‘কৌশলগত ভুলে’ খাদে সিটিসেল

সরকারের কাছে বকেয়ার ভারে বন্ধ হওয়ার পথে থাকা মোবাইল অপারেটর সিটিসেলের এই পরিস্থিতির পেছনে ‘কৌশলগত ভুল’ দেখছেন টেলিকম খাতের বিশেষজ্ঞরা।

শামীম আহমেদ জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 August 2016, 05:18 PM
Updated : 3 July 2017, 02:25 PM

তারা বলছেন, সুযোগ থাকার পরও নেতৃত্বের দূরদৃষ্টির অভাব, প্রতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এবং বিনিয়োগের ব্যর্থতা প্রতিষ্ঠানটির পতনের জন্য দায়ী।

সিটিসেলের কয়েকজন সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অভিমতও তাই। 

টেলিকম খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি সিটিসেলকে ১৬ অগাস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে তরঙ্গ বাতিল ও অপারেশনাল কার্যক্রম বন্ধসহ প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে দিয়েছে।

অবশ্য ‘খাদের কিনারা’ থেকে উঠে আসার স্বপ্ন দেখছে সিটিসেল; সরকারের পাওনা পরিশোধে সময় চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

সিটিসেল পরিচালনাকারী প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মেহবুব চৌধুরীও নিজেদের কৌশলগত ভুল স্বীকার করেছেন।

মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়ন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “জিএসএমে না যাওয়া সিটিসেলের একটা বড় ভুল ছিল। সময় মতো সে সুযোগ না নেওয়ায় আজকের এই ফল।

“লাইসেন্স নবায়নের সময় টেকনোলজি নিউট্রালিটির (যে কোনো সেবা দেওয়া) লাইসেন্স পেয়েছি। তবে জিএসএমে যাওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করতে না পারায় তরঙ্গ বুঝে পাইনি। জিএসএম-এ না যাওয়ায় অসুবিধা হচ্ছে।”

টাকা জমা সাপেক্ষে যে কোনো সময় জিএসএম-এ যাওয়ার কথা রয়েছে জানিয়ে মেহবুব বলেন, “তবে বিটিআরসি তরঙ্গ নিয়ে পরিষ্কার করছে না। আমাকে ১০ (মেগাহার্টজ তরঙ্গ) দেওয়ার কথা সেখানে দিতে চাচ্ছে ৬ দশমিক ৫ বা ৮।”

লাইসেন্সে ফিক্সড ফোনের সুযোগ থাকলেও ওই সময় এ ব্যবসায় না যাওয়ায় তেমন ক্ষতি হয়নি বলে তার দাবি।

মেহবুব চৌধুরী

তৃতীয় প্রজন্মের মোবাইল প্রযুক্তির সেবার নিলামের জন্য যোগ্য বিবেচিত হয়েও দুই কোটি ডলারের আর্নেস্ট মানি জমা দিতে না পারায় থ্রিজি সেবা থেকে সরে আসে ১৯৮৯ সালে মোবাইল ও ফিক্সড ফোনের লাইসেন্স পাওয়া সিটিসেল।

২০১২ সালে লাইসেন্স নবায়নের সময় সিডিএমএ (কোড ডিভিশন মাল্টিপল অ্যাকসেস) থেকে মাত্র ২০০ কোটি টাকায় জিএসএম (টুজি বা দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তি) প্রযুক্তিতে যাওয়ার সুযোগও পেয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। 

বর্তমানে তরঙ্গ ফি বাবদ প্রতিষ্ঠানটির কাছে বিটিআরসির পাওনা ২২৯ কোটি টাকা।

১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (বিটিএল) নামে টেলিকম সেবা পরিচালনার লাইসেন্স পায় বর্তমান সিটিসেল। পরের বছর হংকং হাচিসন টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেড এ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে বিটিএল নাম বদলে হয় হাচসন বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (এইচবিটিএল)।

