এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছয়টি ইউনিট থেকে ১২৩২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এসেছে ১৭ এপ্রিল।
Published : 21 Apr 2024, 01:38 AM
যান্ত্রিক দক্ষতা ও সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিবেচনায় এগিয়ে থাকা দেশের সর্ববৃহৎ গ্যাসভিত্তিক আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানির অভাবে সক্ষমতার অনেকটুকুই কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
এবারের গ্রীষ্মে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা আগের চেয়ে বাড়বে অনেক বেশি; ভোগাতে পারে লোড শেডিংও। এমন পরিস্থিতিতে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পেলে সক্ষমতার পুরোটাই জানান দিতে চায় ছয় ইউনিটের আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্র।
গরমের মওসুমে ২০২৩ সালে দেশে দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা ১৬ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তখন জ্বালানির অভাবে উৎপাদন সক্ষমতা কাজে লাগাতে না পারায় লোড শেডিংয়ে নাকাল হতে হয়েছে ভোক্তাদের। এক দিন সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গিয়েছিল গতবার।
এবার চাহিদা ১৮ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা বিদ্যুৎ বিভাগের। সে কারণে গ্যাসের প্রয়োজনীয় যোগান দিয়ে এমন সাশ্রয়ী ও বড় ধরেনের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সুফল পাওয়ার দিকে নজর দিয়েছে সরকার।
শনিবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ আশুগঞ্জ পাওয়ার পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেডের উৎপাদন ইউনিটগুলো পরিদর্শন করেন। এ সময় বিদ্যুৎকেন্দ্রের পূর্ণ সুফল পেতে করণীয় নিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তিনি।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, “এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ১৬০০ মেগাওয়াটের বেশি। যেহেতু এখানে গ্যাস কম দেওয়া হচ্ছে এজন্য উৎপাদন কম হচ্ছে। ট্রান্সমিশনেরও কিছু অসুবিধা আছে। তারা পুরোপুরি লোড নিতে পারে না। সেই বিষয়গুলো দেখার জন্য আমি এখানে এসেছে।
“এখানে ৬টা বিদ্যুৎকেন্দ্র মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ সালে উদ্বোধন করেছেন। এগুলো খুবই ইফিশিয়েন্ট পাওয়ার প্লান্ট। এই সুযোগটা আমাদের নিতে হবে। যেভাবেই হোক এখানে গ্যাসের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।”
কম খরচে এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ থাকার পরও পুরো উৎপাদন সক্ষমতা কাজে লাগানো না যাওয়ার প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে তিনি বলেন, পিজিসিবি সঠিক সময়ে সমস্যাগুলো দেখেনি। তাদের আরও দ্রুততার সঙ্গে কাজ করা উচিত ছিল। যেই মাত্রায় উৎপাদন ইউনিটগুলো চালু হয়েছে, বিতরণ লাইনগুলো প্রস্তুত হয়েছে, সেই গতিতে পিজিসিবি তৈরি হয়নি।
“গ্যাসের প্রাপ্তির উপর এবার গরমের মওসুমের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের বিষয়টি নির্ভর করছে। বেসরকারি খাতের যারা এইচএফও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আছে তাদেরকে পূর্ণ ক্যাপাসিটিতে চালাতে বলেছি। কিন্তু এখানে বড় বিষয় হলো ফাইন্যান্স। আমাদের অন্যান্য সক্ষমতা এখন আছে। প্রায় ১৯ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি বিদ্যুৎ এখন আমি দিতে পারব। কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্লান্ট হাতে আছে। এখন তাদেরকে আর্থিক সাপোর্ট দেওয়াই হলো মূল চ্যালেঞ্জ।“
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে মেঘনা নদীর পাড়ে ১৯৬৬ সালে ৩১১ একর জমির ওপর গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। ফলে এটি দেশের অন্যতম প্রাচীন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। যাত্রা শুরুর কয়েক দশকজুড়ে সেখানে উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১২৮ মেগাওয়াট।
২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আশুগঞ্জে ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে মোট ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে নির্মাণ করা হয়েছে যেগুলোর মোট উৎপাদন সক্ষমতা ১৫৮৪ মেগাওয়াট। উৎপাদন সক্ষমতায় সবার উপরে অবস্থান করা এই বিদ্যুৎকেন্দ্রকে এনার্জি হাব বলা হয়।
পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, গত ১৭ এপ্রিল এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছয়টি ইউনিট থেকে ১২৩২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এসেছে জাতীয় গ্রিডে।
এ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইদ একরাম উল্লা বলেন, আশুগঞ্জের ছয়টি ইউনিটের জন্য ২৩০ এমএমসিএফডি গ্যাসের বরাদ্দ আছে। এখানে উৎপাদন সক্ষমতা ১৫৮৪ মেগাওয়াট হলেও গ্যাসের অভাবে তা সম্ভব হয় না। তবে বর্তমানে গ্যাসের প্রাপ্তি কিছুটা বেড়েছে।
”যে পরিমাণ গ্যাস বরাদ্দ আছে তার পুরোটা পাওয়া গেলে আমরা আরও ২০০ মেগাওয়াট বেশি বিদ্যুৎ অর্জন করার সুযোগ রয়েছে। বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানির সাথে আমরা কথা বলেছি; তারা চেষ্টা করছে। এই মুহূর্তে ১২০০ মেগাওয়াট চলছে, সেটা আমরা ১৬০০ মেগাওয়াটে নিয়ে যেতে পারব।”
দৈনিক ২৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন হলেও তা পাওয়া যায় না জানিয়ে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের নির্বাহী পরিচালক আব্দুল মজিদ বলেন, এই মুহূর্তে ১৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রাপ্তির বিপরীতে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।
”এই কেন্দ্রগুলো থেকে গড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিয়ে যাচ্ছি। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাওয়া গেলে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব।”
এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউনিট প্রতি উৎপাদন ব্যয় ৫ টাকা ০৬ পয়সা যেখানে গড়ে জ্বালানি খরচ ৩ টাকা ০৯ পয়সা। পিডিবির কাছে এই কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুতের গড় মূল্য বা ট্যারিফ ৫ টাকা ৭১ পয়সা।
লোডশেডিং কি ঠেকানো যাবে?
