করোনাকালের ডায়েরি: অনলাইন ক্লাসের পক্ষে-বিপক্ষে

লিংকে ঢুকতেই শাহনওয়াজ স্যারের গলা শুনতে পেলাম। তবে সেই গলাতে দৃঢ়তা নেই। হারিয়ে গেছে জৌলুসও। স্যারের আতঙ্ক-ভরা এমন কণ্ঠ এই প্রথম শুনছি।

মুহাম্মাদ শরিফুজ্জামান বাপ্পিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 June 2020, 09:28 AM
Updated : 17 June 2020, 09:54 AM

বলছিলাম আমাদের কলেজের অনলাইন ক্লাসের কথা। শাহনওয়াজ স্যার আমাদের ফিজিক্স ক্লাস নেন। অন্যান্য ক্লাসে যেখানে গোটা তিরিশেক শিক্ষার্থী-বন্ধুর বেশি পাওয়া যাবে না সেখানে স্যারের কাছে সত্তোর্ধ উপস্থিতি নিয়মিত।

স্যারের বোঝানোর টেকনিকটা এতোটাই সম্ভ্রান্ত, তিনি যে বিষয় পড়ান সেই বিষয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মানোর জন্য যথেষ্ট।

পৌনে আটটার দিকে স্যারের প্রাইভেট থাকতো তখন। আমি যেতে যেতে আটটা পার হয়ে যেতো। স্যারের বকুনি খেতে হতো নিয়মিত। ছুটির পর শুরুর দিকের পড়াগুলোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকতাম। স্যারও হাসিমুখে দেখিয়ে দিতেন।

জিজ্ঞাস করতেন, বাপ্পি, পড়াশোনা ভালো হচ্ছে তো?

আমি নিয়মিত বলতাম, জ্বি স্যার। ম্যাথে একটু পিছিয়ে আছি।

ক্লাস ভালো না লাগলে লাইব্রেরিতে চলে যেতাম। বই পড়তাম। বেশিরভাগ সময়ই অ্যাকাডেমিক বই। মাঝে মধ্যে গল্পের বই পড়তাম।

কখনো বন্ধুদের সঙ্গে গল্প-আড্ডা, কখনো বা ফেইসবুকে উঁকি দিয়ে আসতাম। কড়া পাহারার মধ্যে সবকিছুই করতে হতো নিঃশব্দে। দিনগুলো কর্মচঞ্চল ছিল।

হোস্টেলে থাকতাম আমি। একটা পরিবারের মতো ছিলাম আমরা। র‍্যাগের মতো কোনো জিনিস সেখানে নেই। সবাই সবাইকে ভাই মনে করে। মাসে একদিন পার্টি হতো মুড়ি দিয়ে। দিনগুলো সত্যিই দারুণ ছিল।

রাজশাহীর লোকেদের কাছে বিনোদনের অন্যতম স্পট পদ্মাপাড়। যখন আমার মন খারাপ থাকতো তখন আমি পদ্মাপাড়ে ঘুরে আসতাম। নানা ধরণের মানুষজনদের দেখে মন ভালো করে হোস্টেলে ফিরতাম। আজ সেসব শুধুই স্মৃতি।

১৬ মার্চ কলেজে গিয়ে জানতে পারি কলেজ ছুটি দিয়ে দিয়েছে। ফেইসবুকে ঢু মারতেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের শিরোনাম নজরে এলো, ‘৩১ মার্চ পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ’।

সেদিন আনন্দে নেচে উঠেছিলাম ঠিকই, তবে অজানা এক ভয় গ্রাস করেছিল। কেন জানি না সেদিন মনে হয়েছিল পরিস্থিতি অবনতি হলে ছুটির মেয়াদ বাড়তে পারে। সেদিন কল্পনাও করিনি দেশের পরিস্থিতি এতোটা খারাপের দিকে যাবে।

সেই ১৬ তারিখের পর বন্ধুদের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। রাগারাগি করার পর কাউকে সরি বলে বুকে টেনে নেওয়া হয়নি। ফেইসবুকে কথা হয়েছে সবার সঙ্গেই। কিন্তু তাতে কি আর তৃপ্তি মেটে!

সেদিন ফেইসবুকে দেখলাম এক সহপাঠী লিখেছে, আমি আজীবন অনলাইনে ক্লাস করতে চাই। ঘরে বসে আরামে ক্লাস করা যায়। কলেজে যাওয়ার প্যারা নেই।

আমার এই সহপাঠী নিয়মিত কলেজে আসতো না। সাংস্কৃতিক কোনো কর্মকাণ্ডে তার অংশগ্রহণ একদমই ছিল না। পড়াশোনাতে অবশ্য অনেক ভালো।

সেই সহপাঠী ভবিষ্যতে হয়তো পড়াশোনায় অনেক ভালো করবে। অনেক ভালো পজিশনে যাবে। কিন্তু সামাজিকতা হয়তো শিখবে না। কঠিন মুহূর্তে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে কিংবা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

অনেকে বলতে পারেন, অনলাইন ক্লাসগুলোই এই সময়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার একমাত্র উপায়। আমি এই মতের বিরোধিতা করছি না।

তবে বলতে চাই, এটা দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান নয়, সাময়িক সমাধান হতে পারে।

শিক্ষক ও সহপাঠীদের সঙ্গে লেখকের সেলফি

অনলাইন ক্লাস পুঁথিগত শিক্ষা দিলেও আমাদের নৈতিক কিংবা সামাজিক শিক্ষা দিতে পারে না। আমরা ক্লাসে সবার সঙ্গে বসে যে সামাজিকতার শিক্ষা পাই কিংবা শিক্ষকদের শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে যে নৈতিক শিক্ষা পাই সেটা অনলাইন ক্লাসে কখনোই সম্ভব নয়।

‘সামাজিক দূরত্ব’ টার্মটা নিয়ে আমার বড়সড় আপত্তি আছে। এই টার্মটা হওয়া উচিত ‘শারীরিক দূরত্ব’। বৃহত্তর স্বার্থে আমরা শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চললেও সামাজিকভাবে দূরত্ব রাখা ঠিক নয়।

মোবাইল-ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমাদের আত্মীয়-স্বজন এমনকি প্রতিবেশীরও খোঁজ রাখা উচিত। শারীরিকভাবে দূরে থেকে এবং মানসিকভাবে কাছাকাছি থেকে আমরা এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি উতরিয়ে উঠবো।

একদিন ঘুম থেকে উঠে শুনবো, করোনাভাইরাসমুক্ত হয়ে গেছে পুরো পৃথিবী। সেই সঙ্গে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিও। কিন্তু সেই দিন কবে আসবে! হয়তো কেউই জানে না।

লেখক পরিচিতি:  হ্যালো ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে শিশু সাংবাদিকতা করছেন। রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি,সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!