ইট ভাটা থেকে শুরু করে টেক্সটাইল মিল– সব ধরনের কারখানায় পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও পদ্ধতি চালুর জন্য বিনিয়োগে উত্সাহিত করার চেষ্টা জোরদার করেছে ব্যাংকগুলো।
Published : 19 Jul 2023, 11:40 AM
উত্তরবঙ্গের ইট প্রস্তুতকারক বনলতা রিফ্র্যাকটরি কার্বন নিঃসরণ এবং পরিবেশের ক্ষতি কমিয়ে ইট তৈরির আধুনিক পদ্ধতি চালু করতে চাইছিল বহু বছর ধরেই। কিন্তু পরিবেশবান্ধব ভাটা তৈরির জন্য তহবিল পাচ্ছিল না।
২০২০ সালের গোড়ার দিকে বনলতা কর্তৃপক্ষ জানতে পারে, বাংলাদেশ ব্যাংক টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব প্রকল্পের জন্য কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। তারপর লাগল পরিবর্তনের হাওয়া।
ইটভাটায় হাইব্রিড হফম্যান চুল্লি বসানোর জন্য ৫ কোটি টাকা ঋণ পায় বনলতা। এ ধরনের ভাটা চালাতে সনাতনী স্থায়ী চিমনির চুল্লির চেয়ে কম কয়লা লাগে। ফলে বায়ু দূষণ ও তাপ বিকীরণ কম হয়।
পরিবেশ ও জলবায়ুবান্ধব প্রকল্পের জন্য বনলতা ওই ঋণ পায় ৬ শতাংশ সুদে, যেখানে সাধারণ প্রকল্পে ওই অর্থ পেতে ১০ শতাংশ সুদ দিতে হত।
নাটোরের বনলতা ইট ভাটার অপারেশন ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম জানালেন, তারাই এখন উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় ইট প্রস্তুতকারক।
“স্থায়ী চিমনির চুলায় যে কয়লা লাগত, হাইব্রিড হফম্যানে লাগে তার অর্ধেক। নতুন চুল্লি চালু করায় আমরা কার্বন নির্গমণ ৭০ শতাংশ কমিয়ে আনতে পেরেছি,” বলেন শহিদুল।
বাংলাদেশে গ্রিন ফাইন্যান্স বা পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে অর্থায়ন দ্রুত বাড়ছে। সরকারি তথ্য বলছে, ইট ভাটা থেকে শুরু করে টেক্সটাইল মিল– সব ধরনের কারখানায় পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও পদ্ধতি চালুর জন্য বিনিয়োগে উত্সাহিত করার চেষ্টা জোরদার করেছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো।
২০২০ সালে নীতিমালায় পরিবর্তন আনার পর থেকে গ্রিন ফাইন্যান্স দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে
এ ধরনের ঋণদান বাড়াতে কোটা ঠিক করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
তবে সক্ষমতা, সচেতনতার অভাবের কারণে এর অগ্রগতি নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে এখনও।
বন্যা, নদী ভাঙ্গন ও ঘূর্ণিঝড়ের মত দুর্যোগের ঘনঘটার কারণে বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জলবায়ু-ঝুঁকিতে থাকা একটি দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই ঝুঁকি কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ পরিবেশবান্ধব ঋণ, জলবায়ু বীমা এবং ক্ষুদ্রঋণসহ বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবনী অর্থায়নের কৌশল নিয়েছে।
এক দশকের বেশি সময় আগে বাংলাদেশের জন্য একটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব ঋণ নীতি প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছিলেন সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান। তার ভাষায়, দেশে ও বিদেশে এর যে প্রভাব পড়েছে, তা ‘অসাধারণ’।
তিনি বলেন, চীন ও ইন্দোনেশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন টেকসই অর্থায়নে বাংলাদেশের উদাহরণ অনুসরণ করেছে; থাইল্যান্ড ও উগান্ডাও সম্প্রতি এ বিষয়ে পরামর্শ চেয়েছে।
“অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এখন পরিবেশবান্ধব অর্থায়নের বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে উত্সাহিত করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি গ্রহণ করছে, যাতে বেসরকারি খাতকে টেকসই বিনিয়োগে যেতে আশ্বস্ত করা যায়।”
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সীমিত সক্ষমতার কারণে বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত মাত্রায় অগ্রগতি হচ্ছে না। সে কারণে গ্রিন বন্ডের মত পরিবেশবান্ধব অর্থায়নের নতুন নতুন ইন্সট্রুমেন্ট চালুর আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন বলেন, "পরিবেশবান্ধব প্রকল্পের প্রযুক্তিগত দিক সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অনেক সময় গ্রিন ফাইন্যান্সের নামে তহবিলের অপচয় করে।"
নীতি বদলে বেড়েছে ঋণ
