অনলাইন স্কুল: সরকারি নির্দেশনার অপেক্ষায় শিক্ষক-অভিভাবকরা

বোরহান বিশ্বাস
Published : 26 June 2020, 05:08 PM
Updated : 26 June 2020, 05:08 PM

শফিক মোস্তফার একমাত্র সন্তান লাবিবা। খিলগাঁওয়ের একটি বেসরকারি স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে টানা তিন মাসের বেশি সময় ঘরেই কাটাতে হচ্ছে তাকে। এমন পরিস্থিতিতে এমনিত হাঁপিয়ে উঠেছে লাবিবা; এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে অনলাইন স্কুল।

দু'মাস ধরে অনলাইনে স্কুলের কার্যক্রম চলছে। সিলেবাস শেষ করতে স্কুল শিক্ষকরা দ্রুত পড়িয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু লাবিবা চলছে কচ্ছপ গতিতে। একেবারেই মন দিতে পারছে না সে। লাবিবার মা ফেইসবুকে মাধ্যমে পড়ার খোঁজখবর রক্ষা করে চলেছেন। বলা যায়, মেয়ের অনলাইন ক্লাস মা-ই এক রকম চালিয়ে নিচ্ছেন।

বেতন পরিশোধের কথা মনে করিয়ে দিতে শফিক মোস্তফার মোবাইল ফোনে মাঝে-মধ্যেই ম্যাসেজ আসে। তিনি বাড়ি ভাড়া পান না দু'মাস ধরে। কিন্তু কষ্ট হলেও মেয়ের স্কুলের বেতন নিয়মিত দিয়ে যাচ্ছেন।

অনলাইন স্কুলে খুব কম ছাত্রছাত্রীই যুক্ত হতে পেরেছে বলে মনে করছেন তিনি।

কিন্তু সবাইকেই নির্দিষ্ট হারে বেতন দিতে হচ্ছে নিয়মিত, বলেন শফিক মোস্তফা।

একই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে পৃথিবী। ক্রিকেট খেলায় পারঙ্গম পৃথিবীর এখন সময় কাটে ঘরে বসে মোবাইল ও কম্পিউটারে গেম খেলে, টেলিভিশনে খেলা দেখে।

তথ্য আদান-প্রদানে কিছু ঘাটতি থাকলে অনলাইন ক্লাস করে বেশ মজা পাচ্ছে পৃথিবী। প্রতিদিন দু'ঘন্টা করে ক্লাস করতে হয়।

মা রিটা আহসানও ছেলের অনলাইন স্কুলে ক্লাস করা নিয়ে খুশি। এই পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রমটা  'অন্তত চালু থাকছে' বলে মনে করছেন তিনি।

কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থী নিসর্গ। এ বছর প্লে শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। স্কুলের নিয়মানুযায়ী শিক্ষকরা খুদে শিক্ষার্থীদের হাতে ধরে লেখা শেখান।

দু'মাস ক্লাস করে তিন মাসের বেশি হলো স্কুল বন্ধ আছে নিসর্গের। ছাত্রছাত্রীদের বেতনের টাকাতেই শিক্ষকদের বেতন হয়। স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বেতন দেওয়া-নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। মানবিক দিক বিবেচনা করে নিসর্গের বাবা-মা অন্তত অর্ধেক বেতন পরিশোধ করতে চান; যাতে নিজেরা এবং শিক্ষকরা উভয়ই দুর্যোগকালে কোনো মতে চলতে পারেন।

এমন ভাবনার মধ্যেই নিসর্গের স্কুল থেকে তার বাবার মোবাইল ফোনে একটি এসএমএস আসে। তাতে হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ফেইসবুকে যুক্ত হওয়ার কথা বলা হয়।

পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কোনো অভিভাবকই এ বিষয়ে তেমন সাড়া দেননি। কেউ কেউ অনলাইনে পড়ানোর বিষয়টিই বুঝতে পারেননি। কেউ বুঝেও সমালোচনা করে বলেছেন, ঘরকে স্কুল বানাতে পারবেন না। প্রয়োজনে সন্তানকে একই ক্লাসে রেখে দেবেন।

লাবিবা, পৃথিবী ও নিসর্গের মতো হাজার হাজার শিশু শিক্ষার্থীকে এই ক্রান্তিকালের মধ্যে অনলাইন স্কুল করতে হচ্ছে বাসা থেকে। মহামারী শিশুদের নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই কঠিন সময়ে হুমকির মুখে পড়েছে তাদের শিক্ষাজীবন।

সরকারিভাবে সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত অনলাইনে পাঠদান করা হচ্ছে। ঢাকার বেসরকারি কিছু স্কুল ও কিন্ডারগার্টেন নিজ উদ্যোগে অনলাইন স্কুল চালু করেছে।

তবে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ, কারোরই এ নিয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় তৈরি হচ্ছে সমন্বয়হীনতা।

