সিটিসেলের হাত ধরে বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের যাত্রা শুরু হয়েছিল।
Published : 15 Mar 2023, 07:38 PM
সাত বছর ধরে বন্ধই রয়েছে সিটিসেল, এবার লাইসেন্সও বাতিল হল মোবাইল অপারেটরটির।
এর মধ্য দিয়ে সিটিসেল অধ্যায়ের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটছে, যার হাত ধরে বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের যাত্রা শুরু হয়েছিল।
পাওনা শোধ করতে না পারায় সিটিসেলের লাইসেন্স চূড়ান্তভাবে বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। এখন তা সিটিসেলকে জানিয়ে দেওয়ার পালা বিটিআরসির।
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ-বিটিআরসির লিগ্যাল ও লাইসেন্সিং বিভাগের মহাপরিচালক আশীষ কুমার কুন্ডু বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মন্ত্রণালয় থেকে সিটিসেলের লাইসেন্স বাতিলের অনুমোদনের চিঠি আমরা পেয়েছি। শিগগিরই সিটিসেলকে লাইসেন্স বাতিলের চিঠি পাঠানো হবে।”
বিটিআরসির পাওনা ২১৮ কোটি টাকা পরিশোধ না করায় সিটিসেলের লাইসেন্স বাতিল করা হল।
১৯৮৯ সালে বাংলাদেশের প্রথম মোবাইল ফোন অপারেটর হিসেবে লাইসেন্স পেয়েছিল বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (বিটিএল), যা পরে মালিকানার হাতবদলে সিটিসেল নাম নেয়।
লাইসেন্স নেওয়ার পরের বছর হংকং হাচিসন টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেড এ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে বিটিএল নাম বদলে হয় হাচসন বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (এইচবিটিএল)।
১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় আবার পরিবর্তন আসে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খানের মালিকানাধীন প্যাসিফিক মটরস ও ফারইস্ট টেলিকম মিলে এইচবিটিএল-এর শেয়ার কিনে নেয়। কোম্পানির নাম বদলে হয় প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড, ব্র্যান্ডিং শুরু হয় সিটিসেল নামে। পরে ২০০৪ সালে এ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে সিঙ্গাপুরের সিংটেল।
প্যাসিফিক মটরস যখন সিটিসেলের মালিকানায় আসে, মোরশেদ খান তখন মন্ত্রীর পদমর্যাদায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিনিয়োগ বিষয়ক বিশেষ দূতের দায়িত্বে। আর এইচ এম এরশাদ সরকারের সময়ে সিটিসেল যখন লাইসেন্স পায়, মোরশেদ খান তখন ছিলেন জাতীয় পার্টির কোষাধ্যক্ষ।
দেশে সিডিএমএ প্রযুক্তির একমাত্র মোবাইল অপারেটর ছিল সিটিসেল। ২০১৭ সালের ১১ জুন বিটিআরসি সিটিসেলের তরঙ্গ বন্ধ করে দেওয়ার সময় এর কয়েক লাখে নেমে এসেছিল।
টেলিকম সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভালো বিনিয়োগকারী জোটাতে না পারা, প্রযুক্তিগত দূরদৃষ্টি ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় দক্ষ নেতৃত্বের অভাব এবং প্রতিষ্ঠানিক দুর্নীতির কারণে ডুবেছে সিটিসেল।
ঘটনাক্রম
পৌনে পাঁচশ কোটি টাকা বকেয়া পরিশোধের জন্য কয়েক দফা তাগাদা দিয়েও তা না পেয়ে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে সিটিসেলের কার্যক্রম বন্ধ করার উদ্যোগের কথা জানায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। পরের মাসে সিটিসেলকে নোটিস দেওয়া হয়।
