ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ
পাসের পর পাস দিয়ে বিরক্তিকর সেই ফুটবলের ধারা থেকে বেরিয়ে দারুণ আগ্রাসী ও কার্যকর ফুটবল উপহার দিয়ে চলেছে এই স্পেন।
Published : 01 Jul 2024, 10:40 AM
৯০ মিনিটের ম্যাচে গোলে শট ৩৫টি। এর মধ্যেই লক্ষ্যে ছিল ১৩টি। ম্যাচের ৭৬ শতাংশ সময় বল ছিল তাদের কাছেই। পাস দিয়েছেন তারা মোট ৭৯৪টি। সঠিক পাসের হার ৯৪ শতাংশ। সবচেয়ে জরুরি কাজ যেটি, সেখানেও তারা দারুণভাবে সফল। গোল করেছেন ৪টি। ফুটবল দর্শকদের জন্য এই স্পেন আগ্রাসী, নান্দনিক ও সুন্দর। প্রতিপক্ষের জন্য এই স্পেন ভয়াল ও বিপজ্জনক।
এবারের ইউরোতে এখনও পর্যন্ত সেরা দল বলা যায় স্পেনকেই। গ্রুপ পর্বে তিন ম্যাচের সবকটিতেই জয় পাওয়া একমাত্র দল ছিল তারা। শেষ ষোলোয় দলটি আরও দুর্দান্ত। কোলনে রোববার জর্জিয়াকে পর্যদুস্ত করে তারা ৪-১ গোলে।
প্রথমবার বড় টুর্নামেন্টে খেলতে এসেই নক আউট পর্বে পা রেখে চমকে দেওয়া জর্জিয়ার বিপক্ষে স্পেনের জয় প্রত্যাশিতই ছিল। তার পরও তারা নজর কেড়েছে নান্দনিকতায়, দাপটে ও কার্যকারিতায়।
একটা সময় তিকি-তাকা খেলে ইউরোপিয়ান ফুটবলে রাজত্ব করা স্পেন পরে পরিণত হয়েছিল অতীতের কঙ্কালে। তাদের তিকি-তাকা হয়ে পড়েছিল ধারহীন ও অকার্যকর। পাসের পর পাস দিয়ে মন্থর এক দলে পরিণত হয়েছিল তারা, যারা মূল কাজটিই ভুলে গিয়েছিল– গোল করা। সেই সময় স্পেনের খেলা বিরক্তিকরও লাগত অনেকের কাছে।
তবে লুইস দে লা ফুয়েন্তের কোচিংয়ে স্পেন যেন আবার ফিরে পেয়েছে পুরোনো প্রাণের ছোঁয়া। এই স্পেনের খেলা সৌন্দর্যেও যেমন চোখধাঁধানো, তেমনি তারা দারুণ ক্ষুরধারও। প্রতিপক্ষকে তারা চেপে ধরে, ঠেসে ধরে এবং অসহায় বানিয়ে ছাড়ে।
জর্জিয়ার বিপক্ষে এই ম্যাচেই যেমন, ম্যাচের প্রথম ১৫ মিনিটে প্রায় ৯০ শতাংশ সময় বল ছিল তাদের প্রায়। এই সময়ের মধ্যেই গোলে শট নিয়ে ফেলে তারা আটটি। এর দুটি ছিল লক্ষ্যে। গ্রুপ পর্বে অসাধারণ পারফর্ম করা গোলকিপার জর্জিও মামারদাশভিলি আবারও দলকে রক্ষা করেন এই সময়টায়।
স্পেন আক্রমণের পসরা সাজালেও প্রথমে এগিয়ে যায় জর্জিয়া। প্রতিআক্রমণ থেকে গোল পেয়ে যায় তারা, নিজেদের জালেই বল পাঠান স্প্যানিশ ডিফেন্ডার হবাঁন লু নহমাঁ।