১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় আবার পরিবর্তন আসে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খানের মালিকানাধীন প্যাসিফিক মটরস ও ফারইস্ট টেলিকম মিলে এইচবিটিএল-এর শেয়ার কিনে নেয়। কোম্পানির নাম বদলে হয় প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড, ব্র্যান্ডিং শুরু হয় সিটিসেল নামে। পরে ২০০৪ সালে এ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে সিঙ্গাপুরের সিংটেল।

প্যাসিফিক মটরস যখন সিটিসেলের মালিকানায় আসে, মোরশেদ খান তখন মন্ত্রীর পদমর্যাদায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিনিয়োগ বিষয়ক বিশেষ দূতের দায়িত্বে। আর এইচ এম এরশাদ সরকারের সময়ে সিটিসেল যখন লাইসেন্স পায়, মোরশেদ খান তখন ছিলেন জাতীয় পার্টির কোষাধ্যক্ষ।

সিটিসেলের বর্তমান হাল নিয়ে কথা হয় সাবেক কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে। তাদের প্রত্যেকেই ভালো বিনিয়োগকারী জোটাতে না পারা, প্রযুক্তিগত দূরদৃষ্টি ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় দক্ষ নেতৃত্বের অভাব এবং প্রতিষ্ঠানিক দুর্নীতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন।

তাদেরই একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দিন দিন প্রযুক্তি এগোলেও সিটিসেল সেদিকে মন দেয়নি। সব সুযোগ থাকার পরেও তারা এগোতে পারেনি। কারণ প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় দক্ষ নেতা নেই।

“অর্থ সঙ্কটে ভুগতে থাকলেও সিটিসেল ভাল বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করে তুলতে পারেনি, এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিও অনেকাংশে দায়ী।”

মোবাইল টেলিকম অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটবের সাবেক মহাসচিব আবু সাঈদ খান মনে করেন, ফিক্সড ও মোবাইল লাইসেন্স থাকার পরও সিটিসেল বছরের পর বছর ফিক্সড লাইসেন্স ‘অবহেলা’ করে গেছে। সে সময় যে চাহিদা ছিল তা কাজে লাগালে প্রতিষ্ঠানটি ‘অনেক এগিয়ে যেতে’ পারত।

তার ভাষায়, “সিটিসেলের সবই ছিল, তবে তাদের স্ট্র্যাটেজিক ভিশনারি ছিল না। সিডিএমএ কাভারেজ এরিয়া জিএসএম-এর চেয়ে অনেক বেশি, থ্রি জি লাইসেন্স দেওয়ার আগেই তারা থ্রি জি প্রযুক্তি নিয়ে বসে ছিল, অথচ তারা সে সুযোগ নেয়নি।

“তাদের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য সিংটেলের মত স্বনামধন্য অপারেটর শেয়ার পেয়েও তারা কাজে লাগাতে পারেনি।”

তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলো আবু সাঈদ সিটিসেলের বর্তমান অবস্থার জন্য প্রতিষ্ঠানটির সিইও মেহবুব চৌধুরীরও সমালোচনা করেন।

সিটিসেলের একজন সাবেক কর্মকর্তার অভিযোগ, মেহবুব চৌধুরী সিইও হিসেবে যোগ দেওয়ার পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটির ‘অধঃপতন শুরু’ হয়।

২০১০ সালে মেহবুব চৌধুরী সিটিসেলের সিইওর দায়িত্ব নেওয়ার সময় এর গ্রাহক প্রায় ২৩ লাখ থাকলেও গত জুনে গ্রাহক সংখ্যা ৭ লাখে নেমেছে।

এসব বিষয়ে মেহবুব চৌধুরী বলেন, “বিনিয়োগ আনতে পারিনি এটা ঠিক, তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানি ইতোমধ্যে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।”

যুক্তরাষ্ট্রের কোন কোম্পানি সিটিসেলে বিনিয়োগ করতে চায় তা বলতে রাজি হননি তিনি।

২০১০ সালে সিটিসেলের প্রধান নির্বাহী হিসেবে যোগ দেওয়ার পর থেকেই নতুন বিনিয়োগের কথা বলছিলেন মেহবুব। শিগগিরই তা আসছে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “এ মাসের শেষ নাগাদ বিনিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করি, এ অবস্থা থেকে ফিরে আসব।”

