Published : 21 Apr 2016, 02:20 AM
আয়ানের বয়স ১৭ বছর। মাধ্যমিকের গণ্ডি শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। ওর আরও ছোটো দু'জন ভাই-বোন আছে। ওদের সাথে আয়ানের সম্পর্ক বেশ ভালো। সবাই একসাথে মিলে টিভি দেখে, হৈ-চৈ করে, আয়ান ওদেরকে ঈশপের গল্প শোনায়। আয়ানের বন্ধুরাও ওর সঙ্গ পেয়ে খুব আনন্দ পায়। কারণটি হলো ওর ক্রিয়েটিভিটি। এরই মধ্যে ফটোশপ আর ইলাস্ট্রেটরে হাত পাকিয়ে ফেলেছে, গিটার বাজায় চমৎকার। একটা ব্যান্ড গড়ে তোলার ইচ্ছে আছে। ওর দানশীলতাও অবাক করার মতো। গত ডিসেম্বরে নিজের নতুন ল্যাদার জ্যাকেটটা খুলে দিয়ে দিলো এক ভিখিরি চাচাকে। সাথে থাকা বন্ধু জাহিন বললো, 'সে কী রে, দিয়ে দিলি?' আয়ানের সাথে একই ব্যাচে কোচিংয়ে পড়ে সীমা নামের যে মেয়েটি, সে সেদিন রাতে ওকে ইনবক্স করলো তার জন্মদিনে ইনভাইট করে। এরপর আনন্দে ওর সারারাত ঘুম হয়নি। জন্মদিনের দাওয়াত নিশ্চয়ই সুখবর; কিন্তু এর জন্য আনন্দে সারারাত ঘুম হবে না—এমন হয়তো হবার নয়। কিন্তু আয়ানের বেলায় সেরকমটি হলো। ওই রাতটা ওর খুব ভালো গেলো। পরের দিনটাও। এরকম প্রায়ই হয়। তুচ্ছ বিষয়—কিন্তু বিরাট আনন্দ হয়। নিজেকে খুব কনফিডেন্ট ফিল করার কারণ পাওয়া যায়। ফিলিংটা এমন যে, ওর মতো ক্রিয়েটিভ সচরাচর হয় না; তাই চাইলেই যে কাউকে পটানো যেতে পারে। এমন হয়েওছে দু'য়েকবার। তবে কোনো কোনো দিন একদমই অন্যরকম যায়। আত্নবিশ্বাসে ব্যাপক ভাটা পড়ে। মনে হয় ওকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। অন্যদের তুলনায় নিজেকে বিন্দুর মতো লাগে। জঘন্য লাগে তখন। পুরনো ভুলের জন্য যন্ত্রণা হয়। কুঁড়ে খায়। ওর খেতে ইচ্ছে করে না, কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। এরকম সময়গুলোতে কোনো কাজেও মন বসে না। ছোট ভাই-বোন দু'জন কাছে ঘেঁষতে চাইলে আয়ান রেগে যায়। মেরেও বসে দু'য়েকটা চড়-থাপ্পর কোনো কোনো দিন। বাবা-মা অবাক হয়। বন্ধুরাও আয়ানের এই পরিবর্তনের হেতু বুঝতে পারে না। বাবা-মায়ের টেনশন বেড়ে চলে। তখন ওকে শাসন করতে গেলে বিপদ আরও বেড়ে যায়। এটা-ওটা ছুঁড়ে ফেলে, ভেঙে ফেলে। নিজের দামি আইফোনটাও এমনি করেই গেছে। আয়ানের বাবা ছেলের আচরণের এসব অদ্ভুত আপ-ডাউনে সন্দিহান হয়ে তার এক ডাক্তার বন্ধুকে ফোন দিলেন। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী ছেলেকে একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট-এর কাছে নিয়ে গেলেন। পুরো বৃত্তান্ত শুনে, আয়ানের সাথে সময় নিয়ে কথা-টথা বলে সাইকোলজিস্ট জানালেন, ও বাইপোলার ডিসওর্ডারে ভূগছে।
বাইপোলার বা বাইপোলার মুড ডিসওর্ডার বা ম্যানিক ডিপ্রেসন হলো এক ধরণের কঠিন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। এ ধরণের সমস্যাক্রান্ত যিনি, তার ভেতর পরমানন্দবোধ এবং চরম বিষন্নতা –এই দুই বিপরীত মানসিক অবস্থার অস্বাভাবিক ক্রমাবর্তন হয়। যে কোনো বয়সের, যে কোনো সামাজিক বা নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের নারী-পুরুষেরই এটি হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির
