Published : 12 Jan 2017, 07:44 AM
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ঢাকার একটি থানায় গিয়েছিলাম একটা জিডি করতে। আমার মোবাইল ফোন হারানোর জিডি। থানা পুলিশের আচরণে তখন গলাটা শুকিয়ে এসেছিল। কাঁপতে কাঁপতে অফিসারকে বলেছিলাম, জিডি করতে স্যার টাকা লাগবে কিনা। দুই শ' টাকা নিয়েছিলেন দারোগা বাবু।
বছর পাঁচেক আগে গ্রামের একটি থানায় গিয়েছিলাম বন্ধুকে সহায়তা করতে। স্থানীয় নেতাও থানায় ফোন করে দিয়েছিলেন- যাতে উপকারটা সহজে পাই। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি- ওই বন্ধু উপকার তো পাননি; উল্টো হাজার খানেক টাকা নিয়েছেন অফিসার।
গত বছরের শেষের দিকে এক স্বজন গিয়েছেন নিজের থানায়-তার আটকে থাকা পুলিশ ভেরিফিকেশনের কাগজটার কাজ দ্রুত শেষ করাতে। আমি নিজের পরিচয় দিয়ে ফোন দিয়েছিলাম থানার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে। কাজটা দ্রুত হয়েছে, তবে টাকার বিনিময়ে। যা আমি পরে জেনেছি।
পেশাগত কারণে প্রায় প্রতিদিনই আরো কতো মানুষের অভিযোগ যে পাই থানা পুলিশের হয়রানি নিয়ে। এই বলে ঢেকুর গিলি-যাদের বিরুদ্ধে হয়রানি, তারাই তো কোনো না কোনা ভাবে মানুষের উপকার করছেন।
কয়েকটি ঘটনায় মনে হচ্ছে-থানা বা পুলিশের হয়রানির দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। সেই মান্ধাতার আমল থেকে চলে আসা পুলিশের লাঠিপেটার দিনটাও মনে হয় শেষের পথে। এখন জনসম্পৃক্ত হয়ে সেবাধর্মী পুলিশিংই যেন বড় কথা। কৌশলে অপরাধ দমনটাই এখনকার পুলিশিং। লাঠি পেটা নয়, প্রযুক্তিগত জ্ঞান দিয়ে আর হৃদয় দিয়ে পুলিশিং ও ঘটনার তদন্তের দিনটা এসে গেছে।
এক সময়ে একটা কথা ছিল-শিক্ষিত দুই শ্রেণীর। ১. ইংরেজী জানা শিক্ষিত। ২. ইংরেজী না জানা শিক্ষিত। সময়ের পরিবর্তনে সেটা পাল্টে হয়েছে দুই শ্রেণীর শিক্ষিত। কম্পিউটার (প্রযুক্তি) জানা শিক্ষিত আর তা না জানা শিক্ষিত। পুলিশিংয়ের ক্ষেত্রেও যেন তা আসন্ন। ভালো ব্যবহার আর প্রযুক্তি জানা পুলিশ আর তা না জানা পুলিশ। সাধারণ মানুষ যেমন হয়রানি আর ঘুষ নেওয়া পুলিশের সমালোচনা করেন, তেমনি ভালো ব্যবহারকারী পুলিশের সুনাম করতেও দ্বিধা করেন না।
পুলিশ বাহিনীতে এখন পরিবর্তনটাও চোখে পড়ার মতো। এক সময়ে চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ টাকা চাইত, টাকা নিত। পুলিশ সেই তদন্ত করতে গিয়ে এখন উত্তীর্ণ প্রার্থীকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে, থানায় ডেকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে।
আগে ট্রাফিক পুলিশকে টাকা দিলেই যেন ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করা যেত। টাকা না দিলে নানা ঘাট দেখিয়ে ভৎর্সনা করতেন ট্রাফিক কর্মকর্তা। এখন সে দৃশ্যও পাল্টেছে। ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীকে পুলিশ ফুল দিচ্ছে। শুভ কামনা জানিয়ে বলছে, তিনি আর যেন আইন ভঙ্গ না করেন। আমি ট্রাফিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি- এমন 'শুভ শাস্তিতে' নাকি কাজও হচ্ছে।
এবার আসা যাক একজন পুলিশ কর্মকর্তা আর একজন কুখ্যাত জুয়াড়ির গল্পে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাটি উত্তরাঞ্চলের। ওই অঞ্চলের একটি জেলার সার্কেল এএসপি হাফিজুর রহমান। তার কাছে জুয়াড়ির পরিবারের অভিযোগ দেয়, সংসারের কর্তা ওই ব্যক্তির জুয়া খেলার জন্য তাদের সব সম্পদ শেষ। এলাকায় মান-ইজ্জতও শেষ।
অভিযোগ পেয়ে পুলিশ কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান ওই জুয়াড়িকে আটক করেন নি। উল্টো বিনয়ের সঙ্গে নিজের অফিসে ডেকে সেই জুয়াড়িকে অাপ্যায়ন করিয়েছেন। জুয়ার কারণে প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া সুন্দর একটি সংসারের চিত্র তুলে ধরেছেন ওই জুয়াড়ির সামনে। পুলিশ কর্মকর্তা গল্পের ভেতর দিয়ে জুয়াড়ির স্ত্রী ও সন্তানের মুখখানি তার সামনে তুলে ধরেছেন। ফলাফল-জুয়াড়ি প্রতিজ্ঞা করেছেন- আর জুয়া খেলবেন না এবং হয়েছেও তাই।
গল্পটি এজন্য- ওই পুলিশ কর্মকর্তা জুয়াড়িকে পেটান নি, আটক করেন নি। তবে সমাজের অপরাধ দমনে নিজের চাওয়াটি ঠিকই আদায় করে নিয়েছেন। পুলিশ কর্মকর্তা হাফিজুর রহমানের মতো হয়তো বাহিনীতে এমন শত শত চৌকশ অফিসার রয়েছেন। তবে গুটি কয়েক খারাপের জন্য তো দুর্নামের অংশীদার হচ্ছেন তারাও।
এবার প্রযুক্তি নির্ভর পুলিশিংয়ে আসা যাক। একটা সময় ছিল এবং এমনটাই বিশ্বাস ছিল- অপরাধ দমনের একমাত্র মাধ্যম লাটিপেটা আর নির্যাতন করা। পুলিশের সাম্প্রতিক সব কর্মকাণ্ডে সে ধারণাও বাতিল হতে চলছে। বলা যায়, পুলিশ কিন্তু লাঠিপেটা করে সম্প্রতি দেশে ভয়ঙ্কর জঙ্গিবাদ বিস্তারের লাগামটা থামায়নি। প্রযুক্তিগত তদন্ত আর জনসম্পৃক্ত হয়েই একের পর এক জঙ্গি আস্তানার সন্ধান আর তা গুড়িয়ে দেওয়ার কাজটি সফলভাবে করছে পুলিশ।
সুতরাং বলা যায়, নির্যাতন, ঘুষ আর হয়রানির পুলিশিংটা যেন শেষ হতে চলছে। সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে- মেধা কৌশল, ভালোবাসা আর প্রযুক্তিবান্ধব আধুনিক পুলিশিং ব্যবস্থা।