সাধারণের বাজেট ভাবনা

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দামে লাগাম টানায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ। তবে মোবাইল সেবা, অনলাইন কেনাকাটার মতো বিভ্নি বিষয়ে খরচ বাড়ছে বলে অসন্তুষ্ট কেউ কেউ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 June 2020, 08:56 PM
Updated : 11 June 2020, 09:08 PM

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

দুর্যোগকালীন সময়ে টিকে থাকার পরিকল্পনায় প্রস্তাব করা বাজেট নিয়ে ইতিবাচক ও নেতিবাচক- দুই ধরনের প্রতিক্রিয়াই জানিয়েছেন নানা শ্রেণির-পেশার লোকজন।

বাজেট নিয়ে রাজধানীর সেগুনবাগিচার বাসিন্দা সাদিয়া জাহান বলেন, “এবারের বাজেটে অনেকগুলো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার আভাস পেলাম। এটা খুবই বিরক্তিকর। মোবাইল ফোনে কলরেটসহ আরও কিছু সেবার দাম বাড়ছে বলে খবরে শুনেছি। সব কিছু মিলিয়ে এবারের বাজেট আমার কাছে বেশি ভালো লাগেনি।

“তবে এত কিছুর মধ্যেও স্বর্ণের দাম কিছুটা কমতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। এটা সাধারণ মানুষের জন্য স্বস্তিকর হবে।”

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। ছবি: পিআইডি

নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ে স্বস্তি জানিয়ে পোশাক কর্মী মালা বেগম বলেন, “টিভিতে শুনছি চাল, পেঁয়াজ, চিনি, মাছ, মুরগির দাম কমবে। এজন্য ভলো লাগছে। আমরা তো আর এত কিছু বুঝি না। ডাল-ভাত কমে পাইলেই খুশি।”

দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা ফাতেমা-তুস-জোহরা বলেন, “দেশি পণ্যের দাম কমছে। বিদেশি পণ্যের দাম বাড়ছে। এটা ভালো মনে হচ্ছে। কারণ দেশি পণ্যের ব্যবহার বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়বে।

“মাস্ক, পিপিইসহ এই মহামারীর সময়ে প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমে এসেছে। সব মিলিয়ে বাজেটকে মানবিক মনে হয়েছে। তবে এটার বাস্তবায়নটাই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমাদের এখানে তো দাম বাড়ে রাতারাতি, কিন্তু কমে না তেমন।”

বাজেটে মোবাইল সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে সেবার বিপরীতে সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।

এতে ক্ষোভ প্রকাশ করে বেসরকারি চাকুরে রাজীব হাসান বলেন, “আমরা এখন অনেক কিছুই করি মোবাইল ফোনে। করোনাভাইরাসের কারণে ফোনের ব্যবহার আরও বেড়েছে। যোগাযোগ, বিনোদন, তথ্য জানা সব কিছুই তো ফোননির্ভর। সেখানে মোবাইল ব্যবহারের খরচ বাড়ানো মেনে নিতে পারছি না।

“প্রতি বাজেটে ফোনের খরচ বাড়ছে, এটা ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার সাথে যায় না। আমার প্রয়োজন আছে বলেই সরকার গলা কাটবে, এটা তো হয় না।”

মিরপুরের বাসিন্দা ফারুক হাসানও সন্তুষ্ট নন বাজেট নিয়ে।

তিনি বলেন, “অনলাইনে কেনাকাটা করি। এখন করোনাভাইরাসের কারণে সব কিছুই কিনছি অনলাইন থেকে। সেখানে অনলাইন কেনাকাটার খরচ বাড়ছে। এটা বাস্তবতার সম্পূর্ণ বিপরীত।”

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানিয়া হক মনে করেন, করোনাভাইরাসের কারণে এবার বাজেট অধিবেশন ভিন্নভাবে হলেও অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতাটুকু আগের মত হতে পারত।

“মিডিয়াতে তো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া সব কিছু আসে না। এখন অনেকেই বাসায় আছি। আমরা বিস্তারিত বাজেট বক্তৃতার অপেক্ষা করছিলাম। তাহলে সব বিষয় জানতে পারতাম।”

বাজেট কেমন হয়েছে তার কোনো খোঁজই রাখেন না দক্ষিণ মুগদা পাড়ার বাসিন্দা ব্যবসায়ী হারেছ উদ্দিন।

জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই দেশ চলে দুই চোক্ষের ইশারায়। এই দেশে বাজেট হইলেই কি না হইলেই কি! তিন মাস ধইরা ব্যবসা নাই। কী বাজেট হইসে জানি না, জানার দরকারও নাই। তবে এইডা জানি অহন জিনিসপত্রের দাম বাড়ব।”

বাজেটে তামাকজাত দ্রব্যের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

এ নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের একজন শিক্ষার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনার ঝুঁকির কারণে প্রায় ৮০ দিন হল সিগারেট ছেড়েছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও এই অভ্যাসটা ধরে রাখতে পারব বলে আশা করি। ফলে সিগারেটের দাম বৃদ্ধিতে আমার কোনো সমস্যা নেই।”

এনজিওকর্মী জি এম সুমন বলেন, “এবারের বাজেট উচ্চাবিলাসী মনে হয়নি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করাই হবে সরকারের অন্যতম দায়িত্ব।”

তবে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ নিয়ে অসন্তোষ জানিয়ে তিনি বলেন, “স্বাস্থ্য খাত এমনিতেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত। করোনাভাইরাস মহামারী জনজীবনকে থমকে দিয়েছে, সেখানে এই খাতে ৪১ হাজার কোটি টাকার যে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে তা আরও বেশি হওয়া দরকার ছিল।”

ঢাকার ঠিকাদার কে এম কাদের বলেন, “স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বাড়লেই কী হবে? মহামারীর মধ্যে তো আমরা দেখতে পাচ্ছি চিকিৎসা ব্যবস্থার কী অবস্থা! হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে রাস্তায় মানুষ মারা যাচ্ছে। এর আগেও যে বাজেট হইছে, তাও তো দুর্নীতির কারণে বাস্তবায়ন হয়নি। বাজেট যেটুকুই হয়েছে, সেটুকু বাস্তবায়ন করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”

স্কুল শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন বলেন, “পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে, তা অঙ্কে বেশি দেখা গেলেও প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশে প্রকৃতপক্ষে বেশি না। তবে করোনাভাইরাসের দুঃসময়ে এই বাজেট বাস্তবায়ন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করি।”

শিক্ষাখাতে বরাদ্দ জিডিপির অনুপাতে বরাদ্দ কমে যাওয়ার ফলে এই খাতকে অবহেলা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন এই শিক্ষক। 

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আকমল হোসেন বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে এবার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীরা। আমাদের পথে বসার মতো অবস্থা। আমাদের ঠিক রাখার জন্য এবারের বাজেটে হ্যান্ডসাম বরাদ্দের পাশাপাশি থোক বরাদ্দও রাখা উচিত ছিল, কিন্তু বাজেটে আমরা সেটি দেখিনি।”

বাজেট নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এএম আমিন উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মানুষকে কীভাবে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচানো যাবে, এটাই এই বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ। উন্নয়নের চাইতেও এখন গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে রক্ষা করা।

“প্রস্তাবিত বাজেটের অনেকগুলো বিষয়ই আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে ঠিক হয়নি। কিন্তু আমার মনে হয় এছাড়া কোনো উপায় ছিল না। এই দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য এই বাজেটটি ভালো মনে হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতেও বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। বিলাস দ্রব্যে বা খুব বেশি প্রয়োজন নেই এমন দ্রব্যের উপর ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে।”

আইন ও বিচার বিভাগের বাজেট নিয়ে এ আইনজীবী বলেন, “গত বাজেটের চেয়ে এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে আইন ও বিচার বিভাগের জন্য ১০৭ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। একে স্বাগত জানাচ্ছি। আশা করব, সংশোধিত বাজেটে এটি আরও বাড়ানো হবে। যেহেতু প্রথমবারের মতো বিচার বিভাগ ভার্চুয়ালি চলছে, ফলে আমাদের আরও অনেক দূর এগোতে হবে।”

আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফিরোজ আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সংসদে উত্থাপিত বাজেটের বিস্তারিত এখনও জানি না। টিভিতে পুরোটা দেখা হয়নি।

“আপাতত অপেক্ষা করছি সংবাদমাধ্যমগুলোর দেওয়া খবর কিংবা এ সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামতের। তারপর নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য হ্রাস-বৃদ্ধি কিংবা বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ অর্থ সম্পর্কে বিস্তারিত বুঝতে পারব।”