এভাবে চললে মাস শেষে কর্মচারীদের বেতন দিতে পারবেন না জানিয়ে নিউ মার্কেট এলাকার এক ব্যবসায়ী বললেন, ‘‘তারা (রাজনীতিবিদরা) কি বোঝে না যে হরতাল- অবরোধে গরিবের কেমন কষ্ট হয়?”
Published : 06 Nov 2023, 12:45 AM
বিকাল ৪টা। গুলিস্তানের ফুটপাতে ছোটদের মোজা ও গেঞ্জি নিয়ে অলস বসে বিক্রেতা তারেক মাহমুদ। মুখে হাসি নেই।
কেনাবেচা কেমন চলছে- এই প্রশ্নে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘কাস্টমাররা হাঁটতে হাঁটতে দেখে, পছন্দ হইলে মোজা গেঞ্জি কেনে। তাই কাস্টমার ধরতে সারাদিন চিল্লান লাগে। এহন তো কাস্টমারই নাই। বেচুম কী।
“হরতাল অবরোধে বিক্রি ৯০ পারসেন্ট নাই হয়ে গেছে। আগের হরতালে দোকান সন্ধ্যায় লাগাইছি (খুলেছি)। আইজ (রোববার) বিকালে লাগাইলাম।”
কর্মদিবসের এমন বিকালে মতিঝিল আর গুলিস্তানের ফুটপাতে গম গম করে ক্রেতা-বিক্রেতায়। অফিস শেষে বাসায় ফেরার পথের যাত্রী, আবার নারায়ণগঞ্জ-কুমিল্লার বাস বা সদরঘাটের যাত্রীরাও গুলিস্তান থেকে তুলনামূলক কম দামে পণ্য নিয়ে যেতেন। হকারদের ডাকাডাকি থাকত প্রতিটা মুহূর্ত।
কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা সেই স্বাভাবিকতায় ছেদ পড়েছে। গত সপ্তাহের পাঁচটি কর্মদিবসের মধ্যে চার দিনই গেছে হরতাল-অবরোধে। চলতি সপ্তাহের প্রথম দুই দিনেও নেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। কর্মসূচি থামবে না– এমন কথাও বাজারে শোনা যাচ্ছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে তাই দুশ্চিন্তা।
নিত্যদিনের কেনাবেচার আয়ে চলে সংসার। দুই চার দিন জমানো টাকায় চলা সম্ভব। কিন্তু বেশি দিন হলে কঠিন হয়ে যায় সবার জন্যই। যদি এভাবে হরতাল অবরোধ চলতে থাকে, তাহলে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে জীবন চলবে কী করে, সেই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে মনে।
কয়েকদিন পরই শুরু হবে শীতের কেনাকাটা। সারা বছরের আয়ের একটি বড় অংশ আসে এই সময়ে। এই সময়েই রাজনৈতিক অস্থিরতায় ফুটপাতের ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের মাঝে উদ্বেগ।
শুধু এই এলাকা নয়, নিউ মার্কেট, গাউসিয়া, নীলক্ষেত, এলিফ্যান্ট রোড, শাহবাগ, ও বায়তুল মোকাররম এলাকার, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের, ফুটপাত ও ভ্রাম্যমাণ- সব বিক্রেতাদের শঙ্কাই একই রকম।
কেউ আছেন সংসার চালানোর নিয়ে দুশ্চিন্তায়, দোকান মালিকরা দুর্ভাবনায় কর্মীদের বেতন দেবেন কোত্থেকে, শীতের পোশাকের পাইকারি ব্যবসায়ীরা ভাবছেন, মজুদ করা পণ্য বিক্রি হবে কি না।
এই চিত্র শুধু ঢাকায় না, দেশের প্রায় প্রতিটি বড় শহরেই এক চিত্র। অবরোধের মত কর্মসূচিতে সহিংসতার আশঙ্কায় মানুষের চলাচল কমে গেছে। ফুটপাতের বিক্রেতা তার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসা টিকে থাকে মানুষের চলার পথের কেনাটাকায়। আর চলাচল কমে যাওয়া মানেই তাদের মাথায় হাত।