ঈদের ছুটিতে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল দৈনিক ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে। এখন ঈদের ছুটি শেষ হয়েছে। কলকারখানা চালু হওয়ার সময়ও এসে গেছে। ইতোমধ্যে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করেছে।
দেশব্যাপী বিদ্যুতের চাহিদা ও যোগানের দায়িত্বে থাকা ন্যাশনাল লোড ডেসপাস সেন্টার এনএলডিসির শনিবার রাত ৯টার তথ্য অনুযায়ী, দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ১৫ হাজার ৭৫০ মেগাওয়াটের বিপরীতে ওই সময় উৎপাদন হয়েছে ১৫ হাজার ৩৫৮ মেগাওয়াট। লোডশেডিং ছিল ৩৩৪ মেগাওয়াট।
এ সময় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে ৭ হাজার ৮৮৬ মেগাওয়াট, এইচএফও বা তরল জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে ২ হাজার ৬৬৬ মেগাওয়াট, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে ৩ হাজার ৮৮২ মেগাওয়াট, জলবিদ্যুৎ থেকে ৩০ মেগাওয়াট এবং বায়ু বিদ্যুৎ থেকে ৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছিল।
দেশে দিনের বেলায় এখন সৌর বিদ্যুৎ থেকেও ৪৫৫ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। বায়ু বিদ্যুৎ থেকেও মাঝে মধ্যে ৫০ মেগাওয়াট পাওয়া যাচ্ছে।
পায়রা, মাতারবাড়ি, বাশখালী ও রামপালে স্থাপিত চারটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবার উৎপাদনে রয়েছে। মাতারবাড়ি, বাঁশখালী নতুন করে সঞ্চালন লাইনে যুক্ত হয়েছে। ফলে এই দুই কেন্দ্রের বাড়তি প্রায় ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এবার বাড়তি যোগ হওয়ার তথ্য দিচ্ছেন কর্মকর্তারা।
এমন পরিস্থিতিতে লোডশেডিং মোকাবেলা কতটা সহজ হবে? জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ”আমাদের চেষ্টা হচ্ছে দেশকে লোডশেডমুক্ত রাখা। এখন আমি ভয় পাচ্ছি যে, মধ্যপ্রাচ্যে যে ক্রাইসিস তৈরি হচ্ছে সেটা আবার আমাদের দেশে নতুন ক্রাইসিস তৈরি করে কি না? এটা একটা বড় বিষয়। সেটাকে মাথায় রেখেই আমাদের কাজ করতে হচ্ছে “
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পর্যাপ্ত অর্থছাড় হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা বন্ড আকারে কিছু টাকা পেয়েছি। আগামী কিছু দিনের মধ্যে আরও কিছু টাকা পাবো। তবে সেটা অতি সামান্য।”
সঞ্চালন লাইনের প্রস্তুতির অভাবে দেশে বিদ্যুতের কিছু উৎপাদন সক্ষমতা অলস পড়ে আছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন। এর প্রভাব পড়ছে লোড শেডিংয়ে।
এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বাঁশখালী, মাতারবাড়ির দুটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। সঞ্চালন লাইনের প্রস্তুতির অভাবে বাঁশখালী এসএস পাওয়ার ও মাতারবাড়িতে কোল পাওয়ার কোম্পানির বিদ্যুৎকেন্দ্র সক্ষমতার অর্ধেক উৎপাদন করছে।
এ বিষয়ে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ.কে.এম গাউছ মহীউদ্দিন আহমেদ বলেন, আগামী জুলাইয়ের মধ্যেই বাঁশখালী ও মাতারবাড়ি অংশের সমস্যার সমাধান হবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ’ইভাকোয়েশনের’ জন্য গোপালগঞ্জ থেকে সঞ্চালন লাইন টানা হয়েছে। এখন ’রিভার ক্রসিংয়ের’ জন্য মাত্র চারটি খুঁটি স্থাপন করা বাকি। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে তা সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।