এসব পোস্টের নিচে ‘ধন্যবাদ’ দিয়ে ‘হুবহু পণ্য’ পাওয়ার প্রচারও আছে; যা দেখে উৎসাহ পান অন্যরা।
Published : 15 Apr 2023, 10:38 PM
অস্বাভাবিক মূল্য ছাড়ের ঘোষণা দিয়ে ওয়েবসাইটে বা ফেইসবুকে ভুয়া পেইজ খুলে পণ্য বিক্রির প্রচারণা চলছে হরদম; আর একদম স্বস্তায় কিনতে গিয়ে অগ্রিম টাকা দেওয়ার ফাঁদে পড়ে অর্থ খুইয়েছেন অনেকেই।
নিজস্ব নামে পেইজ খোলার পাশাপাশি প্রতারণার কৌশল হিসেবে নামিদামি কোম্পানির নামে হুবহু নকল পেইজ খোলা হচ্ছে, যেটি আসলে সাধারণ ক্রেতাদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে বেশি।
এমন বেশ কিছু পেইজে কয়েকদিন ধরে নজর রেখে দেখা যায়, বাজারদরের চেয়ে অস্বাভাবিক মূল্য ছাড় দিয়ে পণ্য বিক্রির প্রচার চালানো এমন পেইজগুলো কিছু দিন পরই ‘ইনেকটিভ’ হয়ে যায়। বিশ্বাসযোগ্য করতে শুরুতে ফোন নম্বর দেওয়া থাকলেও পরে তা তুলে নেওয়া হয়, যোগাযোগের সূত্রও যায় হারিয়ে।
মোবাইল ফোন, এসি থেকে শুরু করে বাচ্চাদের খেলনা প্রায় সব ধরনের পণ্য বিক্রয়কারী এসব ফেইসবুক পেইজের সঙ্গে বেশ কয়েকদিন যোগাযোগ করেও অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। পেইজের উদ্যোক্তারা নিজেদের পরিচয় কিংবা ব্যবসার ঠিকানা কোনোকিছুই জানাতে চাননি।
নির্বিচারে ফেইসবুক জুড়ে ছেয়ে যাওয়া এসব পেইজের বড় ছাড়ের প্রলোভনের পোস্টের কারণে ভুক্তভোগী ব্র্যান্ডগুলো পুলিশের পাশাপাশি অভিযোগ করছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির কাছে। এরপরও ধরা পড়ছে না প্রতারকরা, কমছে না প্রতারণা।
আবার চটকদার ঘোষণায় আস্থা রেখে সস্তায় পণ্য কেনার লোভে পড়ে ঠকার পর ক্রেতাদের কেউ কেউ সোচ্চার হয়েও পাননি প্রতিকার।
অগ্রিম টাকা পাঠিয়ে ‘ধরা’
বছর দুয়েক আগে ইভ্যালিসহ ই কমার্সে টাকা দিয়ে পণ্য না পাওয়ার বড় ধরনের প্রতারণার ঘটনা সামনে আসার পর অনলাইন কেনাকাটায় সরবরাহের সময় টাকা পরিশোধের (ক্যাশ অন হোম ডেলিভারি) নিয়ম চালু করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
তবে এসব ফেইসবুক পেইজগুলোতে সে সুযোগ থাকে না। পণ্যের দামের পুরোটা বা অংশ বিশেষ অগ্রিম পরিশোধের শর্তেই থাকে বড় ছাড় বা ক্যাশব্যাক পাওয়ার সুযোগ।
কখনও কখনও দেখা যায় ফোন নম্বর পাল্টে একই ছবি ব্যবহার করে একই ধরনের বক্তব্য দিয়ে নতুন পেইজ চালু করা হয়।
পোস্টের নিচে বহু মানুষ অন্যদেরকে এখান থেকে কেনাকাটা করতে সতর্কও করে থাকেন। এদের কেউ কেউ অগ্রিম টাকা পাঠিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। টাকা পাঠানোর পর নম্বর বন্ধ হয়ে গেছে।
তবে ইদানীং চটকদার এসব পোস্টের নিচে বহুজন ‘ধন্যবাদ’ দিয়ে লিখেছেন, তারা হুবহু পণ্য পেয়েছেন। এতে অন্যরা উৎসাহ দেখান।