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১২ সালে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই আর্থিক নীতি চালু করে। এর মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে সাধারণ হারের চেয়ে ২-৪ শতাংশ কম সুদে এবং দীর্ঘ মেয়াদে ঋণদান শুরু হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স বিভাগের পরিচালক চৌধুরী লিয়াকত আলী বলেন, সচেতনতার অভাবে শুরুর দিতে এ ধরনের ঋণ জনপ্রিয় ছিল না। সে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২০ সালে নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন আনে।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ তহবিলের অন্তত ১৫ শতাংশ টেকসই প্রকল্পে এবং ৫ শতাংশ পরিবেশবান্ধব উদ্যোগে বিতরণ করা বাধ্যতামূলক করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংজ্ঞা অনুযায়ী, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) পরিবেশগত, সামাজিক, এবং সুশানের লক্ষ্যগুলো পূরণ করতে পারে, এমন ঋণগুলোকে ‘সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স’ এর আওতায় রাখা হয়েছে। আর ‘গ্রিন ফাইন্যান্স’ এর মূল লক্ষ্য থাকে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ‘সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স’ এর আওতায় কমপক্ষে ১২ বিলিয়ন ডলারের সম পরিমাণ ঋণ দিয়েছে। আর গ্রিন ফাইন্যান্সের আওতায় ঋণ দেওয়া হয়েছে ১.১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ২০২১ সালের তুলনায় এ দুটো খাতে ঋণদানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৮ শতাংশ ও ৬৯ শতাংশ।
সোলার হোম সিস্টেম, সোলার পার্ক, বায়োগ্যাস এবং বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পুনর্ব্যবহার এবং অর্গানিক ফার্মিংসহ মোট ১১৭ ধরনের ঋণ এখন বাংলাদেশে দেওয়া হয়, গতবছর এই সংখ্যা ছিল ৬৮।
টেকসই অর্থায়নে যে ব্যাংকগুলো সবচেয়ে ভালো করছে, তাদের পুরস্কারও দেওয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রায় সব ব্যাংকেই এখন টেকসই ও সবুজ অর্থায়নের জন্য আলাদা বিভাগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক লিয়াকত আলী বলেন, “আমরা এখন একটি টেকসই জলবায়ু পরিবর্তন নীতি নিয়ে ভাবছি, যেখানে জলবায়ু অভিযোজন এবং প্রশমন প্রচেষ্টার পাশাপাশি ক্ষতি এবং ক্ষতির কারণগুলো নিয়েও কাজ করা যাবে।
“আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ সবুজ ও টেকসই অর্থায়নে অগ্রপথিকের ভূমিকা রাখতে পারে। একদিন আমরা হয়ত পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্রকল্পগুলোতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিতে পারব।"
ব্যাংকের পাশাপাশি, বীমা এবং ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোও পরিবেশবান্ধব ঋণদানে এগিয়ে আসছে। সাজিদা ফাউন্ডেশন গত বছর দেশের প্রথম সবুজ বন্ড চালু করে, যারা সাধারণত কৃষি খাতে ছোট ঋণ এবং বীমা সেবা দেয়।
অলাভজনক প্রতিষ্ঠানটি ওই বন্ড এর মাধ্যমে বেসরকারি খাতের বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে ১.১ বিলিয়ন টাকা সংগ্রহ করেছে। ৩৬টি জেলায় কৃষক এবং দরিদ্র পরিবারকে ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে সেই অর্থ।
সুবিধা পাচ্ছে গার্মেন্ট কারখানাও
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, সবুজ ও টেকসই ঋণগ্রহীতারা ‘খুব সচেতন’ এবং তারা সাধারণত সময়মত কিস্তি পরিশোধ করেন।
“আমরা যখন দেখি, আমাদের দেওয়া ঋণ পরিবেশ বান্ধব এবং টেকসই প্রকল্পে কাজে লাগছে, তখন ব্যাংকার হিসেবে আমরা গর্ব বোধ করি।"
জার্মানওয়াচের গবেষকদের করা বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। সে বিষয়টি উল্লেখ করে মাহবুবুর রহমান বলেন, “সেজন্যই আমাদের ‘ক্লাইমেন্ট-স্মার্ট’ বিনিয়োগ নিয়ে কাজ করতে হবে।”
যেসব প্রতিষ্ঠান সবুজ ও টেকসই ঋণের সুবিধা নিচ্ছে, তাদের অগ্রভাগে আছে পোশাক কারখানাগুলো।
বিজিএমইএ জানিয়েছে, বাংলাদেশের ১৮৫টির বেশি পোশাক কারখানা পরিবেশবান্ধব ভবনের জন্য এলইইডি সার্টিফিকেশন পেয়েছে, যা বিশ্বের পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোরর মধ্যে সর্বোচ্চ।
এরকমই একটি কোম্পানি এনভয় টেক্সটাইল, যারা ২০২১ একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৫.৫ শতাংশ সুদে হারে ২০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। কারখানার যন্ত্রপাতিগুলো পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে ওই অর্থ ব্যয় করেছে তারা।
এনভয় টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, তারা স্বয়ংক্রিয় কাটিং ও সেলাই মেশিন বসিয়েছেন, ইনভার্টার প্রযুক্তির এয়ার কন্ডিশনার এবং এলইডি লাইট লাগিয়েছেন, যা কার্বন নিঃসরণ কমাতে সাহায্য করেছে।
“এর একটি বড় সুবিধা হল, পরিবেশবান্ধব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছি বলে ক্রেতারা আমাদের পণ্য বেশিনি চ্ছেন। তারা আমাদের সাথে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি স্বাক্ষর করছেন।"