শশীলজে মাতৃরূপ দেবী ভেনাস

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 7 Feb 2020, 01:21 PM
Updated : 7 Feb 2020, 01:21 PM

মুক্তাগাছা জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর তৃতীয় উত্তরপুরুষ রঘুনন্দন আচার্যের উত্তরাধিকার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী। ১৮৯৭ সালের ১২ জুনে গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্পে ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থল, ব্রহ্মপুত্র নদের অদূরে ৯ একর জমির ওপর স্থাপিত ওই জমিদারের রাজবাড়ি বিধ্বস্ত হলে ১৯০৫ সালে তা পুনর্নির্মাণ করে নাম রাখা হয় শশীলজ।

১৯১১ সালে শশীলজকে সংস্কার করে অনিন্দ্য সুন্দর রূপে গড়ে তুলেন নবীন রাজা শশীকান্ত। শশীলজের মূল ভবনের সামনে রয়েছে বাগান। সেই বাগানের মাঝখানে আছে শ্বেতপাথরের ফোয়ারা, যার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে রোমান দেবী ভেনাসের  মর্মর মূর্তি।ব্রিটিশ শাসনামলের সেসময় সৌখিন রাজা ওই নান্দনিক ভাস্কর্যটি ইটালি থেকে গড়িয়ে এনেছিলেন।

মহারাজা শশীকান্ত আচার্যের রাজবাড়িটি শত বছর ধরে টিকে আছে। ১৯৫২ সাল থেকে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে। এতদিন হাজারো মুসলিম প্রশিক্ষণার্থী ওখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

বেশ কিছুদিন আগে ফেইসবুকে নজরে এসেছিল, কয়েকজন শশীলজে দেবী ভেনাসের ছবি পোস্ট দিয়ে এই মূর্তির অপসারণ চাইছে।

আমরা মধ্যযুগে ফিরে গেছি এমন নয়, তাই অবাক হয়ে ভাবতে হয় শিল্প, প্রযুক্তি ও বোধবুদ্ধি বিকাশের এই আধুনিক যুগে হঠাৎ বাংলাদেশের কী হলো?
এদেশ তালেবান হয়নি, এই বাংলা আফগান হয়নি। এখনো পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রায় অগুণতি মানুষ ভিড় হয়। হ্যাপি নিউ ইয়ারে মানুষ একে অপরকে শুভেচ্ছা জানায়। বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসে কিছু স্মৃতিসৌধ অভিমুখে লাখো মানুষ পদযাত্রা করে। এখনো দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ প্রগতিশীল।

তাহলে দেবী ভেনাসের স্বল্পবসনে কিছু লোক কেন উগ্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে? এর কারণ একটাই। ফেইসবুক ও ইউটিউবের হুজুগে ওয়াজ শুনে শুনে একদল ব্রেন ওয়াশড হয়েছেন। ধর্মান্ধতা, কূপমণ্ডূকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা ছাড়া শিল্প, ঐতিহ্য বা ইতিহাস সম্পর্কে এইসব মৌলবাদীদের ন্যূনতম পড়াশোনা নেই।

রোমান পুরাণের দেবী ভেনাস। । গ্রিক পুরাণে ভেনাসের সমতুল্য দেবী আফ্রোদিতি।  গ্রিক পুরাণের আফ্রোদিতির মতো দেবী ভেনাসকে কিউপিডের মাতা হিসেবে জানা হয়। ইতিহাসের অমর স্মারক মাতৃসমা, প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী ভেনাসকে এখন আমাদের মাথাব্যাথার কারণ, এটা ভাবতেই দুঃখ পাই।

পুরাণকে রিফর্ম করা বা ভুল ধরে তা বাতিল করে দেওয়া যায় না। এমন দুর্মর অভিপ্রায়ে কোনো বাহাদুরিও নাই। গ্রিক বা রোমান পুরাণের কালোত্তীর্ণ রূপকার আমরা কেউ না। পৌরাণিক রসাস্বদন করতে হবে তার সময়কালের আঙ্গিক ও গঠনতান্ত্রিক অবয়বকে মেনে নিয়েই। ধর্মের দোহাই দিয়ে দেবী ভেনাসকে গুঁড়িয়ে দিলেই প্রাগৈতিহাসিক মাতৃরূপা ভেনাসকে হারিয়ে দেওয়া যাবে না, নিশ্চিহ্নও করা যাবে না। বরং এমন দাবি করা বিশ্বসমাজে নিজের মূর্খতাকেই নগ্ন করে দেওয়ার শামিল।

ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা হলো ল্যুভর মিউজিয়াম। এখানে বিশ্বের বিখ্যাত চিত্রকরদের আঁকা নগ্ন শিল্পকর্মও সংরক্ষণ করা হয়েছে। আছে গ্রিক ও রোমান পুরাতাত্ত্বিক ঐতিহ্য। বাদ যায়নি ইসলামি শিল্পকলাও। মুসলিম দর্শনার্থীরাও যায় এই মিউজিয়ামে ।

ইউরোপ কান্ট্রি নয় শুধু, কমনওয়েলথভুক্ত প্রায় সব দেশেই দেবী ভেনাসের রেপ্লিকা আছে। সেখানে মুসলমানরাও সসম্মানেই বসবাস করেন। তাদের কেউ কি ভুলেও দাবি করে ওই মূর্তি তাদের রোজকার ধর্মাচারে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে?

২০১৭ সালের জুলাইয়ে আমাদের লেখক বন্ধু কাজী শহীদ শওকতের আমন্ত্রণে ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে লেখালেখি করা আমরা বেশ কয়েকজন ময়মনসিংহ ভ্রমণ করি। সেসময় ব্রহ্মপুত্রের পবিত্র জলে হৃদয় ভেজাবার আগেই শহীদ শওকত আমাদেরকে নিয়ে গিয়েছিলেন শশীলজে।

এই জমিদার বাড়িটি আমরা বিটিভিতে হুমায়ূন আহমেদ রচিত 'অয়োময়' নাটকে একসময় দেখেছি। বাড়িটির সামনের বাগানের মাঝখানটাতে শ্বেতপাথরের ফোয়ারার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রিক দেবী ভেনাসকে দেখেছিলাম।

আমরাও দেবী ভেনাসের ছবি তুলেছিলাম। আমাদের সেই ছবিগুলো  শিল্পমানোত্তীর্ণও ছিল। আর এখনকার উগ্রমতাদর্শীরা ফেইসবুকে যেসব ছবি আপলোড করে, সেখানে ঘুরেফিরে দেবীর বক্ষদেশ ও নিতম্বই মুখ্য থাকে।

শৈল্পিক ওই ভাস্কর্যটিতে যাদের অযাচিত অ্যালার্জি, তাদেরকে অতিসত্বর প্রত্নতাত্ত্বিক কলাকেন্দ্রের অধীনে নিয়ে গিয়ে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ওপর বাধ্যতামূলক থেরাপি দেওয়া হোক। অন্তত এতে যদি জাতির মুখ রক্ষা হয়।

শশীলজের মাতৃসমা দেবী ভেনাস একশো বছরের অধিকালেও কারো ক্ষতি করেনি, করবেও না। যার নামের সাথে নন্দন, শিল্প ও ঐতিহ্য জড়িত, কাউকে বিপথে নেওয়া তার কর্ম নয়। কাজেই দেবী ভেনাস তার জায়গাতেই থাকবেন। যারা এই ভাস্কর্য নিয়ে ধর্মের খেলা খেলতে চান, তারাই বরং এই বাংলাদেশের নাগরিক থাকার যোগ্য নন।