির’ অভিযোগ ওঠায় তা তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় একটি কমিটি গঠন করেছিল গত এপ্রিল মাসে।
তদন্ত শেষে ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননা এবং মুক্তিযুদ্ধের ‘ইতিহাস বিকৃতির’ অভিযোগের ‘প্রমাণ’ পাওয়ার কথা জানায় তদন্ত কমিটি।
নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেটের সভায় কমিটি তাদের রিপোর্ট পেশ করে। ওই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অধ্যাপক ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে আরও ‘কঠোর’ সিদ্ধান্ত নিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
রিপোর্টে তদন্তের বিভিন্ন দিক ও ফলাফল তুলে ধরার পাশাপাশি লেখক ইমতিয়াজ আহমেদ এবং প্রকাশক ইউপিলের কাছে অবিলম্বে বইটি প্রত্যাহারের আহ্বান রাখা হয়েছে।
সেই সঙ্গে জাতির পিতাকে অবমাননাকারী এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির সঙ্গে জড়িত ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতেও সরকারে কাছে সুপারিশ রেখেছে কমিটি।
কি আছে বিজ্ঞপ্তিতে
সিন্ডিকেট মনে করে, ইমতিয়াজ আহমেদের বইয়ে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পরিবেশিত কিছু তথ্য ‘অসত্য, বিভ্রান্তিকর ও ইতিহাসের বিকৃতি’।
সভায় ওই বইয়ে ‘অসত্য তথ্য পরিবেশন ও ইতিহাস বিকৃতির’ তীব্র নিন্দা জানানো হয়।
বইটির লেখক ইমতিয়াজ আহমেদ এবং প্রকাশক ইউপিএলকে অবিলম্বে বইটি প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য সিন্ডিকেট সভা থেকে আহ্বান জানানো হয়।
সেই সঙ্গে ‘বঙ্গবন্ধুকে অবমাননাকারী এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির সঙ্গে জড়িত ও সংশ্লিষ্টদের’ বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়।
অভিযোগের সূত্রপাত
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক একটি নিবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ইমতিয়াজের লেখা ২০০৯ সালে প্রকাশিত বইটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তোলেন।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপসারণ এবং একটি উচ্চ ক্ষমতার তদন্ত কমিটি গঠন করে তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি ওঠে এরপর।
ওই দাবিতে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ, বিচারপতি মানিকও তাতে যোগ দিয়েছিলেন।
এছাড়া অধ্যাপক ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছিল বঙ্গবন্ধু পরিষদ।
তবে অধ্যাপক ইমতিয়াজ ১৪ বছর আগে লেখা তার ওই বই নিয়ে তোলা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। তার ভাষ্য, বইটি ‘ভুলভাবে’ পড়া হয়েছে।
এ বিষয়ে এক বিবৃতিতে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, “বইয়ের কোথাও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অসম্মান বা অশ্রদ্ধা প্রদর্শন হতে পারে- এমন একটি শব্দও নেই। এমনটি হতে পারে যে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বিষয়ে আমার একটি মন্তব্যের সুযোগ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে।”
বিভিন্ন মহলের দাবির প্রেক্ষিতে অভিযোগ তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড লিবার্টির পরিচালক অধ্যাপক ফকরুল আলমকে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।
সেই কমিটির প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগেই অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদকে তার আবেদনে সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
একইসঙ্গে অফিস অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাকে।
মুচলেকার শর্তে বিএনপিপন্থী শিক্ষককে ক্ষমা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বিএনপিপন্থী শিক্ষক সংগঠনের নেতা এ এস এম আমানুল্লাহর ফেইসবুক পেইজে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক নিয়ে একটি ‘মনগড়া ও ভিত্তিহীন’ পোস্টের বিষয়ে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন জিয়া রহমানের একটি প্রতিবেদনও রোববারের সিন্ডিকেট সভায় উত্থাপন করা হয়।
পরে সভায় মুচলেকার শর্তে আমানুল্লাহর ক্ষমার আবেদন মঞ্জুর করা হয়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সিন্ডিকেট সভা মনে করে, এ এস এম আমানুল্লাহর ফেইসবুক পোস্ট পাঠ্যপুস্তক, সরকারের শিক্ষানীতি ও ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করার একটি অপপ্রয়াস।
তিনি ইতোমধ্যে তার কাজের জন্য দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন৷ ভবিষ্যতে এ ধরনের ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ড ও আচরণ’ করবেন না- এই মর্মে লিখিত মুচলেকা দেওয়ার শর্তে তার ক্ষমাপ্রার্থনার আবেদন সভায় মঞ্জুর করা হয়েছে।