‘গ্যাংআপে’ শুধু অ্যাপের অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই যুক্ত হতে পারবেন।
Published : 16 Mar 2025, 01:30 AM
দেশের আইনশৃঙ্খলার অস্থির অবস্থায় মানুষ যখন নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত, সেই সময় শিক্ষার্থীদের নিরাপদ যাতায়াতের বিষয়টি নিয়ে ভাবনায় পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া চার তরুণ। সেই ভাবনা থেকে গাঁটের টাকা খরচ করে এক সপ্তাহের চেষ্টাতেই তারা বানিয়ে ফেলেন একটি অ্যাপ- ‘গ্যাংআপ’।
এই গ্যাং হল নির্দিষ্ট ক্যাম্পাস থেকে নির্দিষ্ট এলাকায় বাসায় ফেরার জন্য শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট দল। আর এই অ্যাপে যুক্ত হয়ে মূলত শিক্ষার্থীরা নিরাপদ রাইড শেয়ার করতে পারছেন।
অ্যাপটি তৈরির পর থেকেই অভাবনীয় সাড়া পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। মাত্র ১১ দিনেই ওয়েবভিত্তিক অ্যাপটিতে যুক্ত হয়েছেন ২৫ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়ে তিন হাজারের বেশি শিক্ষার্থী।
আপাতত https://gangupnow.com/ এ ঢুকে নিজেদের গ্যাং বা গ্রুপ তৈরি করে বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতে একই যানবাহন ব্যবহারের সুবিধা পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। গ্রুপ তৈরি করতে হলে বা কোনো গ্রুপে যুক্ত হতে হলে অবশ্যই ওই শিক্ষার্থীর সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়া একটি স্টুডেন্ট ইমেইল আইডি থাকতে হবে।
‘গ্যাংআপ’ এর উদ্যোক্তা চার তরুণই কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ছেন। এর মধ্যে মাহির আব্দুল্লাহ, ফাহিম আহমেদ ও মনীষ চন্দ রুদ্র ব্র্যাক ইউনিভিার্সিটির অষ্টম সেমিস্টারে এবং শাহরিয়ার আহমেদ শোভন ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির পঞ্চম সেমিস্টারে পড়ছেন।
মঙ্গলবার রাতে গুগল মিটে একসঙ্গে কথা হয় এই চার তরুণের সঙ্গে। আলাপে তারা জানালেন, তাদের এই স্বপ্নযাত্রার পেছনের গল্প আর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা।
শাহরিয়ার আহমেদ শোভন বলেন, “দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে স্টুডেন্টদের মধ্যেও খুব একটা কনসার্ন আছে। অনেক ছিনতাই হচ্ছে, হামলা হচ্ছে। সেসব কারণে মূলত কনসার্নটা আসে। আমরা ভাবছিলাম স্টুডেন্টরা তো আনসেইফ, কী করা যায়। মাহির ভাই তখন ফাহিম ভাইয়ের সঙ্গে আইডিয়াটা শেয়ার করে।”
মাহির আব্দুল্লাহ বলেন, “আমরা মোটামুটি সেইম সার্কেল। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে পরপর কয়েকটা ঘটনা খুব প্যানিক করে। বিশেষ করে প্রকাশ্য রাস্তায় গুলি করে ছিনতাইয়ের ঘটনাটা। ২৩ ফেব্রুয়ারি আমরা সেদিন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ক্লাবের মেম্বারদের সাথে একটা আলোচনা করছিলাম। আমি সেই ক্লাবের মেম্বার। সেসময় একটা খবর স্টুডেন্টদের মাঝে ছড়ানোর পর অনেকে প্যানিকড হন। কারণ আমাদের তো অনেক সময় বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক দেরি হয়। তখন কী হবে।”
