মুরগির দর এক বছরের সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকায় ক্রেতারা সন্তুষ্ট। এখন খাবারের দামও কমার অপেক্ষায় খামারিরা।
Published : 02 Jul 2024, 09:48 AM
কোরবানির আগে থেকে কমতে থাকা মুরগির দাম ঈদের পর আরও কমেছে। মুরগির পাশাপাশি কমে এসেছে বাচ্চার দরও, যার ফলে খামারিদের উৎপাদন খরচ ভবিষ্যতে আরও কমে আসবে। তবে খাবারের দাম এখনও বাড়তি, সেটিও কমার আশায় খামারিরা।
ঢাকার কাঁচাবাজারে কেজিপ্রতি ১৬০ থেকে ১৭০ টাকায় নেমেছে ব্রয়লার মুরগির দাম, যা বছরের সর্বনিম্ন বলে সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসাবে দেখা যাচ্ছে।
সোনালি মুরগিও এক মাসে ১০০ টাকার চেয়ে বেশি কমে নেমেছে ৩০০ থেকে ৩১০ টাকা।
টাকা এক দশক স্থিতিশীল থাকার পর ২০২২ সাল থেকে মুরগির দরে উত্থান ঘটে। এই সময়ে বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নিয়ে নানা আলোচনা হয়।
খোদ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজারে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার বিষয়ে বক্তব্য এসেছে, বড় করপোরেট কোম্পানিকে নিয়ে মত বিনিময় হয়েছে। সেখানে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ও হয়েছে।
রোজার ঈদের আগে-পরে মুরগির বাজার ছিল গরম। এক পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগি ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা আর সোনালি মুরগির দর ৪২০ টাকাতেও উঠে যায়।
তবে কোরবানির ঈদের আগ থেকে দর নিম্নমুখী হতে থাকে। ঈদের পর তা কমতে থাকে আরও। খামারিরা বলছেন, এখন যে দর, তাতে তাদের লোকসান হচ্ছে। এই অবস্থায় অনেক কামার বাচ্চা তোলাও বন্ধ করে রেখেছেন বলে খামারিদের পক্ষ থেকে বক্তব্য এসেছে।
বাচ্চার চাহিদা কমার প্রভাবে কমে এসেছে দামও, এই মুহূর্তে এক দিনের বাচ্চা ৩৭ থেকে ৪০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে, যা গত ছয় মাসেও কিনতে পারেননি খামারিরা।
খামারিরা গত দেড় থেকে দুই বছর ধরেই বারবার বাচ্চা ও খাবারের দাম বৃদ্ধি নিয়ে সরব হয়েছিলেন। মাঝে এক দিনের বাচ্চা ১০০ টাকা দিয়েও কিনতে হয়েছে। খাবারের দাম এই সময়ে দেড় গুণেরও বেশি বেড়েছে।
মুরগির খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোরবানিতে মাংস খেয়ে ‘হাঁপিয়ে উঠেছে মানুষ’। এ কারণে এখন চাহিদা কম।
তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়া রেললাইন সংলগ্ন কাঁচাবাজারে আল আমিন গত শুক্রবার ডেকে ডেকে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করছিলেন ১৭০ টাকা কেজি দরে। তবে বেশি নিলে তিনি ১৬৫ টাকা কেজি দরেও দিয়ে দেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মাংসের প্রতি মানুষের যে অনীহা আসছে, সেটা কাটতে কাটতে আরও এক মাস সময় লাগব।”
তার পাশের বিক্রেতা মো. লিটন হোসেন বিক্রি করছিলেন আরও ১০ টাকা কমে, ১৬০ টাকা দরে।
লিটন বলেন, “আমার স্মরণে মুরগির দাম এখন অনেক কম। গত এক বছরে এটাই সর্বনিম্ন দাম।”
