Published : 25 Aug 2015, 09:57 AM
কমিউনিটি পুলিশিং এর শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে সমস্যার সমাধান অন্যতম ও প্রধানতম। বস্তুত অপরাধ সমস্যা সমাধানের নানামুখী কৌশল অবলম্বন করে যে পুলিশিং ব্যবস্থায় অপরাধীদের অপরাধ কর্ম থেকে বিরত রাখা হয় এবং সম্ভাব্য অপরাধীদের অপরাধে জড়িয়ে পড়া থেকে বিরত রাখা হয় তাই কমিউনিটি পুলিশিং। যেহেতু অপরাধের কারণগুলো পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করে না এবং এ কারণগুলোর উৎপত্তি, বিকাশ ও পরিণতি লাভ করে খোদ কমিউনিটিতে, তাই কমিউনিটিকে অন্যতম ও প্রধানতম অংশীদার হিসেবে সাথে নিয়েই এসব কারণ দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়ে।
সমস্যা সমাধানের উদ্যোগে সমস্যার সাথে সম্পর্কিত ( হয় সমস্যা তৈরি কিংবা সমস্যা সমাধানের অনুঘটক) যে কেউ গ্রহণ করতে পারে। এ জন্য সরকারের বিভিন্ন বিভাগ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বেসরকারি ও সমাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোও । তবে নানা কারণে সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো অপরাধ সম্পর্কিত সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অপারগ না হলেও নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে। ঠিক এমন পরিস্থিতিতেই অপরাধ সমস্যা সমাধানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয় পুলিশকে।
এটা অনস্বীকার্য যে সমাজের হাজারো সমস্যার সমাধান পুলিশকে ছাড়াই হয়ে থাকে। কিন্তু অনেক সমস্যা আছে যেগুলোর সমাধানে পুলিশের উদ্যোগ গ্রহণ অনেক সময় জরুরিই শুধু নয়, অপরিহার্য ও একমাত্র উপায় হয়ে পড়ে। বস্তুত সমাজের সমস্যাগুলোর মধ্যে যে সমস্যাগুলো অন্যান্য ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠী কর্তৃক সমাধানযোগ্য নয়, অন্যরা যে সব সমস্যার সমাধানে অপারগ হয় কিংবা সমাধান করতে অস্বীকার করে, সেইসব সমস্যা শেষ পর্যন্ত পুলিশের ঘাড়ে এসে পড়ে। এমতাবস্থায়, অনেক সময় সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে পুলিশকে নেতৃত্ব ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়।
সমস্যা সমাধানের ফলাফল তিন প্রকারের হতে পারে- প্রথমত, সমস্যাটি চিরতরে দূর হবে; দ্বিতীয়ত, সমস্যাটির তিব্রতা বা ঘটন সংখ্যা কমে আসবে; তৃতীয়ত, সমস্যাটি আগের মতো থাকলেও তার ফলে সৃষ্ট ক্ষতির পরিমাণ কমে আসবে।
সমস্যাটি চিরতরে দূর করার জন্য ভিকটিম ও অপরাধী উভয়কেই সমান গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। এখানে অপরাধী, ভিকটিম, অপরাধের স্থান এবং অপরাধের সহায়তা, সুবিধাদান কিংবা অপরাধী, ভিকটিম কিংবা স্থানকে নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এ সমস্যা সমাধানের কৌশল অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সম্প্রতি জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর থানা পুলিশের উদ্যোগে কমিউনিটি পুলিশিং এর আওতায় সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে একটি সৃজনশীল উদ্যোগের খবর পাওয়া গেছে। আক্কেলপুর পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের উদ্যোগে উক্ত ওয়ার্ডকে মাদকমুক্ত হিসেবে ঘোষণা করার চেষ্টা গ্রহণ করা হয়। তবে এখানে ঘোষণার কোন কাজ হবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত সমস্যা সমাধানের কার্যকরী ও টেকসই কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। সুখের বিষয় এখানে কমিউনিটির লোকজন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশের অংশীদারিত্বে মাদক সমস্যা সমাধানের একটি স্থায়ী পন্থা গ্রহণের চেষ্টা চলছে।
