বন্দরে তুলা ছাড়ে ‘ফিউমিগেশন’ লাগবে না, স্বাগত জানাল যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্র বলছে, এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশি আমদানিকারকদের ‘শত শত কোটি টাকা সাশ্রয়’ হওয়ার পাশপাশি পাঁচ দিন অপেক্ষার অবসান হবে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 May 2023, 04:19 PM
Updated : 22 May 2023, 04:19 PM

যুক্তরাষ্ট্রের তুলা আমদানির ক্ষেত্রে বন্দরে ‘ফিউমিগেশন’ বা বিষবাষ্পীকরণের বাধ্যবাধকতা তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ।

এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, এতে বাংলাদেশি আমদানিকারকদের ‘শত শত কোটি টাকা সাশ্রয়’ হওয়ার পাশপাশি পাঁচ দিন অপেক্ষার অবসান হবে।

কটন বোল উইভিল নামের এক ধরনের পতঙ্গ থাকত বলে প্রায় দুই যুগ ধরে যুক্তরাষ্ট্রের তুলা বন্দরে নামার পর ফিউমিগেশন বা বিষবাষ্পীকরণের বাধ্যবাধকতা ছিল। ২০১১ সালের উদ্ভিদ সংগনিরোধ আইনেও ওই বাধ্যবাধকতা বজায় রাখা হয়।

রোববার কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার এ বিষয়ে বলেন, “কটন বোল উইভিল মুক্ত করার জন্য আমরা ইউএস-এর পুরো কনসাইনমেন্টকে আটকে রেখে ১০ দিন ধরে বিষবাষ্পীকরণ করতাম দীর্ঘদিন থেকে। সুতরাং দীর্ঘদিন তাদের দাবি ছিল, ফিউমিগেশনের প্রয়োজন নাই।”

ফিউমিগেশন কেন করা লাগত, তার ব্যাখ্যা দিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, আমদানি করা তুলা ১০ দিন বিষবাষ্পের মাধ্যমে রেখে দেওয়া হত, যেন তুলার ভেতরে জীবন্ত কোনো পতঙ্গ বা ক্ষতিকর পোকা থাকলে মারা যায়।

এর আগে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নতুন আমদানি নীতির খসড়া অনুমোদনের বিষয় জানাতে গিয়ে তখনকার মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, “আমেরিকার তুলার মধ্যে এক ধরনের পোকা থাকে। এ পোকা যদি এয়ারে চলে যায় তাহলে আমাদের দেশের শুধু তুলা না অন্য প্লান্টেও বা ফলেও ম্যাসিভ নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট ফেলতে পারে।”

কটন বোল উইভিলকে বাংলায় বলে তুলার ভোমরা পোকা। এ পোকার আক্রমণে তুলার উৎপাদন ব্যাহত হয়। তুলার ভেতরে ডিম বা লার্ভা থেকে গেলে এ পতঙ্গ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়াতে পারে।

রোববার মার্কিন একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকের পর কৃষি সচিব ওয়াহিদা জানান, গতবছর কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি কারিগরি দল যুক্তরাষ্ট্র যায়। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ঘুরে তারা দেখেন, যুক্তরাষ্ট্রে তুলাকে কটন বোল উইভিল মুক্ত করা হয়েছে।

“এবং তারা যে প্রেশারে কটন পাঠায় আমাদের, তাতে কোনো পোকার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নাই। সবকিছু মিলিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দিয়েছে, এটা মুক্ত করে দেওয়া যেতে পারে।”

ওয়াহিদা আক্তার বলেন, কারিগরি দলের সুপারিশ পরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানায় কৃষি মন্ত্রণালয়। দুই মন্ত্রণালয়ের সম্মতিতে সংগনিরোধ আইনে সংশোধন আনে কৃষি মন্ত্রণালয়। গত ১৬ মে ওই সংশোধনীর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

“এরপর থেকে ইউএস-এর তুলা আমাদের দেশে আসলে ফিউমিগেশন লাগবে না, তবে এপিএইচআইএস যেটা, তাদের কোয়ারেন্টিন অথরিটি থেকে একটা সার্টিফিকেট থাকবে। যে সার্টিফিকেটে বলা থাকবে, এই তুলা সম্পূর্ণ উইভিল মুক্ত, এই ধরনের সার্টিফিকেট হলেই আমরা ছেড়ে দেব।”

ফিউমিগেশন কী?

যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা তুলায় কটন বোল উইভিল নামে এক ধরনের পোকা থাকত। এ কারণে ২০১১ সালের উদ্ভিদ সংগনিরোধ আইনে পৃথক ধারা যুক্ত করে দেশটি থেকে আনা তুলার ফিউমিগেশন বা বিষবাষ্পীকরণের মাধ্যমে পতঙ্গমুক্ত করা হত।

এক্ষেত্রে বন্দরে তুলা পৌঁছানোর পর তা ছাড় না করে, সেটাকে ১০দিন কোয়ারেন্টিনে রেখে এই প্রক্রিয়া চলত। ওই আইন সংশোধন করার ফলে এখন আর ফিউমিগেশন করা হবে না।

তবে পণ্য ছাড় করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি দপ্তরের অ্যানিমেল অ্যান্ড প্ল্যান্ট হেল্থ ইনস্পেকশন সার্ভিস (এপিএইচআইএস) থেকে ‘ক্ষতিকর পোকা নেই’ মর্মে সার্টিফিকেট লাগবে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের কারিগরি প্রতিনিধিদলের যুক্তরাষ্ট্র সফরের কথা তুলে ধরে দূতাবাসের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “প্রতিনিধি দলটি যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে সরেজমিনে যুক্তরাষ্ট্রের তুলা উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিদর্শন করেছে এবং তাদের কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা কৌশল যাচাই করে দেখেছে।

“এই সময়ে তারা তুলা প্রক্রিয়াকরণে যে কৌশলগুলো অনুসরণ করে — জিনিং বা তুলা থেকে বীজ ও ময়লা পরিষ্কার করা, লিন্ট ক্লিনিং বা পাতা, ঘাস বা অন্যান্য উপাদান সরিয়ে ফেলা, তুলার বেল তৈরির সময় কঠোরভাবে চাপানোর প্রক্রিয়া দেখে আশ্বস্ত হয়েছে যে আমেরিকা থেকে আমদানি করা তুলাতে বোল উইভিল বা তুলার ভোমরা পোকা থাকার কোনো উপায় বা সম্ভাবনা নেই।”

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তুলা আমদানিকারক দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের তুলার সপ্তম বৃহত্তম ক্রেতা। বাংলাদেশ ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৪৭৫ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার তুলা আমদানি করেছে।

দূতাবাস বলছে, ফিউমিগেশনের বাধ্যবাধকতা থাকায় একদিকে আমদানিকারকের কাছে তুলা পৌঁছাতে দেরি হতে, অন্যদিকে বাংলাদেশি আমদানিকারকদের প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা বাড়তি খরচ হত।

“আমেরিকা থেকে আমদানি করা উচ্চমানের ও টেকসই তুলার ফিউমিগেশন বা বিষবাষ্পীকরণের মাধ্যমে পতঙ্গমুক্ত করার শর্ত বাতিল করায় এখন আমেরিকান তুলা সরাসরি ও সহজেই বাংলাদেশি আমদানিকারকদের মাধ্যমে তৈরি পোশাক শিল্পের সাপ্লাই চেইন বা সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে পারবে। ফলে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক খাতের উল্লেখযোগ্য সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে।”

ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, “যৌথভাবে কাজ করার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে পারা এবং একসাথে কাজ করার মাধ্যমে সমৃদ্ধি অর্জন ও বাণিজ্যের বাধাগুলো দূর করার একটি বড় উদাহরণ যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ।”

তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা যেহেতু বাংলাদেশে উৎপাদিত টেকসই, উচ্চমানের পোশাকের ওপর নির্ভর করে, তাই বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়াতে উচ্চমানের আমেরিকান তুলা প্রয়োজন রয়েছে।"

কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাককে উদ্ধৃত করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, "বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয় জলবায়ু সঙ্কট মোকাবেলা, উদ্ভাবনী প্রযুক্তির বিকাশ ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ এবং বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা অব্যাহত রাখতে আগ্রহী।"

২২ বছরের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র সরকার আমেরিকার তুলা শিল্পের সহযোগিতায় আমদানি করা তুলার ফিউমিগেশনের বাধ্যবাধকতা বাতিলের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সাথে ক্রমাগত আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।