সারা দেশে এই ব্যবসায়ীদের সংখ্যা অনেক।
২০২০ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এর এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর ফুটপাতে হকার আছেন তিন লাখ। সারা দেশে এই সংখ্যাটি ১০ লাখের মত। যদি ১০ লাখ পরিবার হয়, তাহলে সরাসরি ৪০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল।
এদের পাশাপাশি রাস্তার পাশের চা-বিড়ি-পানের দোকান, পরিবহন শ্রমিকসহ দিনে এনে দিনে খায়, এমন আরও লাখ লাখ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠছে অবরোধের মতো কর্মসূচি।
তবে রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতায় আসার কোনো আভাসই দিচ্ছে না। বিরোধী দল যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে, তা মানা হবে না, সাফ জানিয়ে দিয়েছে সরকার। অন্যদিকে বিরোধী দল জানিয়েছে, তাদের কর্মসূচি থামবে না। এমনকি সংলাপ বা আলোচনাতেও দুই পক্ষ সরাসরিই ‘না’ করে দিয়েছে।
সরকার ও বিরোধী দলের এই পরস্পরবিরোধী অবস্থানে ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত এবং ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে কয়েক মাসও এভাবে ভুগেছে শ্রমজীবীরা।
সে সময়ও তাদের দুর্দশার কথা উঠে এসেছে গণমাধ্যমে, কিন্তু গা করেনি কেউ।
‘যাও মানুষ আসে রাস্তায় খাড়ায় না আতঙ্কে’
ঢাকা ট্রেড সেন্টার মূল ভবনের সামনের সিড়ি ও ফুটপাতে চৌকি বসিয়ে যারা ব্যবসা করেন, তাদের অবস্থা আরো করুণ।
ছোটদের পোশাক বিক্রেতা মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘‘আজকাইল যা বিক্রি হয় তাতে কোনোমতে দোকান খরচা হয়। মাল তো পইড়া থাকে। কাইল ১০ পিস বিক্রি করছি।’’
বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের ফুটপাতের ২০ বছর ধরে পোশাক বিক্রি করেন শাহরিয়ার হোসেন। এমন ঢিলেঢালা কর্মসূচিতে বেচাকেনা এত কমে গেল কেন, সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজে বেড়াচ্ছেন তিনি।
শাহরিয়ার বলেন, ‘‘এভাবে চললে খামু কী? পকেট খরচাই তো উঠে না। দিন শেষে কালেকশন জমা দিতে হয়। দুই দিন কালেকশন দিতে পারি নাই।”
তার মত অনেকেই সকালে পণ্য এনে বিক্রি করে রাতে পরিশোধ করেন। এই পরিশোধকে ‘কালেকশন’ বলা হয় তাদের ভাষায়।
গুলিস্তানের খদ্দর মার্কেটে শার্ট-প্যান্টের কাপড় বিক্রি করা লতিফ শপিং সেন্টারের বিক্রেতা মকবুল হোসেন বিকালে বললেন, “বউনি করতে পারলাম না।”
গত সপ্তাহের অবরোধে বিকেলে ক্রেতা পেলেও রোববার তাও পাননি।
মতিঝিলের সোনালী ব্যাংকের সামনের শার্ট বিক্রেতা স্বপন শরীফ বলেন, ‘‘আমাগো তো সব কাস্টমার অফিসের লোকজন। এই ধরেন এই এলাকার অফিসে চাকরি করে তারা। আর বিভিন্ন কাজে আসে তারা। এখন তো কোনো কাস্টমারই নাই। যারা আসে অফিসে, রাস্তায় আর খাড়ায় না ভয়-আতঙ্কে।”
