বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিতিশীলতা, মূল্যস্ফীতির মত সমস্যা সামনে এলেও উদ্যোক্তারা ‘দুর্নীতিকেই’ দেশে ব্যবসার জন্য বড় বাধা হিসেবে দেখছেন বলে সিপিডির এক জরিপে উঠে এসেছে।
রোববার সিপিডি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত পরিচালিত এ জরিপের ফল তুলে ধরেন প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশ কেমন তা জানতে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সহযোগিতায় জরিপটি পরিচালনা করা হয়। এতে অংশ নেন ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের ৭৪টি কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গত বছর (২০২২ সাল) ব্যবসায় সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল দুর্নীতি। ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ ব্যবসায়ী মোটা দাগে দুর্নীতিকে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছেন।
উচ্চহারের দুর্নীতি, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, ব্যাংক থেকে অর্থায়ন সমস্যা- এ তিনটি পুরনো চ্যালেঞ্জ যেমন ছিল; তেমনি মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিরতা, জাতীয় নীতিমালার ধারাবাহিকতা না থাকা, পরিবেশ ঝুঁকির মত সমস্যা ব্যবসার বাধার ক্ষেত্রে নতুন কারণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে বলে জরিপে উঠে আসার কথা জানান তিনি।
ব্যবসার ক্ষেত্রে দুর্নীতির চিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে জরিপের তথ্য তুলে ধরে তিনি জানান, কর দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা বলেছেন ৪৮ শতাংশ ব্যবসায়ী; লাইসেন্স নেওয়ার ক্ষেত্রে বলেছেন ৫৪ শতাংশ; গ্যাস, বিদ্যুৎ সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে ৪৯ শতাংশ এবং আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা বলছেন ৭৫ শতাংশ ব্যবসায়ী।
জরিপের বিষয়ে সিপিডির এ গবেষণা পরিচালক বলেন, “সামগ্রিকভাবে এটি দেশের জাতীয় অর্থনীতির প্রতিনিধিত্ব করে না। মূলত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর সঙ্গে সম্পৃক্ত, বড় ও এসএমএই খাতের উদ্যোক্তাদের মতামতের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে।”
বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড, চীন, ভিয়েতনাম- এ পাঁচটি দেশের মধ্যে ব্যবসার পরিবেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান সবার নীচে বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়।
জরিপের ফলে দেখা গেছে, ব্যবসায় বাধার ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত অবকাঠামোকে দায়ী করেছেন ৪৪ দশমিক ৬ শতাংশ ব্যবসায়ী, অর্থায়নের সমস্যাকে দায়ী করেছেন ৪৩ দশমিক ১ শতাংশ উত্তরদাতা, সরকারি প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতাকে দোষ দিয়েছেন ৪৩ দশমিক ১ শতাংশ উত্তরদাতা, মূল্যস্ফীতিকে প্রতিবন্ধক মনে করেন ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ উদ্যোক্তা আর বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিরতাকে বাধা হিসেবে দেখেন ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ উত্তরদাতা।
এছাড়া জাতীয় নীতিমালার ধারাবাহিকতা না রক্ষাকে দায়ী করেন ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ, কর প্রদানে জটিলতাকে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ, উচ্চ করহারকে ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ, দুর্বল নীতি-নৈতিকতা এবং সরকারের স্থিতিশীলতার অভাবকে ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ, দুর্বল গণস্বাস্থ্যকে ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ, গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবনে সক্ষমতার অভাবকে ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ এবং নিয়ন্ত্রণমূলক শ্রম নীতিমালাকে দায়ী করেন ১০ দশমিক ৮ শতাংশ উত্তরদাতা।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “কর, লাইসেন্স, আদালত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের মত সেবায়- সরকারি প্রতিষ্ঠানের সমস্যা ব্যবসায়ীদের ভোগাচ্ছে। ৬৬ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন- আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সেবার প্রতি তারা নির্ভর করতে পারছেন না।”
বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বড়দের অনেক পথ রয়েছে। ছোটরা তাদের সঙ্গে টিকে থাকতে পারছে না। পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে সরবরাহ ব্যবস্থাপনা চলে যাচ্ছে বড়দের হাতে।
‘আর্থিক খাতে ভালো খবর নেই’
আর্থিক খাতের নতুন কোনো ভালো খবর নেই উল্লেখ করে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটির (আইডিআরএ) নজরদারিতে দুর্বলতা দেখা গেছে।
“আর্থিকখাতে পুরো সংস্কার প্রয়োজন। আর্থিক প্রতিবেদনের মান নিয়ে প্রশ্ন, সেকেন্ডারি মার্কেটে লেনদেন ও বিও হিসাবের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।”
পুঁজিবাজার নিয়ে তিনি বলেন, “পুঁজিবাজারের দুর্বলতা এখন ওপেন সিক্রেট। এটা আর ঢেকে রাখার বিষয় না। সামগ্রিকভাবে পুঁজিবাজার একটি অদক্ষ পুঁজিবাজারে পরিণত হয়েছে।”
সিপিডি নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, “জরিপ পরিচালনার পর সরকার জ্বালানি খাতে ভর্তুকি তুলে নিতে শুরু করেছে। কিন্তু এতে জনগণের উপর কেমন প্রভাব পড়বে তা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। হয়ত আইএমএফের চাপে এটি করছে। কিন্তু ঋণ পেতে শর্তের আলোচনার সময়ে এটি তুলে ধরলে তারাও বুঝত।
“অপচয় বন্ধ, রাজস্ব নীতি সংস্কার ইত্যাদি করেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যেত।”
প্রদিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যবসায়ীরা আগামী দুই বছরের জন্য সম্ভ্যাব্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন-ধারাবাহিক মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকঋণ, পণ্যমূল্য, সামাজিক ঝুঁকি ও জীবনযাপন ব্যয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, সংক্রমণ রোগ, ডিজিটাল অসমতা এবং মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক কারণে পরিবেশ ঝুঁকিকে।
এসব বিষয়ে সামনে রেখে নতুন নীতি নির্ধারণ করা প্রয়োজন মন্তব্য করে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রশাসনের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও এসব বিষয়ে কীভাবে সমাধান করবে- তার প্রতিশ্রুতি থাকার সুপারিশ করছি।”