টুর্নামেন্টে প্রথমবার তাদের জালে বল ঢুকল, সেটি করলেন নিজেরাই। তবে আত্মঘাতী গোলে পিছিয়ে পড়লেও আতঙ্কিত বা অস্থির হয়নি স্পেন। নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি তাদেরই ছিল। তারা গোল করার আগ পর্যন্তও একবারও মনে হয়নি, ম্যাচটি তারা হারতে পারেন। নিজের প্রক্রিয়া ঠিক রেখে তারা আক্রমণ চালাতে থাকেন। গোলই চলে আসে প্রত্যাশামতোই। প্রথমার্ধেই দলকে সমতায় ফেরান রদ্রি।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর দিকে দলকে এগিয়ে নেন ফাবিয়ান রুইস। পরে নিকো উইলিয়ামস ও দানি ওলমোর গোল আরও বাড়ায় ব্যবধান। গোটা ম্যাচে স্প্যানিশদের পারফরম্যান্সের আদর্শ প্রতিফলনই পড়ে ম্যাচের ফলে।
উইলিয়ামস ও লামিনে ইয়ামাল ম্যাচজুড়েই বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন বারবার। নিজেদের স্কিল ও কৌশলের সবটুকুই মেলে ধরে জর্জিয়ার রক্ষণকে ব্যস্ত রাখেন তারা। যদিও জর্জিয়ার রক্ষণভাগক কৃতিত্ব দিতেই হবে, এই দুজনের অনেক প্রচেষ্টাই বক্সের বাইরে আটকে রাখতে পারেন তারা।
ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে যেমন মাঠে দলের প্রাণভ্রোমরা হয়ে থাকেন রদ্রি, দেশের জার্সিতেও তাকে নিয়মিতই দেখা যাচ্ছে একই রূপে। এই ম্যাচেও তিনি খেলার গতি ও মোমেন্টাম নিয়ন্ত্রণ করেছেন, পাসের পর পাস দিয়েছেন এবং জায়গা বানিয়ে দিয়েছেন সতীর্থদের আক্রমণের জন্য। মার্ক কুকুরেইয়া যথারীতি ছিলেন প্রাণশক্তিতে ভরপুর, নিখুঁত সব পাস দিয়েছেন রুইস। সব মিলিয়ে মাঝমাঠ ছিল পুরোপুরিই স্পেনের নিয়ন্ত্রণে। ম্যাচ তাই ছিল যেন সবসময় তাদের পকেটেই।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ২০১২ ইউরোর ফাইনালে ইতালিকে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত করা সেই ম্যাচের পর এবারই প্রথম বড় কোনো টুর্নামেন্টের নকআউট ম্যাচে নির্ধারিত সময়ে জিততে পারল স্পেন। ২০১৬ ইউরোতে ৯০ মিনিটের মধ্যেই তারা হেরে যায় ইতালির কাছে। পরের সময়টায় ইউরো ও বিশ্বকাপ মিলিয়ে তাদের পাঁচটি নকআউট ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। যেখানে তাদের জয় ছিল দুটি, হার তিনটি।
ওই সময়টায় স্পেন দলকে নিয়ে বড় একটি অভিযোগের জায়গা ছিল, ম্যাচজুড়ে বল তাদের পায়ে থাকলেও খেলায় ধার ও কার্যকারিতা কম। কিন্তু এই স্পেন যেমন ফিরে গিছে ২০০৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত অসাধারণ পারফর্ম করা সেই দলটির সময়ে।
তবে ওই স্পেনে সঙ্গে তুলনায় যেতে হলেও এবার ট্রফি জিততে হবে এই স্পেনকে। সেই অভিযানে বড় একটি পরীক্ষা তাদের অপেক্ষায় ঠিক পরের ম্যাচেই। কোয়ার্টার-ফাইনালে তাদেরকে লড়তে হবে স্বাগতিক জার্মানির বিপক্ষে।