সিটিসেল বন্ধে সরকারি উদ্যোগের মধ্যে নতুন বিনিয়োগকারী আসবে কি না- এ প্রশ্নে সিইও বলেন, “গ্রাহক না থাকলেও এটি বিনিয়োগের ভাল একটি নতুন ক্ষেত্র। কারণ আগামীতে ফোর জি নিলাম রয়েছে, ফোর জি নিয়ে এ প্রতিষ্ঠান খুব সহজেই এগিয়ে যেতে পারবে।”

সরকারের ৪৭৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা পাওনা থাকা প্রসঙ্গে মেহবুব বলেন, “বিনিয়োগ আসা মাত্র এ বকেয়া পরিশোধ সম্ভব হবে বলে আশা করছি, সব নিয়ম অনুযায়ীই হবে।”

সিইওর দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৭ লাখ গ্রাহক হারানোর ঘটনায় প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিজেকে ব্যর্থ মনে করেন কিনা- এ প্রশ্নে মেহবুব চৌধুরীর উত্তর, “প্রশ্নই উঠছে না।”

তিনি বলেন, “আমার অতীত ইতিহাস দেখতে পারেন। ২০০৪ সালে আমি যখন বাংলালিংকের সিসিও ছিলাম, এত অপদার্থ যদি হতাম, তখন ১০ মাসে ১০ লাখের বেশি গ্রাহক তৈরি করলাম কীভাবে?”

সিটিসেলের জিএসএম-এ না যাওয়ার সিদ্ধান্তকে ভুল বললেও সেটা তার সিদ্ধান্ত ছিল না দাবি করে মেহবুব চৌধুরী বলেন, জিএসএম-এ না গিয়ে থ্রিজিতে যাওয়া যায় না।

প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, “এ ধরনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এখানে নেই। যারা বলছে তারা অজ্ঞ। এই প্রতিষ্ঠানে যারা বিনিয়োগ করেছে তারা সরকারের অনুমতি নিয়েই করেছে। ব্যবসা দেখেই তারা বিনিয়োগ করেন।”

সিটিসেলের সবচেয়ে বেশি ৪৫ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক সিংটেল এশিয়া প্যাসেফিক ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের হাতে। এছাড়া ফারইস্ট টেলিকম লিমিটেড ১৭ দশমিক ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক।

খাদের কিনারা থেকে ওঠে আসতে সরকারের সহযোগিতা প্রত্যাশা করছেন সিটিসেল সিইও মেহবুব চৌধুরী।

“সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন রয়েছে। যে তরঙ্গ সিটিসেলের জন্য বরাদ্দ রয়েছে তা যেন সত্বর দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় যাতে আমরা জিএসএম-এ যেতে পারি। প্রতিযোগিতাপূর্ণ এই বাজারে বিনিয়োগ করতে গেলে কিছু ভরসা দিতে হবে বা ইনসেনটিভ দিতে হবে।”

বিটিআরসি ১৬ অগাস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে সিটিসেলের গ্রাহকদের অন্য অপারেটরে যাওয়ার যে অনুরোধ করেছেন তার সমালোচনা করে তিনি বলেন, “গ্রাহকদের অন্য অপারেটরে চলে যেতে বিটিআরসি যা বলছে, আমরা অবাক হচ্ছি, গ্রাহকরা এমনিতেই পড়ে যাবে। বিটিআরসি চেয়ারম্যান আমাকে বলেছেন- কোনো অবস্থাতেই সিটিসেল বন্ধ করতে বলিনি।

“নিয়ন্ত্রক সংস্থা আমাদের আশ্বাস দিয়েছে, এটি বন্ধ হবে না। বিনিয়োগ আসছে জানিয়ে তাদের কাছে সময় চাওয়া হয়েছে। তারা বলেছে সুবিবেচনা করে দেখবেন।”