কর্মস্থলে, পরিবারে, খুব কাছের বন্ধুদের কাছে তার সমস্যাগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। বেশির ভাগ বাইপোলার রোগীর ক্ষেত্রে সমস্যাটি তাদের কৈশোর বা শৈশব থেকেই শুরু হয়; কিন্তু সনাক্ত হতে অনেক দেরি হয়ে যায়। মেয়েদের ক্ষেত্রে মা হওয়ার পরপর কিংবা ম্যানোপজের সময়ও এ ধরণের সমস্যা দেখা দিতে পারে। আর পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবেই, সাধারণত এধরণের সমস্যাক্রান্ত ব্যক্তির আচরণকে শুরুতে মানসিক সমস্যার লক্ষণ মনে করেন না তার আত্নীয়-পরিজনরা। ফলে সমস্যাটি খুব তীব্র অবস্থায় না পৌঁছুলে চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হননা কেউ। প্রারম্ভিক অবস্থায় সনাক্ত করতে পারলে বাইপোলার নিয়ন্ত্রণ, বা নির্মূল যতোটা সহজ, দীর্ঘদিন ধরে আনডায়াগনোস্ড থাকলে এটিকে বাগে আনা তারও চেয়ে বেশি কঠিন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের ভেতর এ রোগের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না; বরং কেউ তাকে এ ব্যাপারে বলতে গেলে রেগে যান। এ কথা ঠিক যে, সুনির্দিষ্ট কোনো টেস্ট না থাকায় বাইপোলার ডিসওর্ডার সনাক্ত করা চট করে সম্ভব নয়। সেকারণেই আচরণগত এসব সমস্যা আসলে বাইপোলারের কারণেই হচ্ছে তা নিশ্চিত করার পূর্বে চিকিৎসকদেরকে সতর্কতার সাথে, সময় নিয়ে রোগীর আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে হয়।
সব রকম মানসিক সমস্যারই কিছু শরীরবৃত্তীয় উপসর্গ থাকে। কিন্তু আমাদের কাছে সাধারণত
শরীরের সমস্যাগুলোই বেশি গুরুত্ব পায়। ওদিকে ডাক্তার আর ওষুধ কোম্পানিগুলোর সু-সম্পর্কের ফল হিসেবে ওষুধকে আমরা এখন ডাল-ভাতের মতো হাপুস-হুপুস খাই। বলা হয়ে থাকে, দেশে প্রতিদিন যতো ওষুধ প্রেসক্রাইব করা হয়, কমপক্ষে তার পঞ্চাশ শতাংশ একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। মানসিক সমস্যার প্যাশেন্টও স্বাভাবিকভাবেই তার শারীরিক উপসর্গ নিয়ে ডাক্তারের কাছে যান। একগাদা ওষুধ সেবন করেও যখন কাজ হয় না, তখন ডাক্তার বদল হয়; এবং যথারীতি আবারও এত্তোগুলো ওষুধ। এভাবে আসল সমস্যাটাও আরও কেবল বাড়তেই থাকে। অবস্থা যখন ভয়ানক (সাইকোসিস) পর্যায়ে চলে যায়, ঠিক তখনই কারও কারও ভাগ্যে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সেবা মেলে। ততোক্ষণে অবশ্য অনেক দেরি হয়ে যায়।
যা হোক, এবার বাইপোলার রোগীর রোগলক্ষণ প্রসঙ্গে আসা যাক। আক্রান্ত ব্যক্তির যে দু'রকম আচরণগত/আবেগীয় বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তার একটিকে বলা হয় 'ম্যানিয়া'। এর সাথে নার্সিসিজম তথা এনপিডি'র বেশ মিল পাওয়া যায়। এই অবস্থায় রোগী অস্বাভাবিক আনন্দ অনুভব করেন। তখন তার মধ্যে খুব আত্মবিশ্বাসী ভাব কাজ করে।
