ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ‘ঘ’ ইউনিটের দায়িত্ব যাদের, সেই সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, তাদের মতামত না নিয়েই এই ইউনিট বাতিল করেছে কর্তৃপক্ষ।
Published : 08 Feb 2022, 10:48 PM
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষকদের অভিযোগ, উপাচার্য ডিনস কমিটি ও ভর্তি কমিটির আলোচনাকে সিদ্ধান্ত হিসেবে চালিয়ে দিয়েছেন।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বর্তমান ডিন অধ্যাপক জিয়া রহমান এনিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি না হলেও সাবেক ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম ব্যাপক ক্ষোভ জানিয়েছেন।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের দাবি, যথাযথ প্রক্রিয়ায়ই ‘ঘ’ ইউনিট বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ভর্তি কমিটির সভা শেষে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক আগামী ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের প্রথম বর্ষ স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির ভর্তিতে ক, খ, গ ও চ এই চার ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে। অর্থাৎ ঘ ইউনিট থাকছে না।
এমন সিদ্ধান্তে প্রশ্ন তুলে অধ্যাপক সাদেকা হালিম মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কবে এই সিদ্ধান্ত হল?”
তার ভাষ্য, ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর ডিনস কমিটির এক সভায় উপাচার্য বিভাগ পরিবর্তনের ঘ ইউনিট এবং চারুকলা অনুষদভুক্ত চ ইউনিট বাতিলের প্রস্তাব করেছিলেন।
“সভার শেষ দিকে এটা এজেন্ডা হিসেবে নিয়ে আসা হয়েছিল। তখন আমি ঘ ইউনিট রাখার যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিলাম। বলেছিলাম, অনুষদের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে আলোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
এরপর তৎকালীন ডিন সাদেকা হালিম অনুষদের ১৬টি বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি সভা করে ‘ঘ’ ইউনিট বাতিল না করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের মতামত তুলে ধরেছিলেন।
সাদেকা হালিমের দাবি, তাদের এই মতামত কোনো সভায় উপস্থাপনা ছাড়াই পরে অনুষ্ঠিত ভর্তি কমিটির সভার আলোচনাকে সিদ্ধান্ত হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এবিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডিনস কমিটির সভার পর ভর্তি কমিটির সভার সুপারিশের আলোকে একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় ঘ ইউনিট বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে।”
এই সিদ্ধান্তের প্রমাণ দেখতে তিনি রেজিস্ট্রার ভবনে যোগাযোগ করে বিস্তারিত জানতে বলেন।
প্রশাসনিক বা রেজিস্ট্রার ভবন থেকে প্রাপ্ত নথিতে দেখা যায়, ৮ নভেম্বর ডিনস কমিটির সভার পর ২৩ নভেম্বর ভর্তি কমিটির সভায় ‘ঘ’ ইউনিট বাতিলের সুপারিশ করা হয়। পরে ২০২১ সালের ১৮ অগাস্ট একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় ঘ ইউনিট বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়।
এনিয়ে সাদেকা হালিম বলেন, “একাডেমিক কাউন্সিলে ঘ ইউনিট বাতিলের কোনো কথাই হয়নি। একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় আমাদের অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা ছিলেন। তারা কেউ জানেন না যে, তখন ঘ ইউনিট বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে।”
অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এম আকাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘ ইউনিট বাতিলের প্রস্তাব করেছিলেন উপাচার্য। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন এবং তার অধীনে যে বিভাগগুলো আছে, সেই বিভাগের চেয়ারম্যানদের নিয়ে এর আগে একটা মিটিং হয়েছিল। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে এটা রাখতে হবে।
“কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, ঘ ইউনিট থাকছে না ।এ ধরনের সিদ্ধান্ত সকালের সাথে আলোচনা করে নেওয়া উচিৎ, একতরফা করা উচিৎ নয়। আমরা রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু দুঃখজনক এটা হচ্ছে না।”
সাবেক ডিন সাদেকা হালিম বলেন, “ঘ ইউনিট বাতিলের বিষয়ে আমাকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের ’ক ইউনিটে, মানবিকের শিক্ষার্থীদের ‘খ’ ইউনিটে, বাণিজ্যের শিক্ষার্থীদের ‘গ’ ইউনিট, বিভাগ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ’ঘ’ ইউনিট এবং চারুকলার জন্য ’চ’ ইউনিটের মাধ্যমে পরীক্ষা নেওয়া হত।
আগে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিকের শিক্ষার্থীরা ‘ঘ’ ইউনিটে পরীক্ষা দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের বিভাগ পরিবর্তন করতে পারতেন।