মতিঝিল ও আশপাশের এলাকায় ভ্যান বোঝাই করে জিন্সের প্যান্ট বিক্রি করেন রাব্বি তালুকদার। তিনি বলেন, ‘‘বিকেল ২টায় দোকান সাজাইছি। এক ঘণ্টায় এক পিস প্যান্ট বিক্রি হইছে। গত বৃহস্পতিবার হইছিল পাঁচ পিস। এতে তো দুই জনের খরচাই উঠে না।”
‘মাস শেষে তো বেতন দিতে পারব না’
ঢাকায় নিউ মার্কেট ও আশেপাশের ফুটপাতে কোনো অফ সিজন থাকে না। বছর জুড়ে প্রায় প্রতিদিনই সেখানে থাকে ক্রেতার ভিড়। দৈনন্দিন জীবনে ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে নগরীর নানা প্রান্ত থেকে আসেন ক্রেতারা। এদের মধ্যে বেশিরভাগই থাকেন নারী।
কিন্তু এমন সময়ে আসছেন না ক্রেতা। তাই নিউ মাকের্ট ও নীলক্ষেত এলাকার বিভিন্ন শপিং সেন্টার এবং চন্দ্রিমা, গাউছিয়া মার্কেটের দোকানগুলো একটু দেরি করেই খুলেছেন ব্যবসায়ীরা।
নিউ মার্কেটে কাপড়ের দোকানি রমজান আলী বলেন, ‘‘সকাল থেকে বসে আছি। লোকজন ভয়ে আসছে না। দোকান খুলে সাড়ে ৩ পর্যন্ত মাত্র আটশ টাকা বিক্রি করেছি।”
সিয়াম বস্ত্র বিতানের মালিক শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, ২৮ অক্টোবর থেকেই বেচাকেনায় ধস নেমেছে। এভাবে চললে মাস শেষে কর্মচারীদের বেতন দিতে পারবেন না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘তারা (রাজনীতিবিদরা) কি বোঝে না হরতাল- অবরোধে গরিবের কেমন কষ্ট হয়?”
নিউ মার্কেটের সামনের সড়কে বিছানার চাদর বিক্রি করেন আবু তাহের। তিনি বলেন, ‘‘এক সপ্তাহেরও বেশি তেমন বেচাকেনা নাই। আজকে দুপুর পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে পাঁচশ টাকা। এমনিতে দিনে ৫-৬ হাজার টাকা বিক্রি হয়।”
ব্যাগ বিক্রেতা মানিক মিয়া বলেন, ‘‘আমাদের দোকানের আয় থেকে সংসার চলে। আমাদের বেচাকেনা না হলে না খেয়ে থাকতে হবে। এই অবস্থা চলতে থাকলে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।”
নীলক্ষেতে মোড়ের কাছেই ফুটপাত লাগোয়া কসমেটিক্সের দোকান ফেমিন বিউটি কনসেপ্টের বিক্রয়কর্মী জুয়েল মিয়া বলেন, ‘‘সবাই জানে এই নিউ মার্কেটে কী ভিড় থাকে সব সময়। আজকে দেখুন একদম ফাঁকা। সারাদিনে মাত্র দেড় হাজারের মতো বিক্রি হয়েছে। ডেইলি সেল করি ৬-৮ হাজারের টাকা।”
দুর্ভাবনা পাইকারিতেও
পাইকারি পণ্য বিক্রির অন্যতম বড় বাজার গুলিস্তানের ঢাকা ট্রেড সেন্টার। উত্তর ও দক্ষিণ অংশে বিভক্ত এই মার্কেটে ঢাকার অভ্যন্তরের চেয়ে আশপাশের ও দূরের জেলার খুচরা বিক্রেতারা আসেন পণ্য কিনতে।
দেড় হাজারের বেশি দোকান রয়েছে সেখানে। বিভিন্ন জেলার সাপ্তাহিক হাটগুলোতে এ মার্কেট থেকেই পণ্য কিনে নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা। বিক্রি শেষে ঢাকায় ফিরে আবার চলে যান অন্য কোনো জেলা-উপজেলার হাটে।