দ্রুত এবং অতিরিক্ত কথা বলেন। নিজের আনন্দকে প্রকাশ করতে গিয়ে অতিরঞ্জন করেন, কখনও কখনও মিথ্যা বলেন। আক্রান্ত ব্যক্তি ফেইসবুক ব্যবহারকারী হলে, নিজে কতো আনন্দে আছেন সেটির খুব জোরালো প্রকাশে মনযোগি হয়ে থাকেন প্রায়শ, এমনকি মিথ্যা তথ্য দিয়ে হলেও। তিনি ঘুমের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না তেমন। নিজেকে অনেক শক্তিশালী মনে করেন, অস্থির থাকেন। হুট করে কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, এবং ভুল সিদ্ধান্ত নেন। কারও কারও যৌন চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। কেউ কেউ অতি অবাস্তব পরিকল্পনায় বুঁদ হয়ে থাকেন, কিংবা অতিরিক্ত টাকা-পয়সা খরচ করে থাকেন, বিশেষ করে কেনাকাটায়। টাকা না থাকলেও প্রচণ্ড ইচ্ছে জাগে অনেক খরচ করার। সমাজের বিভিন্ন নিয়ম-কানুন পরিবর্তনে নিজেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত মনে করেন তিনি। বিচারবোধ তার ঠিকমতো কাজ করে না। কাজের ফলাফল কী হবে তা না ভেবেই বিভিন্ন কাজ শুরু করতে দেখা যায় তাকে। এই আচরণগুলোর একটু লঘু মাত্রাকে 'হাইপো ম্যানিয়া' বলে।
বাইপোলারের দ্বিতীয় প্রান্তের নাম ডিপ্রেশন তথা বিষন্নতা। বিষণ্ণতার লক্ষণ হিসেবে প্রকাশ পায় অনেক দিন ধরে মন খারাপ থাকা, কোনো কাজে আগ্রহ না পাওয়া, আনন্দের অনুভূতি কমে যাওয়া, ঘুম কমে যাওয়া বা বেশি ঘুমানো, ঘুম ভেঙে এমন মনে হওয়া যে 'আরেকটি খারাপ দিন শুরু হলো', আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, কাজে মনোযোগের অভাব, অহেতুক কোনো কাজের জন্য অনুতপ্ত বোধ করা, ভালোবাসা বা যৌনতার অনুভূতি কমে যাওয়া বা হঠাৎ খুব বেড়ে যাওয়া, ভবিষ্যৎ অন্ধকার মনে হওয়া, খাবার ইচ্ছা কমে যাওয়া বা খুব বেশি খেতে ইচ্ছে করা, শারীরিক কোনো কারণ ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে মাথাব্যথা থাকা ইত্যাদি।
প্রায় ক্ষেত্রেই ম্যানিয়া'র চেয়ে ডিপ্রেশনের স্থায়িত্ব বেশি হয়ে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তি মা হলে অনেক সময় সন্তানকে সহ্য করতে পারেন না, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্তানের বাবাকেও না। অবস্থা খুব চরমে গেলে আত্মহত্যার ইচ্ছে জাগে; প্রথম দিকে আত্মহত্যা কীভাবে করা হবে—এ বিষয়ে বিস্তর পরিকল্পনায় সময় কাটে। এর বেশি এগোয় না। কিন্তু কেউ কেউ এক পর্যায়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী তা করে ফেলেন। ইন্টারনেটে সার্চ দিলে এরকম বহু বিখ্যাত ব্যক্তির নাম পাওয়া যায় যারা বাইপোলারে আক্রান্ত হয়ে শেষে আত্মহত্যা করেছেন। বিখ্যাত মার্কিন কবি Sylvia Plath এবং ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক Virginia Woolf—দু'জনেই ছিলেন বাইপোলার আক্রান্ত এবং নিজেদেরকে হত্যা করেছেন।
বাইপোলার বলতে যদিও আনন্দ আর অতি বিষাদ—এই দুই বিপরীতমূখী মানসিক অবস্থার আবর্তনকেই বুঝানো হয়, মনোচিকিৎসকগণের চিকিৎসা প্রদানের সুবিধার্থে এই রোগকে আচরণগত বৈশিষ্ট্যের সুনির্দিষ্টতা ও তীব্রতা অনুযায়ী ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো- Bipolar I, Bipolar II, Mixed State, Rapid Cycling, Cyclothymia এবং Psychosis।