ওই নোটিসের বিরুদ্ধে সিটিসেল হাই কোর্টে যায়। ওই বছরের ২২ অগাস্ট হাই কোর্টের আদেশে বলা হয়, নোটিসের জবাব দিতে বিটিআরসি যে এক মাস সময় দিয়েছিল, ওই সময় পর্যন্ত সিটিসেলকে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
হাই কোর্টের ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যায় বিটিআরসি। ২৯ অগাস্ট আপিল বিভাগের আদেশে দেনা শোধের জন্য সিটিসেলকে দুই মাস সময় দেয় আপিল বিভাগ। বিটিআরসির পক্ষ থেকে বলা হয়, বকেয়া ৪৭৭ কোটি টাকার মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ প্রথম এক মাসে এবং এক তৃতীয়াংশ পরবর্তী এক মাসে পরিশোধ করতে হবে।
এছাড়া ১৭ অগাস্টের পর থেকে প্রতিদিন বিটিআরসির কাছে পাওনা হওয়া ১৮ লাখ টাকা করে অবিলম্বে পরিশোধের নির্দেশ দিয়ে আদালত বলে, টাকা না পেলে বিটিআরসি যে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে।
২০ অক্টোবর সিটিসেলের তরঙ্গ স্থগিত করে বিটিআরসি। মহাখালীতে সিটিসেলের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেন বিটিআরসি কর্মকর্তারা।
টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম সেদিন জানান, একমাসের প্রথম কিস্তিতে নির্ধারিত ৩১৮ কোটি ৪২ লাখ টাকার মধ্যে সিটিসেল মাত্র ১৩০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।
এরপর সিটিসেল তরঙ্গ বাতিলের সিদ্ধান্ত স্থগিত বা পুনরায় তরঙ্গ বরাদ্দের নির্দেশনা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে যায়। শুনানি শেষে আদালত গতবছর ৩ নভেম্বর আদেশের দিন রাখে। ৩ নভেম্বর সিটিসেলের তরঙ্গ খুলে দিতে বলা হয়।
৩ নভেম্বরের শুনানিতে বিটিআরসি তাদের দাবির পরিমাণ কমিয়ে ৩৯৭ কোটি টাকায় নিয়ে আসে। কিন্তু ওই অংক নিয়েও সিটিসেল আপত্তি তোলে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় কিস্তিতে সিটিসেলকে কত টাকা দিতে হবে তা নির্ধারণ করে দেয় আদালত। বলা হয়, ১৯ নভেম্বরের মধ্যে সিটিসেল ১০০ কোটি টাকা না দিলে বিটিআরসি আবার তরঙ্গ বন্ধ করে দিতে পারবে।
এছাড়া আদালত বিটিআরসির সঙ্গে সিটিসেলের বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক ভিসি অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়। ওই কমিটিকে এক মাসের মধ্যে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে বলা হয়।
তিন দিনেও তরঙ্গ ফিরে না পেয়ে ৬ নভেম্বর ফের আদালতে যায় সিটিসেল। তাদের আবেদনের শুনানি করে এ বিষয়ে বিটিআরসির ব্যাখা জানতে চায় আপিল বিভাগ। ওইদিন সন্ধ্যায় বিটিআরসির কর্মকর্তারা সিটিসেলে গিয়ে তরঙ্গ ফিরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করেন। কিন্তু এরপর রাজধানীর মহাখালী এলাকার বাইরের সিটিসেল গ্রাহকরা কোনো সেবা বা সংযোগ পাচ্ছিলেন না।
সিটিসেলের আইনজীবী আহসানুল করিমের ভাষ্য অনুযায়ী, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ১৯ নভেম্বরের আগেই ১০০ কোটি টাকা পরিশোধ করে সিটিসেল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তারপরও চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল সিটিসেলকে কারণ দর্শাও নোটিস দেয় বিটিআরসি। কেন তাদের তরঙ্গ বন্ধ করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় সেখানে।
সিটিসেল ওই নোটিসের জবাব দিলেও ‘যথাযথ কারণ উল্লেখ না করেই’ গত ১১ জুন বিটিআরসি সিটিসেলের তরঙ্গ বন্ধ এবং রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি লাইসেন্স বাতিল করে দেয় বলে আইনজীবীর ভাষ্য।