মাহির বলছিলেন, “সাধারণত দেখা যায় সাড়ে ৫টায় ক্লাস শেষ অনেকে ইউনিভার্সিটির গ্রুপগুলোতে পোস্ট দেন যে, কেউ মোহাম্মদপুর যাবে, আর কেউ যাবে কি না। এই যে ম্যানুয়ালভাবে যে বিষয়গুলো প্রসেস হচ্ছে, আমার মনে হল, একটু অটোমেটেড করা যায় কীভাবে। যাতে স্টুডেন্টদের কানেক্ট করে একটু সেইফলি বাসায় পৌঁছানো যায়। এরপর আইডিয়াটা ফাহিমের সঙ্গে শেয়ার করি। শোভনের সঙ্গে কথা বলে ফাহিম।”
“ওইদিন থেকেই আমরা কাজ শুরু করি। প্রথম কয়েকদিন অনেক কাজ করতে হয়েছিল। এটার কোনো অফিসিয়াল লঞ্চিং হয়নি। আমরা ফেইসবুকে একটা মাত্র পোস্ট করেছিলাম, ব্র্যাকের একটা গ্রুপে ১ মার্চ রাত সাড়ে ১২টায়। সারপ্রাইজিংলি, ওই পোস্টে আমরা চমৎকার সাড়া পাই। স্টুডেন্ট জেনারেশন বা জেনজি জিনিসটাকে কুল টেক হিসেবে ডিফাইন করা শুরু করেছে।”
মাহির বলেন, “আমরা আসলে একটা পরীক্ষার মত করতে চাচ্ছিলাম যে স্টুডেন্টদের প্রয়োজনটা আসলে কী। কিন্তু তাতেই অভাবনীয় সাড়া আসে। আমরা প্রথমে ১০টা বিশ্ববিদ্যালয়কে যুক্ত করে শুরু করেছিলাম। ১১ দিনেই ২৫টা বিশ্ববিদ্যালয়কে এর আওতায় আনা হয়েছে। ইউজার হয়েছে সাড়ে তিন হাজার প্লাস, গ্যাংয়ের সংখ্যা পাঁচশর বেশি।
“প্রতিদিনই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্টুডেন্টদের প্রচুর টেক্সট পাচ্ছি। তারা জানতে চায়, কবে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আমরা গ্যাংআপে যুক্ত করব। আমরা পরবর্তীতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে কানেক্ট হব। সেখানে আমাদের অনেক ইউজার হবে আশা করছি।”
অ্যাপ তৈরি করতে কী পরিমাণ কাজ করতে হয়েছে জানতে চাইলে শাহরিয়ার বলেন, “প্রথম দিকের ডেভেলপমেন্ট স্টেইজে আমাদের অনেক কাজ করতে হয়েছে। ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত সাত দিনের জার্নিটা অনেক লেনদি ছিল।
“রিলিজ দেওয়ার পর যখন ট্রাফিক আসতে থাকে প্রচুর তখনও কন্টিনিউয়াসলি অনেক কিছু করতে হচ্ছে। বেশ কয়েকবার সার্ভার চেইঞ্জ করতে হয়েছে। প্রাইভেসি কনসার্ন, সিকিউরিটি কনসার্ন ইত্যাদি নিয়ে অনেক কাজ। এখন কাজের ভলিউম একটু কম।”
যেভাবে যুক্ত হওয়া যাবে
‘গ্যাংআপে’ কেবল অ্যাপের অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই যুক্ত হতে পারবেন। সেজন্য শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়া একটি ইমেইল আইডি থাকতে হবে। সেটিকেই আপাতত শিক্ষার্থী যাচাই করার প্রধান টুল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ধরা যাক, একজন শিক্ষার্থী নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিদিন মোহাম্মদপুরে যাতায়াত করেন। তিনি ওই গ্রুপে এনএসইউ টু মোহাম্মদপুর একটা গ্যাং খুলতে পারেন। সেখানে তার যাতায়াতের সময় দিয়ে সদস্য আহ্বান করতে পারেন। কোন বাহনে তারা যাতায়াত করবেন সেটাও উল্লেখ করে দিতে পারেন।
পরে তারা নিজেদের মোটরসাইকেল বা গাড়ি, ভাড়ার অটোরিকশা বা রাইড শেয়ারিং কার ব্যবহার করে একসঙ্গে ভাড়া ভাগাভাগি করে যাতায়াত করতে পারবেন।
এতে খরচ পড়ছে কম, সহযাত্রীর সব তথ্য হাতে থাকায় বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীরা যাতায়াতে অনেক বেশি নিরাপদ বোধ করছেন।