কিছু কিছু স্কুল এক রকম অঘোষিত আদেশ জারি করেই অনলাইন স্কুল চালিয়ে যাচ্ছে বলে অনেক অভিভাবকের অভিযোগ।

তাদের ভাষ্যে, এই শিক্ষা পদ্ধতি শুরুর আগে অভিভাবকদের সঙ্গে কোনো রকম পূর্ব যোগাযোগ করার প্রয়োজন মনে করেনি স্কুল কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীদের বাসায় প্রযুক্তিগত কী সুবিধা আছে সেটিও জানতে চাওয়া হয়নি স্কুল থেকে।

উদ্বিগ্ন অভিভাবকের বকা খেয়ে বাসায় থাকাটাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুদের জন্য দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। ফলে এক রকম মানসিক চাপের মধ্যে পড়ছে শিশু শিক্ষার্থীরাও।

শিশুদের সঙ্গে সরাসরি বা সামনাসামনি পড়াশোনায় তারা যতটা স্বাভাবিক থাকে, হঠাৎ অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষাদানে প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে তারা। স্কুলে পড়ানোর আগে শিক্ষকরা বাড়ি থেকে প্রস্তুতি নিয়ে আসতেন। এমনটা তারা করছেন দীর্ঘদিন ধরে।

তবে অনলাইন ক্লাসের আগাম কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই হঠাৎ করেই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একটা বড় অংশ এই পদ্ধতিতে পড়াতে গিয়ে অসুবিধার মুখে পড়ছেন;

অভিযোগ জানিয়ে কয়েকজন অভিভাবক বলেন, অনলাইনে পড়াশোনার সময় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ বা তথ্যের আদান-প্রদানের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। অনলাইন স্কুলের ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন না থাকায় যার যার মতো করে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে আসছে স্কুলগুলো।

বন্ধ থাকা বেসরকারি স্কুল শিক্ষকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষকরা তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে এক রকম বাধ্য হয়েই অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন বলে কোনো কোনো অভিভাবক মনে করেন।

আর এই সমন্বয়হীনতার মধ্যে পড়ে অভিভাবকদের নাকাল অবস্থা। স্কুল বন্ধ থাকলেও কিংবা নামেমাত্র স্কুল চললেও নিয়মিত বেতন পরিশোধ করতে হচ্ছে তাদের। কোনো কোনো প্রভাবশালী স্কুল বন্ধের মাঝেও অভিভাবকদের কাছ থেকে এক রকম চাপ দিয়ে বেতন আদায় করছে।

কোচিং বাণিজ্য করার অভিযোগ অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে থাকলেও একটু স্বচ্ছলতার জন্য যারা বাসায় ছাত্র পড়ান তাদের অবস্থাটা এখন কেমন?

তাদের সন্তানরাও কোনো না কোনো স্কুলে পড়ছে। তাদেরও বেতন পরিশোধ করতে হচ্ছে। অথচ মহামারীর এই সময়ে তারা বাসায় পড়ানোর মতো শিক্ষার্থী পাচ্ছেন না বা কোথাও গিয়ে পড়াতে পারছেন না।

মডেল হাই স্কুল খিলগাঁওয়ের বিজ্ঞানের সহকারি শিক্ষক মো. শরীফ বকাউল বলেন,  "শিক্ষকদের অবস্থা এক অর্থে শোচনীয়। এর মধ্যেও তারা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। স্কুল বন্ধ হওয়ার পর পরই প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা কয়েকজন শিক্ষক মিলে অনলাইনে ক্লাস করানো শুরু করি।

"এতে করে যেসব শিক্ষার্থীরা শিক্ষা কার্যক্রম থেকে দূরে ছিল তারা ধীরে ধীরে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকলো। এসএসসি পরীক্ষার আগে বিশেষ করে টেস্ট পরীক্ষার সময় তারা যেন বড় ধরনের সমস্যায় না পরে সেজন্যই আমাদের এই পদক্ষেপ নেওয়া।"

এই শিক্ষক বলেন,  "সুনির্দিষ্ট কোনো গাইডলাইন না থাকায় আমরা নিজের মতো করেই ক্লাস নিচ্ছি। অনলাইনে ক্লাস শুরুর আগে অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাদের ফেইসবুক আইডি আছে তাদেরকে স্কুলের পেইজে সংযুক্ত হতে বলা হয়।"

তার মতে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি অনলাইন স্কুলের বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেয়, সে মতো চললে বিরাজমান সমন্বয়হীনতা অনেকটাই কেটে যেত।

শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস, শিক্ষকদের বেতন পাওয়া এবং অভিভাবকদের সেই বেতন দেওয়া মধ্যে এই সময় যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দেশনা থাকা জরুরি বলে মনে করছেন অভিভাবকরাও।