ভুল ইপিবির, কথা শুনলাম আমরা: বিজিএমইএ সভাপতি

হাতিরঝিলে জলাশয়ে ভবন ওঠানোর জন্য বিজিএমইএর কোনো দায় ছিল না বলে দাবি করেছেন সংগঠনটির বিদায়ী সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 April 2019, 01:26 PM
Updated : 17 April 2019, 01:28 PM

সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ওই ভবন ভেঙে ফেলতে খালি করে দেওয়ার পর দিন বুধবার সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, ওই জমি দেওয়ার পেছনে ‘ভুল’ ছিল সরকারি সংস্থা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি)।

সিদ্দিকুর বলেন, “ওই জায়গা সিলেক্ট করে দিয়েছে ইপিবি। বিনিময়ে ইপিবিকে ৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছিল। সেই সময়ে এই টাকায় গুলশানেও সমান আয়তনের জমি পাওয়া যেত।

“ভুল আমাদের ছিল না, ভুল করেছে ইপিবি। কিন্তু এর জন্য কথা শুনতে হয়েছে বিজিএমইএকে।”

১৯৯৮ সালে সরকারের কাছ থেকে জমি পেয়ে কারওয়ান বাজারের হাতির ঝিলে ১৫ তলা ভবন গড়ে তুলেছিল বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।

জলাধার আইন লঙ্ঘন করে গড়ে ওঠা ওই ভবন ভেঙে ফেলার রায় সর্বোচ্চ আদালত থেকে আসার পর বুধবারই তা খালি করে সিলগালা করে দেয় রাজউক।

বিজিএমইএর ওই ভবনটিকে সৌন্দর্যমণ্ডিত হাতিরঝিলের ‘ক্যানসার’ আখ্যায়িত করেছিল হাই কোর্ট। রায়ে বলা হয়েছিল, “একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হিসেবে বিজিএমইএর আইনের প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। তারা তা না করে আইনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে।”

ওই জমি দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনা বলেছেন, তখন জলাশয় ভরাট কর ভবন না তুলতে বলা হয়েছিল বিজিএমইএকে, কিন্তু তারা তা শোনেনি।

হাতিরঝিলের ভবনটি ভাঙতে হবে বলে বিজিএমইএকে ঢাকার উত্তরায় ১৭ নম্বর সেক্টরে বাজার মূল্যের অর্ধেক দামে ৫ বিঘা জমি দিয়েছে সরকার। সেখানে নির্মিত হচ্ছে ১৪ তলা বিশিষ্ট বিজিএমইএ কমপ্লেক্স, যার উদ্বোধন ইতোমধ্যে শেখ হাসিনা করেছেন।

বৃহস্পতিবার উত্তরার নতুন ভবনেই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন সিদ্দিকুর। বিজিএমএইএ সভাপতি হিসেবে এটা ছিল সাংবাদিকদের সঙ্গে তার শেষ কর্মসূচি।

বিজিএমইএ পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচনে নতুন সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন রুবানা হক। তার হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছেন মেয়াদের চেয়ে বেশি দিন সভাপতি পদে থাকা সিদ্দিকুর।

তিনি বলেন, তার সাড়ে তিন বছরের দায়িত্ব পালনের সময় সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে কারওয়ান বাজারের ভবন থেকে উত্তরার ‘বৈধ’ ভবনে সংগঠনের কার্যালয় স্থানান্তর।

“এখন নতুন ভবনে আমরা এসেছি। এই ভবনের সব আইনি দিক আমি নিজে খতিয়ে দেখেছি। আমাদের আর কেউ কোনো কথা বলতে পারবে না।”

গত ১৫ এপ্রিল থেকে উত্তরার ভবনে দাপ্তরিক কাজ শুরু করেছেন বলে জানান সিদ্দিকুর।

উত্তরায় উঠছে বিজিএমইএর নতুন ভবন, সেখানে দাপ্তরিক কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। ছবি: ফয়সাল আতিক

স্টার্লিং ডেনিমের এই কর্ণধার দাবি করেন, তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরা এখন দুরবস্থার মধ্যে রয়েছেন।

“মালিকরা যখন অ্যাকর্ড-এলায়েন্সের পরামর্শে লাখ লাখ টাকা খরচ করে কারখানা সংস্কার করলেন, তখনই ইউরোপ-আমেরিকার বড় বাজারগুলোতে পোশাকের দরপতন হয়েছে। ফলে লাভের মার্জিন একেবারেই কমে গেছে। লোকসান দিতে দিতে এ পর্যন্ত ১২শ মালিক ব্যবসা গুটিয়েছে।”

সিদ্দিকুরের হিসাবে

>> প্রতিবছর ৮ শতাংশ হারে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সালে খরচ বেড়েছে ৩০ শতাংশ।

>> প্রতিবছরই ৫ শতাংশ হারে শ্রমিক মজুরি বাড়ছে। নতুন মজুরি বৃদ্ধির পর উৎপাদন খরচ বেড়েছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ।

>> প্রতিযোগী দেশ পাকিস্তান, ভারত, তুরস্ক, চীন, শ্রীলংকা ও ভিয়েতনামে ডলারে বিপরীতে দেশীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলেও বাংলাদেশে ডলারের দাম কার্যত স্থিতিশীল।

