গ্যাস উত্তোলনে বড় অংকের বিনিয়োগ দরকার: নসরুল

“সোলার ও জলবিদ্যুৎ হচ্ছে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি, বিশ্ব সেদিকে যাচ্ছে; আমাদেরও সেদিকে যেতে হবে,’’ বলেন তিনি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 May 2023, 02:15 PM
Updated : 20 May 2023, 02:15 PM

শিল্পে ও আবাসিকে চলমান গ্যাস সংকট কাটিয়ে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ পেতে সাগরতলের গ্যাস আহরণ ও নতুন গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধানে আবারও তাগিদ এল এক সেমিনারে।

এর জবাবে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বললেন, গভীর সমুদ্রে গ্যাস আহরণ করতে ১০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। এত বিনিয়োগ কই? 

শনিবার দুপুরে মতিঝিলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি আয়োজিত ‘স্টেকহোল্ডারস ডায়লগ অন এনার্জি স্ট্রাটেজি; টুওয়ারডস অ্যান্ড প্রেডিক্টেবল ফিউচার’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ কথা জানান।

সাগরতীর ও মহীসোপানে গ্যাসের মজুদ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই উল্লেখ করে সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অনারারি প্রফেসর বদরুল ইমাম বলেন, “বিদেশি কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, সাগরে ৩২ থেকে ৪২ টিসিএফ গ্যাস রয়েছে। প্রতিবছর আমাদের প্রয়োজন হয় ১ থেকে সর্বোচ্চ দেড় টিসিএফ। জরুরিভিত্তিতেই এসব গ্যাস আহরণ করা উচিত।’’

ব-দ্বীপ রাষ্ট্র হওয়ায় যেসব এলাকা থেকে দ্রুত গ্যাস আহরণ করা যাবে, সেসব এলাকা থেকে আগে গ্যাস তুলতে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘প্রথমে সাগর তীরবর্তী ও পরের ধাপে গভীর সমুদ্রের পানির নিচে জমে থাকা গ্যাস তুলতে হবে।’’

এমন পরামর্শের জবাবে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘‘গ্যাস ইজ দেয়ার, কিন্তু আমাদের জানতে হবে কতটুকু আছে। কেউ বলছে ৩২, আবার কেউ বলছে ৪২ টিসিএফ। তাহলে আমরা পরিকল্পনা নিব কীভাবে?

‘‘একটি কূপ থেকে গ্যাস তুলতে ১ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার লাগে। আমাদের লোক লাগবে, মানি লাগবে। কিন্তু এই ডলার এখন নেই।"

গভীর সমুদ্রে গ্যাস আহরণ করতে ১০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘এত ইনভেস্ট কই, গভীর সমুদ্রের তলদেশ থেকে গ্যাস আহরণ করতে হলে তিন হাজার মিটার নিচে যেতে হবে। প্রয়োজন টুডি, থ্রিডি সার্ভে। এই সার্ভে মেশিন আমাদের নেই বা সক্ষমতাও নেই।”

গোটা দশেক বিদেশি কোম্পানি গভীর সমুদ্র থেকে গ্যাস তুলতে বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমরা আলোচনা করছি তাদের সঙ্গে। পাশাপাশি দেশের বেসরকারি খাতকেও এতে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা করছি।

‘‘২০২৪ সালে গভীর সমুদ্রবন্দরের নির্মাণ কাজ শেষ হবে। তারপর এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করা সম্ভব হবে। তখন গ্যাস আমদানি আরও সহজ ও সরবরাহ সহজ হবে। তখন চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস দেওয়া যাবে।’’

নসরুল হামিদ বলেন, “করোনাভাইরাসের পর গ্যাসের চাহিদা বেড়েছে দ্রুত, যা আমরা ভাবতে পারিনি। আমরা মনে করেছিলাম, ১২ শতাংশ হারে প্রতি বছর বাড়বে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি বেড়েছে। এখনও অনেক শিল্প কারখানা গ্যাস সংযোগ চাচ্ছে।”

বড় বড় অনেক শিল্প কারখানাতেও অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে বলে জানান তিনি।