ভ্রাম্যমাণ সেই ব্যবসায়ীরা এখন আসছেন না বললেই চলে। তাই দোকান খুললেও ‘মাছি তাড়ানোর’ কাজ করতে হচ্ছে এখন।
নিচ তলায় কেডস, লোফার ও স্যান্ডেলের দোকানে পাওয়া গেল বিক্রেতা মোতালেব হোসেনকে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘ব্যবসা নাই-তাই মালিকও আসেনি। দোকান না সাজাইলে তো আরো বিপদ। যতটুকুই বেচা-যায় করি।”
মোতালেবের তথ্য বলছে, বিক্রি যা হয়, তার পুরেটাই সন্ধ্যার সময়। আর স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় তা নেমেছে ১০ শতাংশে।
চতুর্থ তলার ‘মায়ের আচল শপিং সেন্টারের’ স্বত্বাধিকারী রাকিব উদ্দিন বলেন, ‘‘পার্টি (পাইকারি ক্রেতা) নাই। হুইয়া-বইয়া খালি মোবাইল টিপে কর্মচারীরা। যে সেল (বিক্রি) হয় তাতে লাঞ্চের (দুপুরের খাবার) টাকাই উঠে না।”
টি-শার্ট বিক্রেতা মোহাম্মদ সোহেলের আত্মীয় ও বন্ধু মিলিয়ে এই মার্কেটে ছয়টি দোকান রয়েছে। কোনোটাতে বিক্রি হয় পাঞ্জাবি, কোনোটাতে শীতের পোশাক চাদর, কম্বল, সোয়েটার, ইত্যাদি।
নভেম্বরের শেষ দিকে শীত আসে বলে এই সময়ে সেখানে বিশ্রামের ফুরসত থাকার কথা ছিল না। অনেক পোশাক গুদামজাতও করা হয়েছে। কিন্তু অবরোধ-হরতালের মত কর্মসূচি পরিস্থিতি চলতে থাকলে গুদামের পণ্য সেখানেই পড়ে থাকে কি না, তা নিয়েই শঙ্কিত সোহেল।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘দোকানে আউটের (ঢাকার বাহিরের) কাস্টমার (পাইকারি ক্রেতা) নাই। ঢাকায় তো আহন যায় না-গাড়ি নাই। যা আছে তা-তে তো মাল (পণ্য) নিয়া যাইতে পারব ন। কেডা রিস্ক নিব?
“এহন তো ব্যবসা কমলেও চলতে পারুম। কিন্তু শীতকালে কেমন বেচা-বিক্রি হইব, তার টেনশনে আছি। ডরের উপর আছি। এহনই ডর লাগতাছে।”
শীতের ট্রাউজার বিক্রেতা শাহ আলম বলেন, ‘‘বিক্রি নামছে চাইর আনায় (এক চতুর্ভাগে), কী আর কমু। এই সময় একটু ডাল (ব্যবসা কম) থাকে। সামনে শীত আসলে বিক্রি বাড়ব। তয় এবার সেই আশা করতে ডর লাগে।”
ঢাকা ট্রেড (উত্তর) সেন্টারের দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘এই সময়ে তো ব্যবসা একটু কম থাকে। শীতের সিজনে বেচা-কেনা বেশি হব। কিন্তু অবরোধ যদি বাড়ে, তাহলে মালে টাকা আটকা পড়বে ব্যবসায়ীদের।”
বই-ফলের দোকানেও খাঁ খাঁ
এলিফ্যান্ট রোডে ফল বিক্রেতা মো. শাহজালাল বলেন, ‘‘বেচাকেনা কমছে আর কমছে। লোকজন একদমই নাই রাস্তায়। ফল তো কাঁচামাল, বিক্রি না হলে নষ্ট হয়ে যাবে। এভাবে আর কত অবরোধ সহ্য করতে হবে আমাদের? আমাদের তো বেঁচে থাকতে হবে।”
একই চিত্র নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানগুলোতেও।
তানিয়া বুক পয়েন্টের মালিক সবুজ আহমেদ বলেন, ‘‘অন্যান্য দিনের তুলনায় বিক্রি কমে গেছে। গত ৯ দিনে বেচাকেনা তেমন নাই। কিন্তু দোকান খুলে বসে আছি। কী করব? আমাদের তো পেট চলতে হবে।”