ই কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইক্যাব) এফ কমার্স অ্যালায়েন্সের কো-চেয়ারম্যান খালিদ সাইফুল্লাহ্ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগে বিভিন্ন ফেইসবুক পেইজ অগ্রিম টাকা নিয়ে পণ্য দিত না। ভোক্তারা সচেতন হবার কারণে তারা সুবিধা করতে পারছে না। তাই এখন প্রতারকচক্র সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে মিল রয়েছে এমন ডোমেইন ব্যবহার করে গ্রাহকদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।
“রবিশপ বা দারাজের বানানের সঙ্গে মিল রেখে ডোমেইন ব্যবহার করছে, এতে গ্রাহকরা মনে করছে তারা হয়ত প্রকৃত দারাজ বা রবিশপেই পণ্য অর্ডার দিচ্ছে।”
তার পরামর্শ সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো ওয়েবসাইট বা ফেইসবুক পেইজে মাত্রাতিরিক্ত ছাড় দেখলে প্রথমেই ক্রেতার উচিত হবে সেই পেইজ বা ওয়েবসাইটের বানান এবং ডোমেইন আসল কি না তা যাচাই করা।
একই সঙ্গে সেই প্রতিষ্ঠান বা ই কমার্স সম্পর্কে গুগলে সার্চ করে প্রকৃত ওয়েবসাইটের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা। আসলে সচেতনতাই এ ধরনের প্রতারণা থেকে বাঁচাতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
‘ওয়ালটনের এসি, ডাক বন্ধুর ফাঁদ’
‘ডাক বন্ধু ডটকম’ নামে একটি ওয়েবসাইট ও ফেইসবুক পেইজ সম্প্রতি ১১ হাজার ৯৯০ টাকায় এক টন এসি বিক্রির ঘোষণা দেয়। এতে ফ্রি ডেলিভারি, ফ্রি ইনস্টলেশন- সব সুবিধা দেওয়ার কথা জানানো হয়। আবার বিকাশে ক্যাশব্যাক অফারও থাকবে। তবে শুধু ক্যাশ অন ডেলিভারিতে তা পাওয়া যাবে না। পেইজে থাকা মোবাইল ব্যাংকিং নম্বরে টাকা পরিশোধ করা হলেই তা দেওয়া হবে।
ওয়েসবাইটে অর্ডার করার প্রক্রিয়াটি এতটাই সাজানো গোছানো যে, কারও সন্দেহ হওয়াই কঠিন। ওয়ালটনের অফিশিয়াল পেইজে যেভাবে অর্ডার করতে হয়, হুবহু একই প্রক্রিয়ায় এগোতে হয় সেখানে।
এসির পাশাপাশি সেখানে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ এমনকি চাল ও চিনির মতো নিত্যপণ্য বিক্রির বিষয়টিও উল্লেখ আছে।
তবে ওয়ালটনের পক্ষ থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিশ্চিত করা হয়েছে, তাদের এমন কোনো অফার নেই।
এমনকি ‘ডাকবন্ধুর’ অফারের বিষয়ে জানতে পেরে ওয়ালটনের আইন বিভাগের একটি দল ওয়েবসাইটে দেওয়া ঠিকানা ১০/২, কোনাবাড়ী বিএসসিআইসি রোড, গাজীপুরে যান। কিন্তু সেখানে ওই নামের কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এরপর ২০২২ সালের ২০ জুন গাজীপুরের কোনাবাড়ী থানায় সাধারণ ডায়েরিও করা হয়। কোম্পানিটির আইন বিভাগের প্রিন্সিপাল অফিসার আল মামুন তালুকদার সেই জিডিতে লেখেন, এসিটির প্রকৃত মূল্য ৫২ হাজার ৪০০ টাকা। এ প্রতারক চক্রের লোভনীয় অফার ও বিজ্ঞপ্তি দেখে কোনো ব্যক্তি এসি কেনার জন্য অগ্রিম অর্থ দিলে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
“উক্তরূপ প্রতারণার ফলে কেউ প্রতারিত হলে কোম্পানির সুনাম নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”