শিল্পে গ্যাসের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করতে অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প স্থাপনের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমরা পরিকল্পনা করেছি সেখানে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করব। যদি চুক্তি অনুযায়ী গ্যাস বা বিদ্যুৎ সরবরাহ না হয়, তাহলে রিবেট থাকবে। আবার চুক্তি অনুযায়ী গ্রাহক গ্যাস-বিদ্যুৎ না নিলে তাকেও চার্জ দিতে হবে।’’

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘‘পরিচ্ছন্ন জ্বালানির দিকে যাচ্ছে বিশ্ব। আমাদেরও সেদিকে যেতে হবে। এজন্য আমরা পরিকল্পনা নিয়েছি সোলার ও বিকল্প জ্বালানিতে।’’

আগামীতে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহে সঞ্চালন লাইন স্থাপন বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সরকারিভাবে এটি করতে অনেক সময় লাগে। বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিলে তাতে সময় কম লাগবে। আমরা গ্যাস খাত বেসরকারি খাতের জন্য উন্মুক্ত করছি। সরকারি-বেসরকারি অংশিদারীত্বের গ্যাস আমদানি ও সরবরাহ ব্যবস্থা পরিচালনা করা হবে।’’

সেমিনারে তৈরি পোশাক শিল্প কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, “দাম বাড়ানোর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ। যারা অবৈধ সংযোগ করছেন, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এখানে অনেক রাজনৈতিক কারণও রয়েছে অবৈধ সংযোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে।

‘‘শিল্প রক্ষায় এসব অবৈধ সংযোগ বন্ধ করতে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ কাজে বিজিএমইএ সহযোগিতা করবে সরকারকে।’’

আমদানি করা গ্যাসের মজুদ সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি নাসের এজাজ বিজয় বলেন, ‘‘বাজারভিত্তিক জ্বালানির দর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে হলে জ্বালানির দর নির্ধারণ আরও স্বচ্ছতার সঙ্গে হওয়া প্রয়োজন।

‘‘জ্বালানির দর বৃদ্ধি নিয়ে সরকারের একটি রোডম্যাপ থাকা প্রয়োজন, যাতে করে ব্যবসায়ীরা বুঝতে পারেন কোন সময়ে কতোটুকু দর বাড়বে।’’

বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের (বিপ্পা) প্রেসিডেন্ট ও সামিট গ্রুপের পরিচালক ফয়সাল খান বলেন, ‘‘বেসরকারি পর্যায়ে এলএনজি আমদানিতে কর ছাড় দেওয়া প্রয়োজন। এখন জরুরি হচ্ছে- দর বৃদ্ধির চেয়ে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ।’’

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসান খান চৌধুরী বলেন, “আমাদের ব্যবসায় সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। আপনার (জ্বালানি) মন্ত্রণালয়েরও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। জ্বালানি নিয়ে আমাদের আজকের যে কষ্ট- তা আপনার মন্ত্রণালয়ের জন্য। আমরা নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি চাই। প্রয়োজনে বৈশ্বিক পর্যায়েও আমরা ব্যবসায়িক সক্ষমতা বাড়াব।’’

ডিসিসিআই সভাপতি সামির সাত্তারের সঞ্চালনায় সভায় এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘‘বৈশ্বিক কারণে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে, যা জনগণকে ভোগাচ্ছে। আগামীতে সুদহার বাড়লে ব্যবসা-বাণিজ্য খরচ বাড়বে। এজন্য সরকারের নীতি সমন্বয় করা প্রয়োজন।’’

ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে গত ১২ মে রাতে মহেশখালীর ভাসমান দুটি টার্মিনাল থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়।

এর মধ্যে একটি সচল হয়েছে জানিয়ে সভা শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “এখন যে গ্যাস পাচ্ছি, তা রেশনিং করে দিচ্ছি। আরও ১০ দিন লাগবে; তারপর আবাসিক ও শিল্পে চলমান গ্যাস সংকট কিছুটা কমে আসবে।

“…আন্তর্জাতিক বাজার দর অনুযায়ী জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম সমন্বয় করা হবে প্রতিবছর।”