এই পরিস্থিতিতে আগামী বাজেটে পোশাক রপ্তানি খাতের জন্য ৫ শতাংশ নগদ সহায়তাসহ বেশ কিছু প্রণোদনার দাবি জানান সিদ্দিকুর। পোশাক শিল্পকে ভ্যাটমুক্ত রাখার দাবিও জানান তিনি।

বর্তমানে নতুন বাজারে ৪ শতাংশ নগদ সহায়তা পাচ্ছে পোশাক রপ্তানি খাত। এশিয়ার নতুন নতুন দেশ মিলিয়ে প্রায় ২০ শতাংশ পণ্য রপ্তানি হয় নতুন বাজারে।

পোশাক খাতে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান সিদ্দিকুর।

অনুষ্ঠানে বিজিএমইএর বিদায়ী পরিচালনা পর্ষদের সহ-সভাপতি মাহমুদ হাসান বাবু, সহ-সভাপতি (অর্থ) মোহাম্মদ নাছির, জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ফারুক হাসান, সহ-সভাপতি এস এস মান্নান (কচি) উপস্থিত ছিলেন।

মাহমুদ হাসান বলেন, “দিনে দিনে পোশাক রপ্তানির পরিমাণ বাড়তে দেখা গেলেও মালিকদের লাভের মার্জিন অনেক কমে গেছে। পোশাক কারখানা বন্ধ করে রাখলে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া সম্ভব হবে না বিধায় সামান্য লাভেও মালিকরা কাজ নিচ্ছেন। অনেকে এই প্রক্রিয়ায় লোকসান দিতে দিতে শেষ হয়ে যাচ্ছেন।”

বিজিএমইএকে উকিল নোটিস

বিজিএমইএ ভবন খালি করতে আরও এক বছর সময় চেয়ে করা আবেদন প্রত্যাহারে তিন দিনের সময় বেঁধে দিয়ে উকিল নোটিস পাঠানো হয়েছে সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানকে।  

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও হাই কোর্টে বিজিএমইএ’র ভবন ভাঙা প্রশ্নে মামলার অ্যামিকাস কিউরিয়া মনজিল মোরসেদ বুধবার ডাকযোগে এ নোটিস পাঠান।

এদিকে আপিল বিভাগে এই ধরনের আবেদন করার কথা অস্বীকার করেছেন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান।

বিজিএমইএ ভবন খালি করা ও ভাঙার জন্য এর আগে অনেকবার সময় নিয়েছিল সংগঠনটি। গত বছরের ২ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে অঙ্গীকারনামা দিয়ে শেষ বারের মতো এক বছরের সময় নেয় তারা; যা চলতি মাসের ১২ এপ্রিল পর্যন্ত ছিল।

মনজিল মোরসেদ বলছেন, “কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের অফিস রেকর্ডে দেখা গেছে, বিজিএমইএ ভবন খালি করতে আরও এক বছর সময় চেয়ে একটি আবেদন করা হয়েছে; যা আপিল বিভাগের গত বছরের ২ এপ্রিলের সিদ্ধান্তের স্পষ্ট লঙ্ঘন।

“আপনি (সিদ্দিকুর) এ আবেদন করে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা এবং আপনার দেওয়া অঙ্গীকারনামা লঙ্ঘন করে ন্যায় বিচারের কার্যকারিতাকে কলঙ্কিত করে আদালত আবমাননার অপরাধ করেছেন।”

হাতিরঝিলে অবৈধভাবে গড়ে তোলা বিজিএমইএর এই ভবন ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু করেছে রাজউক। মঙ্গলবার ১৫ তলা ভবনটি খালি করা হয়েছে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

সময় বাড়ানোর ওই আবেদনটি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যাহার না করলে আদালত অবমাননার মামলার হুমকি দিয়েছেন মনজিল মোরসেদ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান গত ১১ এপ্রিল অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড আইনজীবী বিভাস চন্দ্র বিশ্বাসের মাধ্যমে এক বছরের সময় আবেদন করেন, যার শুনানি এখনও হয়নি।

“ফলে তাকে উকিল নোটিস পাঠিয়েছি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আবেদনটি প্রত্যাহার করার জন্য। নইলে আদালত অবমাননার মামলা করা হবে।”

এদিকে সুপ্রিম কোর্টে ওই আবেদনের শুনানির আগেই মঙ্গলবার কারওয়ান বাজারের ভবনটি খালি করে দিতে হয়েছে বিজিএমইএকে। ওই ভবনটি ভাঙার জন্য নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সিলগালা করে দিয়েছে রাজউক।

মতবিনিময় সভায় আপিল বিভাগে আবেদন নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে সিদ্দিকুর বলেন, “আমি মহামান্য আদালতের কাছে আপনাদের মাধ্যমে বিচার চাইছি, কারা এই আবেদন দিল।

“যেহেতু আমি মুচলেকা দিয়েছিলাম যে সরে যাব, আমি সময় অনুযায়ী সরে গেছি। বিজিএমইএ সভাপতি হিসেবে আমি কোনো আবেদন দিইনি।”