এ উদ্যোগটি হল, মাদক ব্যবসায়ীদের সম্মানজনক অন্য কোন পেশায় স্থানান্তরিক ও পুনর্বাসন করা। যতদূর জানা যায়, আক্কেলপুর পৌরসভার অধীন মাদক ব্যবসায় জড়িত ১৪ জন ব্যক্তিকে স্থানীয় কমিউনিটির সহায়তা আর্থিকভাবে সহায়তা দিয়েছে। এ মহতী কর্মে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো।
পুনর্বাসন উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে, মহিলা মাদক ব্যবসায়ীদের সেলাই মেশিন দেয়া, পুরুষদের রিকসা-ভ্যান সরবরাহ, মুরগী প্রতিপালনের জন্য বিশেষ ধরনের যন্ত্র (বাচ্চা মুরগীর ঠোঁট কাটার জন্য) যন্ত্র কিনে দেয়া এবং ছোটখাট ব্যবসার জন্য পূঁজি সরবরাহ করা।
মাদক ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে তাদের পারিবারিক সমস্যা দূর করতেও স্থানীয় পুলিশ এগিয়ে এসেছে। একজন মাদক ব্যবসায়ীর ছেলে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ -৪ পেয়েছে। তার ছেলের পড়া শোনার যাবতীয় খরচ স্থানীয় পুলিশ বহন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। একজনের ছেলে বগুড়া শহরের একটি স্কুলে পড়াশোনা করে। তার লেখাপড়ার জন্য মাসিক ভিত্তিতে কিছু সাহায্য প্রদান করা হচ্ছে। এক মাদক ব্যবসায়ীর ছেলেকে স্থানীয় কৃষি ব্যাংকে মাস্টার রোলে চাকরির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এসব ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত স্থানীয় থানা পুলিশসহ অন্যান্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পর্যন্ত প্রায় এক লক্ষ টাকার মতো খরচ করেছে। ভবিষ্যতে এধরনের সমস্যা সমাধানে অর্থের উদ্যোগের জন্য কমিউনিটি পুলিশিং ফোরাম ও থানার পক্ষ থেকে ফোরাম সদস্য ও এলাকার কৃতি সন্তানদের কাছে পত্র লিখে আরো অর্থের সংস্থান করার পরিকল্পনার কথা স্থানীয় পুলিশ আমাকে জানিয়েছে।
উল্লেখ্য, কোন এলাকার সমস্যা সমাধানের জন্য 'রোল মডেলের' ভূমিকা পুলিশ অফিসারগণ পালন করলেও এ পরিকল্পনার মূল অংশীদার থাকে স্থানীয় জনগণ। তাই আক্কেলপুর থানা তথা জয়পুরহাট পুলিশ প্রশাসনকে এক্ষেত্রে আরো বেশি স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ও সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশের ব্যক্তিগত পর্যায়ে বা সাংগঠনিক পর্যায়ের কোন উদ্যোগও টেকসই ও ফলপ্রসূ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না স্থানীয় কমিউনিটি তা নিজেদের মতো করে গ্রহণ করে ও নিজেরা তা অব্যহত রাখার মতো স্থায়ী উদ্যোগ গ্রহণ করে।
আমরা জানি, কমিউনিটি পুলিশিং এর আওতায় এ ধরনের হাজারও সৃজনশীল উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এগুলোর অনেকগুলো আমাদের জানার বাহিরে থেকে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তি পুলিশ অফিসারের একক উদ্যোগেও এমনটি হচ্ছে। আমাদের উচিত হল এগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া এবং পুলিশ সদস্যসহ সাধারণ মানুষের কাছে এগুলোকে মডেল আকারে উপস্থাপন করা।(২৫ আগস্ট, ২০১৫)
রচনা সূত্র:
২. আক্কেলপুর থানার প্রেরিত প্রতিবেদন