তবে এই সময়ে এসে শিক্ষা ও গবেষণায় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে পুরান ঢাকার এই বিশ্ববিদ্যালয়। বুধবার সরকারি ছুটি থাকায় এবারের বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালন করা হবে পরেরদিন।
বৃহস্পতিবার সোয়া ১১টা দিকে ক্যাম্পাসে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতার উদ্বোধন করবেন উপাচার্য অধ্যাপক ইমদাদুল হক।
তবে মহামারীর কারণে ‘ভার্চুয়াল’ আলোচনা সভায় সীমিত থাকবে এবারের বিশ্ববিদ্যালয় দিবস।
২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হলেও ছাত্রাবাসসহ অন্যান্য সুবিধা না থাকায় নিয়মিত আন্দোলন করে এসেছে শিক্ষার্থীরা।
লাগাতার আন্দোলনের পর ২০১৪ সালে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রী হল নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এটাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী হল। লিয়াকত এভিনিউয়ের সেই হলে শুরু হয়েছে শিক্ষার্থী তোলার কার্যক্রম।
প্রায় ২০০ একর জমির ওপর এক হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকার এ প্রকল্প ২০২০ সালের অক্টোবরের মধ্যে বাস্তবায়ন করার কথা ছিল।
নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পুরনো ক্যাম্পাস ছাড়তে হবে, এমন খবরে সে সময় ক্যাম্পাসে সরব হয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিপূর্ণ সুবিধা পেতে ক্যাম্পাস সম্প্রসারণে সমর্থন থাকলেও, ঐতিহ্য আর ইতিহাসের সাক্ষী বর্তমান ক্যাম্পাস তারা হারাতে চান না।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আরিফুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিভিন্ন সময় শুনি আমাদের এই ক্যাম্পাস থাকবে না; ছেড়ে চলে যেতে হবে। খারাপ লাগে আসলে, ক্যাম্পাসটার সাথে আবেগ জড়িয়ে গেছে। একে একে তো সবই হারাচ্ছি। খেলার মাঠটাতেও বোধহয় আর যেতে পারব না।”
তবে হলে ওঠার কার্যক্রম শুরু হওয়ায় খুশি লোকপ্রশাসন বিভাগের নৈশি ইসলাম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সেই কবে থেকে দেখে আসছি হল হচ্ছে; অনেকদিন কাটিয়ে দিলাম মেসে মেসে। অবশেষে আমাদের হলে থাকার সুযোগ হচ্ছে। এতদিনের কষ্ট এবার দূর হবে।”
শতবর্ষী জগন্নাথ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হওয়ার পর আইন অনুযায়ী নিরীক্ষা করে বিলুপ্ত কলেজের যে সম্পত্তির হিসাব বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া হয়, তার অধিকাংশই তখন বেদখলে।
ক্যাম্পাসের সীমানার বাইরে কেবল ধূপখোলার খেলার মাঠটিকেই নিজেদের কর্তৃত্বে পেয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত শতকের আশির দশকে এই মাঠটিকে জগন্নাথ কলেজের নামে বরাদ্দ দেন সে সময়ের রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মাদ এরশাদ।
তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এখন সাড়ে সাত একর আয়তনের মাঠটিকে নিজেদের সম্পত্তি দাবি করে সেখানে মার্কেট তৈরির কাজ শুরু করেছে।
মাঠ রক্ষায় শিক্ষার্থীরা মাঠে নামলেও তাতে সফলতা আসেনি, যেমন হয়েছিল হল আন্দোলনে।
পরিসংখ্যান বিভাগের দশম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এখানে নিয়মিত খেলতে আসি। বিশ্ববিদ্যালয়ও দীর্ঘদিন এটি ব্যবহার করে আসছে। তারপরও সিটি করপোরেশন এখানে মার্কেট বানায় কী করে?
“বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আমরা মাঠ রক্ষার দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি আমাদের দাবি, অবিলম্বে এ কাজ বন্ধ করে আমাদের মাঠ আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হোক।”
একটি ছাত্রী হল হওয়ায় আবাসিক হল না থাকার অপেক্ষা ঘুচলেও পুরোনো হলগুলো সংস্কারের দাবি পূরণ হয়নি।
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী রিফাত হাসান বলেন, “আমাদের কেরানীগঞ্জের ক্যাম্পাস কবে হবে, ততদিন তো আমরা অপেক্ষা করতে পারি না। খুব কষ্টে থাকতে হচ্ছে আমাদের। আমাদের হলগুলো উদ্ধার করে সংস্কার করা হোক। একটা বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন ধরে হল ছাড়া থাকতে পারে না। আর পুরান হলগুলো আমাদের সম্পত্তি, সেগুলো উদ্ধারে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাই।”
বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের কয়েক দফা আন্দোলনের মুখে হল উদ্ধারে সরকার একাধিক কমিটি গঠন করলেও বেদখল হওয়া ১১টি হলের মধ্যে দুটি ছাড়া বাকিগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ষোড়শ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে উপাচার্য অধ্যাপক ইমদাদুল হক ‘সমসাময়িক যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জনের’ প্রত্যাশার কথা বললেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “শিক্ষা ও গবেষণার অগ্রগতির জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথভাবে কাজ করতে আমরা চুক্তি করেছি। আমরা এবারের বাজেটেও শিক্ষায় বেশি জোর দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও শিক্ষার মান বাড়ানোই এর উদ্দেশ্য। ভবিষ্যতে এটি আরো বৃদ্ধি পাবে।”
কেরানীগঞ্জের ক্যাম্পাসের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ভূমি অধিগ্রহণ করতেই অনেক সময় চলে গেছে। এখন আমরা মাস্টারপ্ল্যানের কাজ করব। ২০২৩ সাল পর্যন্ত আমাদের প্রকল্পের মেয়াদ আছে। এর আগেই আমরা চেষ্টা করব যত বেশি কাজ করে নেওয়া যায়।”
তিনি বলেন, “আমরা বসে নেই। আমরা আমাদের নিজেদের জায়গাতেই মাঠ তৈরি করব। তারপরও মাঠটি রক্ষায় আামরা চেষ্টা অব্যাহত রাখছি।”
আর হল উদ্ধারের চেষ্টা নিয়ে তার উত্তর: “হলের কোনো কাগজপত্র ছিল না জগন্নাথের পক্ষে। বিভিন্ন মানুষ আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে সেগুলো নিয়ে নিয়েছে।”
ব্রাহ্ম স্কুল থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ব্রাহ্ম ধর্ম সম্পর্কে সাধারণ ছাত্রদের জানাতে আরমানিটোলায় ব্রাহ্ম সমাজের নিজস্ব প্রাঙ্গণে ১৮৫৮ সালে চালু হয় অবৈতনিক ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল।
আর্থিক সঙ্কটে ১৮৭২ সালে ব্রাহ্ম স্কুলের ভার তুলে দেওয়া হয় বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর হাতে, পরে জমিদারের বাবার নামে তা ‘জগন্নাথ স্কুল’ নাম পায়।
এরপর উপমহাদেশের পুরনো এ বিদ্যাপীঠের দেড় শতকের পথচলা চিত্তরঞ্জন এভিনিউয়ের বর্তমান ঠিকানাতেই।
১৮৮৪ সালে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্বিতীয় ও ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণির কলেজে উন্নীত হয়। ১৮৮৭ সালে ‘কিশোরীলাল জুবিলি স্কুল’ নামে স্কুল শাখাকে জগন্নাথ কলেজ থেকে আলাদা করা হয়, যা এখন কে এল জুবিলি স্কুল নামে পরিচিত।
১৯২০ সালে ইন্ডিয়ান লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ‘জগন্নাথ কলেজ আইন পাস করে। তবে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর জগন্নাথ কলেজের স্নাতক কার্যক্রম বন্ধ করে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত শিক্ষা সীমিত করা হয়।
১৯৪২ সালে মেয়েদেরও জগন্নাথ কলেজে ভর্তির সুযোগ হয়। পরে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের সুযোগ দিতে জগন্নাথ কলেজে নৈশকালীন পাঠদান শুরু হয়।
১৯৬৮ সালে জগন্নাথকে সরকারি (প্রাদেশিকীকরণ) করা হয়, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফায় এর বিরোধিতা করলে ওই বছরই কলেজটি আগের অবস্থায় ফিরে যায়।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জগন্নাথ কলেজকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে উন্নীত করা হয়।
২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাসের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যাপীঠকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়।
আরও পড়ুন