প্রশ্ন হলো, এ রোগ কেনো হয়? আসলে এ রোগের কারণ সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। জেনেটিক বা বায়োলজিক্যাল কারণে এমন হতে পারে। এছাড়া এর সামাজিক কারণও অনেক। অনেকেই মনে করেন, পারিবারিক অবস্থা বিশেষ করে বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের দূরত্ব, নিঃসঙ্গতা, আনন্দহীন পড়াশুনার আরোপিত চাপ, ইমোশনাল সাপোর্টের অভাব, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর অপব্যবহার, এবং সমাজ বা রাষ্ট্রের সার্বিক সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা এখনকার শিশু-কিশোরদের মাঝে বাইপোলারের প্রাথমিক অবস্থা তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ রোগের চিকিৎসা হিসেবে ওষুধ ও সাইকোথেরাপি ছাড়াও সাবস্টেন্স এবিউজ ট্রিটম্যান্ট কিংবা ইলেকট্রোকনভালসিভ থেরাপি (ECT) ব্যবহৃত হতে পারে। আগেভাগেই চিহ্নিত হলে বাইপোলারকে কুপোকাত করা কোনো কঠিন কাজ নয়।
যাঁরা সৃষ্টিশীল (কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতশিল্পী, নাট্যাকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনেতা, পেইন্টার এবং এমন অনেকে) তাঁদের মধ্যে বাইপোলারে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞগণ। এঁদের মধ্যে মার্কিন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এবং লেখক Kay Redfield Jamison, যিনি নিজেই একজন বাইপোলার ভিকটিম (হ্যাঁ, মনোচিকিৎসকরাও মনোরোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন :P), ১৯৮৯ সালে ব্রিটিস রয়্যাল একাডেমির ৪৭ জন লেখক এবং ভিজুয়াল আর্টিস্টদের উপর এক সমীক্ষা পরিচালনা করেন। তাদের মধ্যে তিনি ৩৮ জনকে পেয়েছেন যারা বাইপোলার ডিসওর্ডারে আক্রান্ত।
এটা ঠিক যে, বিখ্যাত ব্যক্তিদের অনেকেই বাইপোলারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে এবং অনেকেই নিজেদের ক্রিয়েটিভিটি থেকে ছিটকে পড়েন, তবে নিজের প্রচণ্ড ইচ্ছেশক্তি আর সঠিক চিকিৎসার সুফলে অনেকেই পরবর্তিতে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে
সক্ষম হয়েছেন–এমন নজিরও কম নেই। এ প্রসঙ্গে কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী(২৩ তম) Justin Trudeau-র মা Margaret-এর নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। ২২ বছরের সুন্দরী তরুণী Margaret-কে ভালোবেসে নিজের দীর্ঘ ব্যাচেলর জীবনের ইতি ঘটান ৫২ বছর বয়স্ক Pierre Trudeau (ততোদিনে তিনি দেশটির ১৫তম প্রধানমন্ত্রী)। বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যেই বড়ো ছেলে জাস্টিনসহ তিন সন্তানের জন্ম দিয়ে তাদের লালন পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন মার্গারেট। উচ্ছ্বল জীবন থেকে বিচ্যুত এই তরুণীর