রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৭৯ কোটি ১৩ লাখ ডলার আয় করেছে।
এই অংক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৭ শতাংশ বেশি।
আর এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মত বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে চামড়াকে ছাড়িয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করে নিল পাট খাত।
## জুলাই-এপ্রিল সময়ে মোট ২ হাজার ৯৪৯ কোটি ৩৪ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩.০৯% কম। আর লক্ষ্যের চেয়ে ২১.২৪% কম।
## এই দশ মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ২৪ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। তা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪.০৮% এবং লক্ষ্যের চেয়ে ২২.২৪% কম।
## চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৭০ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৬.২৬% কম।
## এই সময়ে হিমায়িত মাছ রপ্তানি কমেছে ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। স্পেশালাইজড টেক্সটাইল রপ্তানি কমেছে ১৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ পাটপণ্য রপ্তানিকারক সমিতির (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান এম সাজ্জাদ হোসাইন সোহেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিশ্ব বাজারে দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় টাকার অংকে আমাদের রপ্তানি বেড়েছে, যদিও পরিমাণে খুব একটা বাড়েনি। তবে আমরা আশাবাদী, পাট আমাদের জন্য সুখবর বয়ে আনতে পারে।”
তবে মহামারীর ধাক্কা পাটেও লেগেছে জানিয়ে তিনি বলেন, মার্চ মাসে যেখানে এ খাতে রপ্তানিতে ২৩ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ছিল, লকডাউনে কারখানা বন্ধ থাকায় এপ্রিলে তা ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে।
তারপরও আশাবাদী হওয়ার কারণ জানতে চাইলে বিজেজিইএ চেয়ারম্যান বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে অন্যান্য পণ্যের চাহিদা কমলেও পাটপণ্যের চাহিদা কমবে না। খাদ্যের জন্য ফসল ফলাতেই হবে, আর সেই ফসল প্যাকেট বা বস্তাবন্দি করতে পাটের থলে লাগবে। অষ্ট্রেলিয়া থেকে এরইমধ্যে অর্ডার পেতে শুরু করেছি আমরা।”
“আমার বিশ্বাস, পরিবেশের বিষয়টি সামনে আরও জোরালোভাবে সামনে আসবে। আর তাতে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বাড়বে।”
বস্তা বা ব্যাগের পাশাপাশি কার্পেটের জন্যও বাংলাদেশের পাটের চাহিদা বাড়তে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, “কার্পেট তৈরিতে আমাদের জুট ইয়ার্ন ব্যবহৃত হয়। কোভিড-১৯ আতঙ্কে অনেকেই বাসা বা অফিসের কার্পেট পরিবর্তন করবেন। তখন আমাদের পাটের কদর বাড়বে।”
গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাত থেকে ৮১ কোটি ৬৩ লাখ ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ২০ শতাংশ কম।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি করে এক হাজার ২৬ কোটি ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ওই একবারই এ খাতের রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল।
তার আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৯৬ কোটি ২০ লাখ ডলার এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৯২ কোটি ডলার আয় হয়েছিল এ খাত থেকে।
চলতি অর্থবছরের পাট খাত থেকে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮২ কোটি ৪০ লাখ ডলার। অর্থবছর শেষে এরচেয়ে বেশিই আসবে বলে আশা করছেন বিজেজিইএ চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসাইন সোহেল।
“প্রবৃদ্ধির যে ইতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল, তাতে এবার রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেত। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রকোপে সেটা হবে কিনা বুঝতে পারছি না। এখনও তো দুই মাস বাকি আছে; দেখা যাক কি হয়।”
সোহেল জানান, বিশ্ব বাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের দাম ২০ থেকে ২৫ শতাংশের মত বেড়েছে। কাঁচা পাটের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশের মত। বিশ্বব্যাপী পলিথিনের ব্যবহার কমায় পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদাও বেড়েছে।
“ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। আমরা আমাদের সোনালী আঁশের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পারব যদি এ খাতের দিকে একটু নজর দিই। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ ছাড়া আর মাত্র একটি-দুটি দেশে পাট উৎপাদন হয়। বিশ্ব যত বদলাবে পাট পণ্যের চাহিদা তত বাড়বে।”
তিনি বলেন, “বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় এখন আমাদের ব্যবসায়ীরা প্রচুর কাঁচাপাট আমাদের মিলগুলোর কাছে বিক্রি না করে ভারতে রপ্তানি করছে। এতে আমরা পাটের অভাবে ব্যাগ, থলে, বস্তাসহ অন্যান্য পাটজাত পণ্য উৎপাদন করতে পারছি না। এখানে কাঁচাপাটে যে বাড়তি লাভ, সেটা কিন্তু কৃষক পেল না।”
সরকার দেশে পাটের ব্যবহার বাড়াতে ২০১০ সালেই আইন করেছে। সে আইন অনুযায়ী ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনি- এই ছয় পণ্য সংরক্ষণ, সরবরাহ ও মোড়কীকরণে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে সবক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন সোহেল।
“দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা লক্ষ্য করছি, শুধু ধান, চাল ও গমে পাটের মোড়ক ব্যবহার হচ্ছে, সেটাও স্বল্প আকারে; রাজধানী ঢাকায়। জেলা-উপজেলায় কেউ মানছে না এই আইন।”
ছয়টি পণ্যে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা গেলে দেশে পাটকলের সংখ্যা দ্বিগুণ হত এবং কর্মসংস্থানও বাড়ত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব আবদুল কাইয়ুম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে ইউরোপের অনেক বাজারে প্লাস্টিকের ব্যাগ নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। সেই বাজার কিন্তু বিশাল; প্লাস্টিকের ব্যাগের বিকল্প হতে পারে পাটের ব্যাগ। ওই বাজার ধরতে আমাদের এখনই প্রস্তুত হতে হবে।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পাট থেকে বেশি অর্থ আসাটা ভালো খবর। তবে এতে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে আগামী দিনগুলোতেও এর ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে।”
আসাদুজ্জামান বলেন, “বিশ্বব্যাপী যেভাবে পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে, তাতে পাটের চাড়িদা বাড়তেই থাকবে। এ বিষয়টি অনুধাবন করে আমরা যাতে ধারাবাহিকভাবে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি বাড়াতে পারি সে ব্যবস্থা করতে হবে।”
বর্তমানে দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে মোট ২২টি এবং বেসরকারি খাতে প্রায় ২০০ পাটকল রয়েছে।
তুরস্ক, আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, বেনিন, ব্রাজিল, বুলগেরিয়া, কানাডা, চিলি, চীন, কংগো, কোস্টারিকা, মিসর, ইতালি, ইন্দোনেশিয়া, ইথোপিয়া, গাম্বিয়া, জার্মানি, গোয়েতেমালা, হাইতি, ভারত, আয়ারল্যান্ড, ইরান, জাপান, জর্ডান, কোরিয়া, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, মেক্সিকোসহ বিশ্বের ৫০টি দেশে পাট ও পাট পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ।