চামড়া শিল্পনগরে দূষণ: সংসদীয় কমিটির 'পদক্ষেপ' কাজে আসছে?

“আমরা এখনও কঠোর অবস্থানে। তবে মন্ত্রণালয়ের পজিশন কিছুটা বুঝি, আরেকটা মন্ত্রণালয়কে বলতে হয়ত তারা বিব্রত,” বলছিলেন সাবের হোসেন চৌধুরী।

সাজিদুল হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 July 2022, 08:11 PM
Updated : 30 July 2022, 08:11 PM

অনেক চেষ্টায় ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরানো হয় যে কারণে, সেই দূষণই বন্ধ হয়নি সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরীতে; যা নিয়ে কঠোর হতে একাধিক পদক্ষেপের পরামর্শ এসেছে সংসদীয় কমিটির কাছ থেকে।

এ বিষয়ে সোচ্চার পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বারবার ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছে। তবে প্রায় এক বছরেও সেগুলোর কোনটারই বাস্তবায়ন হয়নি।

বারবার সুপারিশের পরও কাজ কেন হচ্ছে না- জানতে চাইলে এই কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, “শিল্প মন্ত্রণালয় আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ানো ও ক্রোমিয়াম কমিয়ে আনার চেষ্টা করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

“আমরা বলেছি, ব্যর্থ হলে এর জন্য দায়ী ইউনিটগুলো চালু রাখতে দেব না। দরকার হলে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া হবে।”

দূষণ না কমায় সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট ট্যানারির বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধের এমন সুপারিশ এসেছে কমিটির কাছ থেকে। এতে প্রশ্ন উঠেছে, সংসদীয় কমিটি নিজেদের শক্ত অবস্থান থেকে কি সরে দাঁড়াল?

কেননা দূষণের বিষয়ে ছাড় না দিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন চামড়া শিল্পনগরী ‘আপাতত বন্ধ’, ‘বন্ধে অভিযান’ পরিচালনার মত কঠোর পদক্ষেপের সুপারিশ করলেও এবার পুরো নগরীর বদলে দায়ী ট্যানারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলছে কমিটি।

যদিও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বলছে, তারা এখনও ‘কঠোর অবস্থানে’ আছে। তারা মনে করছে, সরকারের আরেকটি মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পরিবেশ মন্ত্রণালয় ‘বিব্রত বোধ’ করছে।

এদিকে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, তারা বিষয়টি নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ‘বারবার’ আলোচনা করছে।

আর শিল্প মন্ত্রণালয় বলছে এজন্য কাজ চলছে, বিভিন্ন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান।

সংসদীয় কমিটি আগের সুপারিশ থেকে পিছিয়ে এসেছে কি না- এমন প্রশ্নে সাবের হোসেন বলেন, “আমরা এখনও কঠোর অবস্থানে। তবে আমরা মন্ত্রণালয়ের পজিশন কিছুটা বুঝি, আরেকটা মন্ত্রণালয়কে বলতে হয়ত তারা বিব্রত।

“আমাদের অবস্থান ও আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ করতে হবে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যবস্থা হবে, আর সরকার বলে ব্যবস্থা নেব না, সেটাতো হয় না।“

শিল্প, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের মত অনেক যুক্তি দেখায় শিল্প মন্ত্রণালয় জানিয়ে তিনি বলেন, “কিন্তু আমরা তো জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যও গুরুত্বপূর্ণ।”

পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাবউদ্দিনের কাছে জানতে চাওয়া হয় সংসদীয় কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন কতদূর? তার জবাবে কিছুটা হতাশার সুর।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বারবার শিল্প মন্ত্রণালয়কে বলছি। পরিবেশের বিষয়টাকে প্রাধান্য তো দিতে হবে। সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি।”

সংসদীয় কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষিতে দূষণ বন্ধে নেওয়া পদক্ষেপের বিষয়ে শিল্প সচিব জাকিয়া সুলতানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা বিয়গুলোকে প্রায়োরিটি দিয়ে কমপ্লায়েন্স ঠিক করছি। পরিবেশ অধিদপ্তর যে লোকাল কমপ্লায়েন্স ঠিক করেছে আশা করি তার চেয়ে উন্নত হবে।”

দূষণ বন্ধে কার্যক্রম চলছে জানিয়ে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ) সঞ্জয় কুমার ভৌমিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিভিন্ন রাসায়নিকের যে মান নির্ধারণ করা হয়েছে তার চেয়ে যেন কম থাকে তা নিয়ে কাজ চলছে।”

২০১৭ সালে আদালতের নির্দেশে সাভারের হেমায়েতপুরের শিল্পনগরী ট্যানারিগুলো যেতে বাধ্য হয়। আর এ শিল্পনগরী গড়ে তোলার কাজ এরও অর্ধযুগ আগে থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক)।

