করোনাভাইরাস: ব্যাংকাররা এখন আতঙ্কে

নভেল করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যে নানা সীমাবদ্ধতার পরও সীমিত পরিসরে সেবা দিয়ে আসছিল ব্যাংকগুলো, কিন্তু অগ্রণী ব্যাংকের এক কর্মকর্তার দেহে সংক্রমণ ধরা পড়ার পর ব্যাংকারদের মধ্যে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 April 2020, 06:11 AM
Updated : 9 April 2020, 06:29 AM

ঢাকার একটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক মাহমুদুর রহমান বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ব্যাংকে বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন আসে। তাদের মধ্যে কেউ ভাইরাস বহন করলে সেটা অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে টাকার মাধ্যমেও রোগটি ছড়াতে পারে।

“আমরা তো বুঝতে পারব না কে সংক্রমিত। সব গ্রাহককেই আমাদের সেবা দিতে হচ্ছে। তাতে আমারও সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে আছি। ব্যাংক আমাদের জন্য তেমন নিরাপত্তা উপকরণও সরবরাহ করেনি।”

মহামারী ঠেকাতে সরকার গত ২৬ মার্চ থেকে সব ধরনের অফিস আদালত বন্ধ রাখলেও জরুরি সেবার প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি সীমিত পরিসরে ব্যাংক খোলা রাখার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার।

এই জরুরি পরিস্থিতিতে লেনদেনের সময়সূচি কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি গ্রাহকদের সশরীরে ব্যাংকে আসা নিরুৎসাহিত করতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

গত ২২ মার্চ সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে ‘কুইক রেসপন্স টিম’ গঠনসহ ১৬ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে।

ব্যাংকাররা বলছেন, অফিস-আদালত, যনবাহন চলাচল বন্ধ থাকলেও মানুষকে লেনদেনের প্রয়োজনে ব্যাংকে যেতে হচ্ছে। সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ব্যাংককর্মীদেরও যাতায়াতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বিভিন্ন ব্যাংক শাখায় ভিড় করা গ্রাহকরা সামাজিক দূরত্বের নিয়মও ঠিকমত মানছেন না। তাতে অস্বস্তি বাড়ছে। 

এরই মধ্যে বুধবার রাজধানীর মতিঝিলে অগ্রণী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল ব্রাঞ্চের একজন কর্মকর্তার দেহে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়লে ওই শাখা বন্ধ করে দেওয়া হয়; কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয় ৬৪ কর্মকর্তাকে।

বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন, সরকারি নানা সুবিধার ভাতাসহ অন্যান্য প্রয়োজনে সরকারি চারটি ব্যাংকে ভিড় বেশি হচ্ছে। মাসের শুরুতে বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকেও গ্রাহকদের চাপ রয়েছে।

ছবি: রয়টার্স

এর মধ্যে গ্রাহকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করা যাচ্ছে না জানিয়ে অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রয়োজনে ব্যাংকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করতে হবে।

“ব্যাংকের সামনে তারা থাকবেন। একসঙ্গে সর্বোচ্চ দুজনকে ব্যাংকে ঢুকতে দেবেন। দুইজন বের হলে আরও দুজন প্রবেশ করবেন।”

আসাদুজ্জামান বলেন, “অর্থনৈতিক কার্যক্রম সচল রাখতে ব্যাংক চালু রাখতে হবে, সেটা আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই। কিন্তু আমাদের কথা কেউ শোনে না। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স মানছে না, গা ঘেষে দাঁড়াচ্ছে।”

রাজধানীর মতিঝিলের একটি সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিন জানান, তিনি প্রতিদিন মিরপুর থেকে অফিসে যান। যাত্রাপথে তাকে সব সময় আতঙ্কে থাকতে হয়।

“আমার ব্যক্তিগত গাড়ি নেই, অফিসের গাড়ি বন্ধ। সপ্তাহে দুদিন এক সিনিয়রের গাড়িতে আসি। কিন্তু বাকি দিনগুলোতে রিকশা, অটোরিকশা যা পাই, তাতে যাই। কোথায় কী আছে জানি না, মনে হয় রিকশা বা অটোরিকশা থেকেই বুঝি সংক্রমিত হলাম!  আরেক সমস্যা হল, যাওয়া আসার পথে অনেক জায়গায় থামিয়ে আইডি কার্ড চেক করে।”

ঢাকার বাইরের বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা আছেন আরও ঝামেলায়। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তার বাড়ি নরসিংদীর পলাশে। প্রতিদিন বাড়ি থেকে অফিসে যাওয়া আসা করেন তিনি। কিন্তু যানবাহন বন্ধ থাকায় তাকে পড়তে হয়েছে বিপাকে।

“এখন পাঁচ-ছয় বার রিকশা পাল্টে অফিসে যাই, আসি। ১০ টাকার ভাড়া একশ টাকা দিতে হয়। বড় সমস্যা হয় রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশ ধরে। রিকশায় লাঠি দিয়ে বাড়ি মারে, রিকশা থেকে নামিয়ে দেয়, রিকশাওয়ালাকেও মারে।

“গত সপ্তাহে আমাদের এক সহকর্মী ঢাকা থেকে এটিএম বুথ ইন্সপেকশনে এসেছিলেন। সব কাগজপত্র দেখানোর পরও ‘অকারণে ঘোরাফেরার’ অভিযোগে পুলিশ তাকে এক হাজার টাকার মামলা দিয়েছে।”

অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গ্রাহকরা যাতে ব্যাংকে সেবা নিতে এসে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম মানেন, তারা সেই চেষ্টা করছেন। কিন্তু অনেক গ্রাহক তা মানতে চান না। 

“মঙ্গলবার আমাদের আমিনকোর্ট শাখায় লোকজনের ভিড় সামলাতে পুলিশ ডাকতে হয়েছে। থানা থেকে পুলিশ এসে লাইন ঠিক করেছে। এ অবস্থায় কার্যক্রম চালাতে কী করতে হবে সেটা তো আর আমরা ঠিক করব না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তো এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যেটা বলবে আমরা সেটাই করব।”

নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে গ্রাহকরা ব্যাংকগুলোতে গিয়ে যাতে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখেন, তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকও প্রয়োজনে প্রশাসনের সহায়তা নিতে বলেছে।

বুধবার রাতে সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের পাঠানো এক সার্কুলারে বলা হয়, “বিভিন্ন ব্যাংকে আগত বিভিন্ন ভাতা গ্রহণকারীসহ গ্রাহক/দর্শনার্থী/সাক্ষাৎপ্রার্থী কর্মকর্তা/কর্মচারীরা ব্যাংকে আগমন করার পর নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখছেন না। তারা যাতে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখেন সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা গ্রহণ করা যেতে পারে।”