'কালে কালে কত কি যে দেখবো ফেসবুকের এই আজব জামানায়'- চমক হাসানের চমৎকার এই গানটা শুনছি আর ভাবছি ফেসবুক না থাকলে আসলেই অনেক কিছু অজানা রয়ে যেত।
ফেসবুক না হলে আমাদের কার মধ্যে যে কি মেধা আর সৃজনশীলতা লুকিয়ে আছে সেটা আমরা জানতেই পারতাম না। এই কারিশমাকে বিকশিত করে ফেসবুক অনেককে বানিয়েছে লেখক, বানিয়েছে সাংবাদিক, অনেককে বানিয়েছে কবি-সাহিত্যিক, কাউকে আবার বানিয়েছে প্রেমিক। ফেসবুকে এসে যেটা হওয়ার আগ্রহ সবচেয়ে বেশি সেই সেলিব্রেটিও হয়েছে অনেকেই।
অপরাধী গানের শিল্পী কি কখনো ভেবেছিলো তার গান এমন ভাইরাল হবে? কিন্তু হয়ে গেছে। ফেসবুকেও এরকম অনাকাঙ্খিত ভাইরাল অহরহই হয়ে থাকে। এটা খুবই স্বাভাবিক। ভালো কিছু বা ব্যতিক্রমী বা সৃজনশীল কিছু হলে সেটা ভাইরাল হওয়ার দাবিও রাখে। কিন্তু তাদের এই ভাইরালে 'হিংসে' হয় অনেকেরই। কেন আমি তার মত হতে পারলাম না? আমার পোষ্টে কেন হাজার হাজার লাইক হয় না?
জনপ্রিয় বা ফেমাস হওয়ার এই আকাঙ্খা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ মাত্রই এই বৈশিষ্ট থাকবে। কিন্তু এই আকাঙ্খাকে যারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তারা যে কোনো ভাবে ভাইরাল হতে চায়। পত্রিকায় এমন ঘটনাও পড়েছি যুক্তরাষ্ট্রে ভাইরাল হওয়ার জন্য লাইভে বন্ধুর বুকে গুলি চালিয়েছে বান্ধবী। পরে তার মৃত্যু হয়।
সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য কিছু সহজ ও জঘন্য পন্থাও আবিষ্কার হয়েছে। ফেসবুক লাইভে এসে গালাগালি করলেই এখন ভাইরাল হওয়া যায়।
ভাইরাল হওয়া মানে মানুষের মুখে তার নাম, ডায়লগ ছড়িয়ে পড়া। যখন যেই ভাইরালের ট্রেন্ড চলে তখন সর্বত্র সেটারই প্রতিফলন দেখা যায়। ফেসবুক পোষ্টে, কমেন্টে, মানুষের মুখে সব জায়গায় তারই অনুকরণ। কে চায় না তার নাম, কথা বা ডায়লগ এভাবে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ুক?
ভাইরাল প্রবণতাই ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমগুলোতে অশ্লীলতা আর নগ্নতার প্রসার ঘটিয়েছে। সম্প্রতি নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে ছাত্রদের হাতের কিছু পোষ্টারের স্লোগান নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। এটা হওয়ারই ছিলো। এই বয়সের একটি কিশোর বা কিশোরীর হাতে এরকম লেখা কখনোই মানানসই নয়। এটা শুধু এই দেশেই নয়, বিভিন্ন দেশেই আন্দোলনকারীরা প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে এসব স্ল্যাং শব্দ ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশে এই সংস্কৃতিটা কিছুদিন আগেও ছিলো না। এই সংস্কৃতি আমদানির জন্য অনেকাংশে দায়ী সামাজিক মাধ্যমগুলো। বাস্তবে যে শব্দটা উচ্চারণ করতে ইতস্তত লাগে, ফেসবুকে সেটা নির্দ্বিধায় লিখে ফেলা যায়। ফেইক আইডি ব্যবহারের কারণে পরিবারের লোকজনও ভার্চুয়ালের এসব আচরণ দেখতে পাচ্ছে না। এছাড়া ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া স্ল্যাং শব্দগুলোও ব্যাপকভাবে অনুকরণ করছে তরুণরা। ভাইরাল বা ট্রেন্ড ব্যাপারগুলো অনুকরণ করাকে তারা স্মার্টনেস হিসেবে গণ্য করছে।
অশ্লীলতা বা স্ল্যাং বাক্যের ব্যবহার কখনো অনুকরণীয় কিংবা স্মার্টনেস হতে পারে না। এটার জ্বলন্ত উদাহরণ আমাদের সামনেই। নিরাপদ সড়কের মত ছাত্রদের একটি যৌক্তিক আন্দোলনকে বিতর্কিত করেছে কিছু স্ল্যাং শব্দের পোষ্টার।
যারা এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলো তাদেরকে এই পোষ্টারগুলোই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। ছাত্ররা এক সপ্তাহে ঢাকার বিশৃঙ্খল রাজপথে যেই অভাবনীয় শৃঙ্খলা এনে দিয়েছিলো, ইমার্জেন্সি লেনের মত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, সেগুলো আরো বর্ণিলরুপে ধরা দিতো এই স্ল্যাং স্লোগানগুলোর ব্যবহার এড়ালে।
দেশের অধিকাংশ মানুষ ছাত্রদের এই আন্দোলনের পক্ষে ছিলো। যৌক্তিক আন্দোলন হওয়ায় কিশোর-কিশোরীদের স্ল্যাং স্লোগানসমূহ তারা দেখেও না দেখার ভান করেছে। সরকার বিরোধী পক্ষ তো ছাত্রদের এসব স্ল্যাং স্লোগানে খুশিই হয়েছে।
স্ল্যাং শব্দ কখনো প্রতিবাদকে বেগবান করেনা, উল্টো বিতর্কিত করে। অশ্লীলতাকে না বলুন। প্রতিবাদের ভাষা হোক ভদ্র ও মার্জিত। প্রতিবাদের ভাষা হোক বিদ্রোহী কবি নজরুলের মত। যার মার্জিত অগ্নিগোলা সদৃশ প্রতিবাদি ভাষা শক্তিশালী ইংরেজদের তখতকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো।