Published : 26 Nov 2017, 06:25 PM
সাহিত্যে 'ছোটগল্প' খুবই শক্তিশালী। ছোটগল্পের মাধ্যমে স্বল্পতম সময়ে একটি নিগুঢ় সত্য উপলব্ধি করা সম্ভব হয়। আর বাংলা সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় জটিল মনস্তত্ব সৃষ্টির জন্য।
ছোটগল্পগুলোতে তিনি যে মনস্তাত্বিক জটিলতা তুলে ধরেছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। মানিকের জীবনবোধ, নাতিদীর্ঘ উপলব্ধি ক্ষমতা, বাস্তব জীবনের স্পৃষ্টতা সবই অসাধারণ। এজন্য আজ মানিকের ছোটগল্প 'প্রাগৈতিহাসিক' নিয়ে কিছু কথা বলব।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আসল শিক্ষা নিয়েছেন তার জীবন থেকে। তার জীবন ও মধ্যবিত্তের মানুষের জীবন নিয়েই তার শব্দ তৈরির খেলা চলত। এজন্য তিনি সবচেয়ে বেশি জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্যিক হয়ে উঠেছেন।
তার চেতনায় ছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। যেখানে ধনী-গরিব সবাই সাম্যের পরিবেশে থাকতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতা যখন ভিন্ন দেখা দিল, তখই মানিক নিজের লেখায় ধারণ করলেন সমাজতন্ত্র।
প্রাগৈতিহাসিক গল্পে মানুষ হিসেবে ভিখু চরিত্রকে সবচেয়ে প্রাঞ্জল করে সৃষ্টি করেছেন। জীবনকে দেখেছেন অতি কাছ থেকে। এজন্যই ভিখুর চিন্তায়- 'মরিবে না। সে কিছুতেই মরিবে না। বনের পশু যে অবস্থায় বাঁচে না সেই অবস্থায়, মানুষ সে বাঁচিবেই।' বেঁচে থাকার নিরন্তর চেষ্টা মানুষের জন্ম জন্মান্তরের। সেখানে কোনো খাদ নেই। আত্মহত্যা করতে গিয়ে শেষমেশ মানুষ বাচার চেষ্টা করে। কিন্তু তখন সফল হয় না।
ভিখুর দস্যু জীবন এক ভিন্ন স্বাদ দেয় পাঠকের কাছে। সে প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকার চেষ্টায় রত- 'বর্ষাকালে যে বনে বাঘ বাস করিতে চায় না এমনি অবস্থায় সেই বনে জলে ভিজিয়া মশা ও পোকার উৎপাত সহিয়া, দেহের কোনো না কোনো অংশ হইতে ঘণ্টায় একটি করিয়া জোঁক টানিয়া ছাড়াইয়া জ্বরে ও ঘায়ের ব্যথায় ধুঁকিতে ধুঁকিতে ভিখু দুদিন দুরাত্রি সঙ্কীর্ণ মাচাটুকুর ওপর কাটাইয়া দিল।'
মানিকের স্বাতন্ত্র্য জীবনবোধ তাকে বাস্তব জগতে নিয়ে এসেছে বার বার। ভিখুর মধ্যে যে প্রবল যৌনক্ষুধা ছিল তা প্রকাশ পেয়েছে- 'নদীর ঘাটে মেয়েরা স্নান করিতে নামিলে ভিক্ষা চাহিবার ছলে জলের ধারে গিয়া দাঁড়ায়। মেয়েরা ভয় পাইলে সে খুশি হয় এবং সরিয়া যাইতে বলিলে নড়ে না, দাঁত বাহির করিয়া দুর্বিনীত হাসি হাসে।
রাত্রে স্বরচিত শয্যায় সে ছটফট করে। নারী-সঙ্গহীন এই নিরুৎসব জীবন আর তার ভালো লাগে না। অতীতের উদ্দাম ঘটনাবহুল জীবনটির জন্য তাহার মন হাহাকার করে।'