ফাহিম আহমেদ বলেন, “এখানে ইউনিভার্সিটির ভেরিফায়েড স্টুডেন্টরাই যুক্ত হতে পারবে। যেমন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টদের একটা ইমেইল আইডি আছে। ইউজিসির নিয়ম অনুযায়ী সব ভার্সিটিতেই এখন স্টুডেন্টদের একটা করে মেইল অ্যাড্রেস বরাদ্দ দিতে হয়। ওটাকেই এখন ভেরিফিকেশন টুল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ভেরিফিকেশনের সময় ওই মেইলটাতে একটা কোড যাবে। ওই কোড দিয়ে প্রোফাইলকে ভেরিফাই করতে পারবে।”
“যখন সে (শিক্ষার্থী) গ্যাং ক্রিয়েট করবে তখন ব্র্যাকের একজন কেবল তার ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টদের সঙ্গেই গ্যাং ক্রিয়েট করতে পারবে। আমরা চিন্তা করছি অচিরেই যাতে কোনো লোকেশন বা পয়েন্টভিত্তিক গ্যাং ক্রিয়েট করা যায়।”
অ্যাপের খরচ, আয়ের ভাবনা
অ্যাপটির উদ্যোক্তারা বলছেন, এখন পর্যন্ত অ্যাপ তৈরির সব কিছুই তারা নিজেরা করেছেন, কিছু খরচ রয়েছে যেগুলো তারা নিজেরাই বহন করছেন।
এই অ্যাপ থেকে আয়ের চিন্তা আছে কি না বা এই অ্যাপের বিজনেস মডেল কী হতে যাচ্ছে জানতে চাইলে মাহির বলেন, “আমরা আসলে রেভিনিউ মডেল নিয়ে চিন্তা করিনি। আমাদের চিন্তা ছিল স্টুডেন্টদের কীভাবে সেইফ ও মডারেট ট্রাভেল প্রোভাইড করতে পারি। এতে অভাবনীয় সাড়া পেয়েছি আমরা। এখন আমরা আমাদের সিনিয়রদের সঙ্গে কথা বলছি। কয়েকজন ইনভেস্টরের সঙ্গে কথা হচ্ছে। তবে যাই হোক আমাদের মডেল থাকবে যে, আমরা স্টুডেন্টদের কাছ থেকে কখনোই টাকা নেব না।”
পরবর্তীতে ভাড়ায় গাড়ি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বা রাইড শেয়ারিং কোম্পানির সঙ্গে কোলাবরেশনে গিয়ে তারা আয়ের একটা চিন্তা করছেন।
উদ্যোক্তা মনীষ চন্দ রুদ্র বলেন, “আমাদের অ্যানালাইসিস বলছে, মানুষের কার ও অটোরিকশার প্রতি বেশি ঝোঁক। আমরা হয়ত অটোরিকশার জন্য কোনো একটা রাইড শেয়ারিং প্রোভাইডরের সাথে কানেক্ট করব বা মাল্টিপলও হতে পারে যে, তাদের থেকে অটোরিকশা সেবাটা নেব বা কার নেব।
“যাদের সঙ্গে অ্যাফিলিয়েশনে যাব তাদের কাছে আশা থাকবে তারা যেন তাদের অ্যাপের রেগুলার দামের চেয়ে স্টুডেন্টদের জন্য কম টাকায় সার্ভিসটা দেয়। যাতে স্টুডেন্টরা কম টাকায় নিরাপদে যাতায়াত করতে পারে। এটা আসলে উভয়পক্ষের জন্যই একটা উইন-উইন গেইম হবে বলে আমরা মনে করছি।”
মোবাইল অ্যাপ কবে?
আপাতত ওয়েবসাইটে চলছে ‘গ্যাংআপ’। কিন্তু অভাবনীয় সাড়া পেয়ে এ মাসের মধ্যেই অ্যান্ড্রয়েড ও অ্যাপল প্ল্যাটফর্মের জন্য অ্যাপ তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন উদ্যোক্তারা।
ফাহিম বলেন, “আমাদের প্ল্যাটফরমটা এখন অনেক স্টেবল। আমরা প্রতিনিয়ত আপডেট করছি। আমরা ইউজারদের সঙ্গে কথা বলছি, ফিডব্যাক নিচ্ছি। তাদের সাজেশন অনুযায়ী এগিয়ে যাচ্ছি।
“এখন আমাদের অ্যাপটা ওয়েব বেইজড। যদিও এখন ওয়েব অ্যাপ্লকেশন যেটা আছে সেটা সবদিক দিয়ে পারফেক্ট। আমরা নেক্সট ফেইজে যাচ্ছি মোবাইল অ্যাপে। সবকিছু ঠিক থাকলে এ মাসে মোবাইলে লঞ্চ করব। ওয়েবে এখনও অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন এখন ইউজারকে ম্যানুয়ালি ইনফরমেশন দিয়ে সাইন আপ করতে হচ্ছে।
“অ্যাপে গেলে আইডি কার্ড স্ক্যান করলেই তার সবকিছু ভেরিফাইড হয়ে লগইন করতে পারবে। এক্ষেত্রে ভেরিফিকেশনটাকে আমরা ফার্স্ট প্রায়োরিটি দিচ্ছি। এখন গ্যাংয়ে জয়েন করলে নোটিফিকেশনগুলো ওয়েবসাইটে ঢুকে চেক করতে হয়। অ্যাপে গেলে সেটা সেখানেই দেখা যাবে। অতি দ্রুতই আমাদের অ্যান্ড্রয়েড ও আইওএস ভার্সনে আসতে যাচ্ছি।”