ওই নগরীতে ১৫৫টি ট্যানারিকে জমি দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার তৈরি করে দেওয়ার কথা বিসিকের। তারা এ জন্য একটি চীনা কোম্পানিকে দায়িত্ব দেয় ২০১২ সালে। তবে তারা যথাসময়ে সিইটিপি পুরো চালু করতে পারেনি। আবার এই সিইটিপির সক্ষমতা ও কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

দূষণে বিপর্যস্ত হচ্ছে পুরো নগরী। ট্যানারির কারখানা থেকে বর্জ্য ফেলা হয় ডোবার ভেতরে। স্থানীয়রা জানায়, রাতের আঁধারে তা ফেলা হয় ধলেশ্বরী নদীতে। এতে বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে আশেপাশের এলাকায়।

সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে দৈনিক ৪০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য উৎপাদন হয়, যেখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা রয়েছে ২৫ হাজার ঘনমিটার।

সংসদীয় কমিটি বলছে, দৈনিক ১৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য পরিবেশে মিশছে। গত তিন বছরে এক কোটি ৬৪ লাখ ঘনমিটার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বাইরে থেকে গেছে। এর বাইরে ক্রোমিয়াম শোধনের ব্যবস্থাও নেই সেখানে।

সিইটিপির অগ্রগতিসহ দূষণ বন্ধে এ নগরীর তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা বিসিকের চেয়ারম্যান মাহবুবর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে সাড়া মেলেনি।

সংসদীয় কমিটির যত সুপারিশ

গত বছরের অগাস্টে পরিবেশ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে না হওয়ায় সাভারের চামড়া শিল্প নগরী ‘আপাতত বন্ধ রাখার’ সুপারিশ করে।

কমিটির সুপারিশের পর পরিবেশ অধিদপ্তর বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) কাছে চিঠি দেয়। চামড়া শিল্পনগরী ‘কেন বন্ধ করা হবে না’, তা বিসিকের কাছে জানতে চায় সংসদীয় কমিটি। তবে ওই বক্তব্য ‘সন্তোষজনক নয়’ বলে জানিয়েছিল সংসদীয় কমিটি।

এরপর সংসদীয় কমিটি প্লট ধরে ধরে অভিযান চালিয়ে দূষণে জড়িত ইউনিটগুলো বন্ধের সুপারিশ করে। গত ১৭ জুলাই কমিটির বৈঠকে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করার সুপারিশ আসে।

ক্ষোভ নদী কমিশনের

শুরুতে কথা ছিল শিল্পনগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ট্যানারিগুলো নিজেরাই ইটিপি স্থাপন করবে। কিন্তু ট্যানারিগুলো তা না করায় শিল্প মন্ত্রণালয় প্রকল্পের আওতায় সিইটিপি স্থাপনের প্রকল্প নেয়।

তবে দীর্ঘদিনেও সিইটিপির বিভিন্ন অংশের কাজ শেষ হওয়ার আগেই ১৩০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করে। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার বা সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি) এবং অন্যান্য সব কাজ এখনও শেষ হয়নি।

ফলে আগে হাজারীবাগে বর্জ্য ও দূষিত তরল বুড়িগঙ্গা নদীর পানিতে মিশত, তা এখন সাভারে ধলেশ্বরী নদীতে মিশছে।

সম্প্রতি সাভারে চামড়া শিল্পনগরী পরিদর্শন করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী।

টাস্কফোর্সেও আলোচনা

এদিকে চামড়া শিল্প খাতের উন্নয়নে সুপারিশ তৈরি ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ণের লক্ষ্যে গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্সের সম্প্রতি এক বৈঠকে সংসদীয় কমিটির সুপারিশ নিয়ে আলোচনা হয়।

এ বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবদুল হামিদ কোনো মন্তব্য করতে চানননি।

সংসদীয় কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।”

শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসলে পরিবেশ মন্ত্রণালয় চাইলেও কঠোর হতে পারছে না। কারণ এখানে দ্রুত করার কোনো বিষয় নেই। একটু সময় লাগবেই।”

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লোকাল যে কমপ্লায়েন্স আছে, সেগুলো সবকিছু ঠিক করতে আমাদের ১-২ বছর সময় লাগবে।

“টাক্সফোর্সের যে মিটিং হয়েছে সেখানেও বিষয়গুলো উঠেছিল। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার যেটি আছে সেটার কিছু রেটিফিকেশন দরকার। এছাড়া ক্রোমিয়াম শোধনের জন্য আলাদা প্ল্যান্টের কথাও উঠেছে। সেটাও করা হবে। তবে ওই ১-২ বছর সময় লাগবে।”