পরে ডাকবন্ধুসহ সব ধরনের প্রতারণার ফাঁদ থেকে ক্রেতাদের সতর্ক করে ওয়ালটনের ভেরিফাইড ফেইসবুক পেইজে একাধিকবার সতর্কীকরণ পোস্ট দেওয়া হয়।
এখনও ‘ডাকবন্ধু’র ওয়েবসাইট ও ফেইসবুক পেইজ বন্ধ হয়নি। এসি বিক্রির বিষয়ে পোস্টে এখন লেখা আছে, “সবাই ইনবক্সে জানাচ্ছেন ওয়ালটন এসির ৫০% অগ্রিম নিতে। ৫০% অগ্রিম নেওয়া হবে। কিন্ত তাহলে এসি ফ্রি ইনস্টলেশন পাবেন না। অতিরিক্ত ১০০০ টাকা বহন করতে হবে। এবং বিকাশে কোনো ক্যাশব্যাক অফার চললে তা পাবেন না।”
ওয়ালটনের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর তানভীর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বর্তমান সময়ে অনলাইনে প্রতারণা খুব বেড়েছে। অনেকেই অযৌক্তিক এবং লোভনীয় অফারের ফাঁদে পড়ে তাদের প্রতারণার শিকার হন। তাই এ ব্যাপারে আমাদের ক্রেতা সাধারণ যেন সতর্ক থাকেন।”
তিনি ওয়ালটন প্লাজাসহ বিক্রয়কেন্দ্র থেকে পণ্য কেনার পরামর্শ দেন্
‘ডাকবন্ধু’র পেছনে কে বা কারা তা শনাক্ত করা গেছে কি না- জানতে চাইলে কোনাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কে এম আশরাফ উদ্দিন কিছু জানাতে পারেননি।
জুনে সাধারণ ডায়েরির কথা তুলে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। আমি গত অক্টোবরে এখানে যোগ দিয়েছি। তারা (ওয়ালটন) আমার এখানে এলে সহযোগিতা করব।”
রবিশপ: ‘একটি বন্ধ হলে আরেকটি খোলে’
মোবাইল ফোন অপারেটর রবির নাম, লোগো ব্যবহার করে পেইজ খুলে বিশাল মূল্য ছাড়ের নামে অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি জানতে পেরে একাধিকবার ব্যবস্থা নিয়েছে কোম্পানিটি। তবু ভুয়া পেইজের তৎপরতা বন্ধ হয়নি।
রবির একজন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা অনেকবার ব্যবস্থা নিয়েছি। কিন্তু একটি পেইজ বন্ধ হলে আরও একটি খোলে।”
সম্প্রতি রবির লোগো ব্যবহার করে একটি পেইজ ফেইসবুকে ‘রবি অফিশিয়াল ক্যামপেইন অফার’ নামে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ফোনে অস্বাভাবিক মূল্যছাড়ের প্রচারণা চালায়। তবে একটু যাচাই করতেই দেখা গেল এটি একটি ভুয়া পেইজ।
রবির আসল ওয়েসবাইটের মত করে তৈরি এ সাইটে শুধু বিকাশ ও নগদে টাকা পরিশোধের ব্যবস্থা আছে।
এ বিষয়ে রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ধরনের ওয়েবসাইট ও ফেইসবুক পেইজ নজরে আসা মাত্র কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে বন্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি আমরা আইনি ব্যবস্থা নিয়ে থাকি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সব সময় এ বিষয়ে কাজ করা হয়।”
অনলাইন কেনাকাটার আগে ভালো করে ‘রিটার্ন পলিসি’ পড়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “কী কী পেমেন্ট অপশন আছে, তাও দেখুন। ভুয়া সাইটগুলো সাধারণত অতিরিক্ত লাভের লোভ দেখায়। অস্বাভাবিক কম দামে কোনো পণ্য বা সেবা অফার করলেই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।”