জীবন খুব একঘেয়ে হয়ে যেতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী স্বামী তাঁর ব্যস্ত ভীষণ রাষ্ট্রীয় কাজে। সময় কোথায় তাঁর স্ত্রীকে সময় দেবার? অসম বয়সের এই দুটি মানুষের দুর্বার ভালোবাসার সবুজ এভাবেই মরে যেতে থাকে খুব দ্রুত। ঠিক যেনো ইঁটের চাপায় দূর্বার করুণ সাদা। ভয়ানক একাকিত্ব পেয়ে বসে মার্গারেটকে। ধীরে ধীরে আক্রান্ত হয়ে পড়েন বাইপোলারে। নিতে শুরু করেন নিষিদ্ধ ড্রাগ। আর বিয়ের সাত বছরের মাথায় এসে স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়িও হয়ে যায় তাঁর। জীবনের গল্পটা আরও করুণ কোনো ঘটনা দিয়ে শেষ হতে পারতো তখনই। কিন্তু তা হয়নি। টিভি উপস্থাপক, লেখক ও অভিনেত্রী মার্গারেট তাঁর বাইপোলার ডিসওর্ডারকে জয় করে এখন বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অবদান রেখে চলছেন। তিনি বর্তমানে Canadian Mental Health Association-এর একজন পৃষ্ঠপোষক, এবং বাইপোলারসহ বিভিন্ন মানসিক সমস্যা মোকাবেলায় তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্প্রতি তিনি University of Western Ontario-থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
আমাদের অনেকের একটি সমস্যা হলো, কোনো বিষয়ে বৈজ্ঞানিক তথ্যাদি জানবার পর সেগুলোর আলোকে পণ্ডিতি ফলানোর চেষ্টা করা, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অকার্যকর, কখনও উলটো ফল বয়ে আনে। ঠিক তেমনি বাইপোলার সম্পর্কে তথ্য জানার পর অনুরূপ কুফলের সম্ভাবনাও অমূলক নয়। কারও মধ্যে ডিপ্রেসন দেখে বা কাউকে অনেক আনন্দ করতে দেখে তার বাইপোলার হয়েছে ধরে নেয়া মোটেও উচিত হবে না। এ কাজটি কেবল একজন প্রশিক্ষিত, দক্ষ সাইকোলজিস্টের পক্ষেই সম্ভব। তবে উপর্যুক্ত লক্ষণগুলোর পুনঃপুন প্রকাশ কারও মধ্যে দেখতে পেলে সঠিক করণীয় হবে তাকে একজন মনরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া।
বাইপোলার সম্পর্কে ধারণা আছে এমন কারও কতোগুলো ঢালাও উপলব্ধি তৈরি হতে পারে যা ১০০% ভুল। যেমন-
ক) কেউ খুবই মুডি। তার মানে তার বাইপোলার হয়েছে
খ) বাইপোলারে আক্রান্ত লোকেরা খুব মারমুখী স্বভাবের হয় এবং সমাজে অনেক ঝামেলা তৈরি করে।
গ) বাইপোলারে আক্রান্ত ব্যক্তির পড়াশুনা, সৃষ্টিশীল কাজ করা সম্ভব নয়।
ঘ) ম্যানিয়া হলে তো ব্যাপক মজা। এ তো ভালোই।
ঙ) কিছু নির্দিষ্ট পেশা বা শ্রেণির লোকই বাইপোলারে আক্রান্ত হয়।
চ) এই রোগ কারও হলে তার পক্ষে নিজেকে স্থির রাখা কখনোই সম্ভব নয়।
ছ) বাইপোলারে আক্রান্ত কাউকে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব দেয়া উচিত নয়।
জ) বাইপোলারে আক্রান্তরা দাম্পত্য সুখ অর্জনে অক্ষম, কিংবা যৌনতায় অনাগ্রহী হয়।
ঝ) বাইপোলার আছে এমন কারও পক্ষে জীবনে সফল হওয়া অসম্ভব।
তেমনিভাবে, কেউ বাইপোলারে আক্রান্ত–এটি জানবার পর তাকে নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলো কখনোই করা উচিত নয়ঃ
ক) তোমার কি বাইপোলার হয়েছে?