বৃহস্পতিবার গুলিস্তান থেকে পাইকারিতে ১৪৫ টাকা কেজি দরে ব্রয়লার কিনেছেন। কেজিপ্রতি ১৫ টাকা মুনাফা দেখা গেলেও কিছু খরচও আছে।
লিটনের কাছ থেকে ২৪০ টাকায় দেড় কেজির একটা মুরগি কিনে রোকসানা পারভীন বলেন, “ঈদের দুইদিন পরে লিটন ভাইয়ের কাছ থেকে আমি ১৮০ টাকা কেজিতে মুরগি নিয়ে গেছি। আর আজ ভাবছি দাম বাড়বে, কিন্তু আরও ২০ টাকা কমে পাইলাম। এই দামটা সবসময় থাকলে আমাদের জন্য খুবই ভালো হয়।”
সেদিন কারওয়ান বাজারে বাংলা চিকেন হাউজে ব্রয়লার মুরগি ১৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন মো. ফয়েজ।
দাম কমার কারণ হিসেবে তিনি বললেন, “মানুষের মুখে মাংস লাইগ্যা রইছে, এখন চাহিদা নাই। তাই দাম কম। আমি কারওয়ান বাজারে আজ ১৮ বছর ধরে মুরগির ব্যবসা করতেছি। এরকম পরিস্থিতি আমি জীবনেও দেখি নাই। ক্রেতাই নাই।”
রোববার একই বাজারের ফারুক চিকেন ব্রয়লার হাউজের বিক্রেতা মোহাম্মদ দুলাল মুরগি বিক্রি করেছেন ১৭০ টাকা করে, সোনালির দাম রেখেছেন ৩০০ টাকা, ৫ কেজি নিলে দিয়েছেন ১৬০ টাকায়।
দাম কমার ধাক্কা খামারে
মুরগির দাম কমায় খামারিরা অবশ্য বিপাকে।
ঢাকার খিলগাঁওয়ের খামারি মো. নুরুদ্দিনের এবার ৪৬ হাজার ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা তুলেছিলেন। এখনো শেডে আছে ৬ হাজার মুরগি।
তিনি শুক্রবার মুরগি বিক্রি করেছেন ১৪০ টাকা কেজি দরে। কিন্তু হিসাবে কেজিতে উৎপাদন খরচ হয় আরও ৩০ টাকার বেশি।
তিনি বলেন, “আমাদের খামারিদের এখন লস হচ্ছে। খিলগাঁওয়ের অনেক খামারি রমজানের ঈদের পর লস খেয়ে খেয়ে খামার বন্ধ করে দিচ্ছে।
“আমরা বাচ্চা কিনছি ৬০ টাকা করে। সেই বাচ্চাকে দেড় কেজি ওজনের করতে আড়াই থেকে তিন কেজি ফিড খাওয়াতে হয়। মেডিসিন, বিদ্যুৎ, পানি আরও আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে উৎপাদন খরচ ১৭১ টাকা।
বাচ্চার দাম কমানোর দাবি করে তিনি বলেন, “এই বাচ্চার দাম আর ফিডের দাম কমলেই সব স্বাভাবিক থাকত, আমাদের হাহাকার করা লাগত না।
“আমরা চাই না মুরগির দাম অতিরিক্ত বেড়ে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাহিরে চলে যাক। তবে আমাদের যেন লসে বেচতে না হয়।”
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের খামারি আলাউদ্দিন সরকারও লোকসানে। এক হাজার মুরগিতে ৪০ হাজার টাকার ক্ষতির হিসাব দিয়েছেন তিনি।
আলাউদ্দিন বলেন, “এজেন্টদের পিছে পিছে ঘুরে, অনেকদিন অপেক্ষা করে বাচ্চা কিনছি ৭০ টাকা করে। সেই বাচ্চা পেলে বড় করে মূলধনটা পর্যন্ত পেলেও আবার উৎসাহ নিয়ে খামার করতাম। কিন্তু খামার গুটিয়ে নিব কিনা ভাবছি।”
খামারি নুরুদ্দিন জানিয়েছেন, লোকসান হওয়ায় অনেক খামারিই নতুন করে বাচ্চা তুলছেন না। তাই আগের চেয়ে কম দামেও পাওয়া যাচ্ছে বাচ্চা।
তিনি বলেন, “আমার শেড খালি হয়েছে কয়েকটি। কিন্তু লস খাওয়ায় নতুন করে বাচ্চা তুলতেও ভয় পাচ্ছি। আগে দামও বেশি ছিল, এরপর অর্ডার দিয়েও পেতাম না। এখন অবশ্য ৪০ টাকার ভিতরেই পাওয়া যাচ্ছে। তবে ফিডের দাম এক টাকাও কমানো হয়নি। বস্তা ৩ হাজার ৫৭০ টাকা।”