পেশাদারি অনলাইন মার্কেটপ্লেস কখনও ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি হিসাবে টাকা পাঠানোর চ্যানেল ব্যবহার করে না জানিয়ে পেমেন্ট অপশনে নজর রাখারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
তারা ‘কিছু’ অগ্রিম চান
বাইসাইকেল বাজার নামে একটি পেইজ থেকে ‘৬৫ শতাংশ ছাড়ে’ সাইকেল বিক্রির ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। পোস্টে বলা আছে, “অনলাইন মানে বিশ্বাসের সাথে কেনাবেচা করা এখানে সম্পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে ক্রয়-বিক্রয় করতে হয়।”
প্রতিটি সাইকেলের অস্বাভাবিক কম দাম হাঁকার পাশাপাশি একটি করে রেইনকোট বিনামূল্যে দেওয়ার ঘোষণাও আছে। তবে হোম ডেলিভারি নিতে হলে ৪১০ টাকা পেমেন্ট করতে হবে অর্ডারটা কনফার্ম করার শর্ত হিসেবে।
পেইজে ম্যাসেজ করা হলে রেকর্ডেড অডিও বার্তায় জবাব দেওয়া হয়। ‘গিয়ে কিনে আনব, ঠিকানা দিন’- এ কথা লেখার পর দাবি করা হয়, তাদের বিক্রয়কেন্দ্র যশোরের বেনাপোলে।
বেনাপোলের বিস্তারিত ঠিকানা চেয়ে ম্যাসেজ করার ১০ দিনেও জবাব আসেনি।
বাইসাইকেল শপ বিডি নামে আরও একটি পেইজ ৬৫ শতাংশ ছাড়ে সাইকেল বিক্রির ঘোষণা দিয়ে দাম থেকে ৫৫০ টাকা অগ্রিম পরিশোধের শর্ত দিচ্ছে।
সাইকেল হাউজ নামে আরেকটি পেইজ থেকে ৬০ শতাংশ ছাড়ে সাইকেল বিক্রির ঘোষণা দেওয়া আছে। তাতে তাদের ঠিকানা লেখা আছে, শো-রুম ঠিকানা:- যশোর, ‘বেনাফল’।
ঠিকানা চেয়ে পেইজে ম্যাসেজ দেওয়া হলে রিপ্লাইয়ে বলা হয়, ‘সি ব্লক’। ‘বিস্তারিত ঠিকানা দিন’- এ ম্যাসেজেরও কোনো জবাব আসেনি।
বিডিশপ সেভেনটি ওয়ান নামে আরও একটি পেইজে ৫৫ শতাংশ ছাড়ে বাচ্চাদের সাইকেল ও খেলনা গাড়ি বিক্রির ঘোষণা দেওয়া আছে। এজন্য ৭১০ টাকা অগ্রিম পাঠাতে হবে বিকাশে। আর পুরো টাকা বিকাশে অগ্রিম দিলে ৫৫ শতাংশের পর আরও ২৫ শতাংশ ছাড়ের ঘোষণা আছে।
এ পেইজে অগ্রিম ছাড়া ক্যাশ অন ডেলিভারিতে কেউ পণ্য পাঠানো হবে না, এমন কথা বলে দেওয়া আছে প্রতিটি পোস্টে।
এমন অসংখ্য পেইজ পেইজ ফেইসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব পেইজের বিভিন্ন পোস্টের নিচে অনেকেই কমেন্ট করে বিস্তারিত জানতে চাইছেন। তবে আবার সতর্কও করছেন কেউ কেউ। পরামর্শ দিচ্ছেন টাকা না দিতে।
যেমনটি মো. সাজিদুল ইসলাম নামের একজন সাইকেল হাউজ নামের ফেইসবুক পেইজে লিখেছেন, “ওদের কাছ থেকে কেউ সাইকেল ওডার কোরবেন নাহ। ওরা বাটপার। আমি গত পোরশু একটা মামলা করে আসছি আমার ২৩০০ টাকা মেরে দিছে। কোনো এডভান্স দিয়ে ওডার করবেন নাহ, আগে জিনিস হাতে পাবেন পরে টাকা।”
প্রতারণার শিকার একজন তার নিজের ফোন নম্বর দিয়ে অন্যদের সতর্ক করেছেন। টাকা দিয়ে পণ্য না পেয়ে বিচার দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তার কাছে।