বিরোধিতা যে কারণে
ঘ ইউনিট বাতিল করা হলে মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখার শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ সঙ্কুচিত হবে বলে মনে করেন যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের চেয়ারপারসন তাওহিদা জাহান।
তিনি বলেন, “ঘ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষা না হলে মানবিক ও ব্যবসায় শাখার শিক্ষার্থীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল একটি পরীক্ষার মাধ্যমে ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়ে যায়, যা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। কোনো কারণে যদি মানবিক ও ব্যবসায় শাখার কোন শিক্ষার্থী খ বা গ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা দিতে না পারেন অথবা অসুস্থতাজনিত বা যে কোনো কারণে পরীক্ষা খারাপ হয়ে যায়, তাহলে মেধাবী কোনো শিক্ষার্থীরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্ন বাতিল হয়ে যাবে।
“অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগও নাই। তাই ঘ ইউনিট বাতিলের মাধ্যমে আমাদের মানবিক ও ব্যবসায় শাখার ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ এভাবে সঙ্কুচিত করার আগে আমাদের মনে হয় আরেকটু ভাবার দরকার আছে।”
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজিম উদ্দিন খান বলেন, “ঘ ইউনিট বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়াটা খুবই অগণতান্ত্রিক। যারা ঘ ইউনিটের স্টকহোল্ডার (সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষক-শিক্ষার্থী) তাদের সাথে কোনো আলোচনা না করে উপর থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এটা আসলে আমার কাছে খুব ভালো একটা বার্তা দেয় না।
“সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের একটা বিশেষত্ব আছে। তাদের প্রশ্নের মান এবং যে ধরনের শিক্ষার্থী আমরা চাই, সেটা চিন্তা করেই কিন্তু আমরা পরীক্ষাটা নিয়ে থাকি। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের পরীক্ষার যে সুনাম, সেটা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ ছিল।”
ঘ ইউনিট বাতিলের খবরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নানা প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খোরশেদ আলম ফেইসবুকে লিখেছেন, “আগে শিক্ষার্থীরা দুইবার ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারত। এখন মাত্র একবার! পরের বার ঘ ইউনিটটাও নাই হয়ে গেল! এভাবে শিক্ষার্থীদের সুযোগ সংঙ্কুচিত করার সিদ্ধান্ত কতটা বিবেচনাপ্রসূত?”
‘ঘ’ ইউনিট বাতিলের সিদ্ধান্তে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীরাও ক্ষোভ জানাচ্ছেন।
নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. সজীব বলেন, “অনেক শিক্ষার্থী সমাজ ও পরিবারের চাপে পড়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসএসসি ও এইসএসসিতে বিজ্ঞান কিংবা বাণিজ্য বিভাগে পড়ে। কিন্তু তাদের ইচ্ছা ছিল সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের কোনো বিভাগে পড়া। ‘ঘ’ইউনিটের মাধ্যমে তা সম্ভব হত। এই ইউনিট বন্ধ হয়ে গেলে অন্য ইউনিটের শিক্ষার্থীরা এই সুযোগ নাও পেতে পারে।”
বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থী নিলয় কুমার বিশ্বাস বলেন, “আমার মতো যেসব শিক্ষার্থী বিভাগ বা ইউনিট পরিবর্তন করতে চায়, ঘ ইউনিট বাতিল হলে সেই পথ বন্ধ হয়ে যাবে।”
সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাদিয়া তাসনিম বলেন, “শুনেছি ঘ’ইউনিটের মাধ্যমে যারা অন্য বিভাগে ভর্তি হতে চায়, তাদের অন্যভাবে নেওয়া হবে। তবে সেটা কীভাবে হবে, সেটিই এখন প্রশ্ন।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঘ ইউনিট বাতিল হলেও বিভাগ পরিবর্তনের সুযোগ থাকবে।
“কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভর্তি পরীক্ষা একই প্রশ্ন পদ্ধতিতে হয়। আইন অনুষদেও খ ও ঘ ইউনিট থেকেই শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়। সেক্ষেত্রে আমরা বলেছি, দুটি আলাদা ইউনিট না রেখে তিনটি অনুষদের সমন্বয়ে একটি ইউনিট হবে। রোটেশন আকারের একেক বছর একেক অনুষদের ভর্তি পরীক্ষা পরিচালনা করবে। যেমনটা ক ইউনিটে বিজ্ঞানের পাঁচটি অনুষদ পরীক্ষা নিয়ে থাকে।”
কীভাবে শিক্ষার্থী বিভাগ পরিবর্তন করতে পারবে- প্রশ্নে তিনি বলেন, তার একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে কলা অনুষদের ডিনকে প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়েছে। আগামী একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় তা পেশ করা হবে।