খ) একটু খুলে বলো তো, কেমনে কী?
গ) হ্যাঁ, আমারও মনে হয় এরকম একটু আছে।
ঘ) তুমি কি ভালো হয়ে গেছো?
ঙ) তুমি কি ওষুধ খাচ্ছো?
চ) তুমি কী ওষুধ খাচ্ছো?
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, বর্তমানে আমরা একটি বিরূপ সামাজিক পরিমণ্ডলে বাস করছি যেখানে নৈতিকতা প্রায় নির্বাসিত, মানুষ অসততাকে দক্ষতা মনে করে আর সততাকে বোকামি। বিত্ত দিয়ে নির্ধারিত হচ্ছে মানুষের স্ট্যাটাস। নীতি আর আদর্শ ঈশপের গল্প হয়ে উঠছে দিনে দিনে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কেবল গোল্ডেন এ তথা উচ্চ জিপিএ পাওয়ার বাইরে আর কিছু দিতে অপারগ হয়ে ওঠছে ক্রমশ। ওয়ার্কিং প্যারেন্টরা তাঁদের সন্তানদেরকে পর্যাপ্ত সময় দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন নিয়মিত। কেউ কেউ নিজেদের না দিতে পারা সময়ের দায় মিটিয়ে নিচ্ছেন বহুমূল্য পণ্যের আঞ্জামে। ওদিকে প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার শৈশব-কৈশোরকে বিকারগ্রস্থ করতে উদ্যত। সর্বোপরি, পারিবারিক সুন্দর সম্পর্কের প্রতি উদাসিনতা আমাদের পরস্পরকে যেনো অচেনা করে তুলছে। এরকম পরিবেশ বাইপোলার ডিসওর্ডারের জন্য সংক্রমণের পৌষ মাস হবে –এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। । তাই আসুন প্রথমে নিজের প্রতি আরও সচেতন হই। নিজের আচরণকে আত্মসমালোচনা দিয়ে মূল্যায়ন করি, মনিটর করি। কোনো অস্বাভাবিকতা চলছে কি? তেমনটি মনে হলে মনোচিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। একই সাথে আসুন, সবাই নিজেদের পারিবারিক সম্পর্কের প্রতি আরও যত্নশীল হই, যাদেরকেে প্রিয় ভাবি, তাদের প্রতি আরও সংবেদনশীল হই, তাদেরকে সময় দিই, তাদের চোখের দিকে তাকাই, আর শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারেও খোঁজ-খবর রাখি—আসুন সবাই সবাইকে আরও ভালোবাসি, ভালো থাকার চেষ্টা করি। একবার যাদেরকে ভালোবেসেছি তাদেরকে দূরে না সরাই। ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কী?
অফ টপিকঃ
আমেরিকান র্য্যাপার ভ্যানিলা আইস-এর একটা গান আছে বাইপোলার নিয়ে। গানটি শুনে দেখতে পারেন। বেশ লাগে।
Staring at two different views on your window ledge
Coffee is going cold, it's like time froze
There you go wishing floating down our wishing well
It's like I'm always causing problems, causing hell
I didn't mean to put you through this, I can tell
We're gonna sweep this under the carpet
I hope that I can turn back the time
To make it all alright, all alright for us
I'll promise to build a new world for us two
With you in the middle (with you in the middle)
Lying down beside you what's going through your head?
The silence in the air felt like my soul froze
Am I just overthinking feelings I can't say
This gut feeling I'm tryna get off me as well
I hope we find our missing pieces, I'm just sure
We're gonna sweep it under the carpet
I hope that I can turn back the time
To make it all alright, all alright for us
I'll promise to build a new world for us two
With you in the middle (with you in the middle)
(with you)
(you)
তথ্যসূত্রঃ
ছ) https://en.wikipedia.org/wiki/Margaret_Trudeau
– সংযুক্ত ছবি সব গুগলের দান (প্রথমটি বাদে)