Published : 24 Oct 2014, 11:55 AM
'নার্সিসিজম' সম্পর্কে এখন অনেকেই বেশ অবগত। অন্তর্জালে এ বিষয়ক তত্ত্ব ও তথ্যের প্রাচুর্য আপনার আগ্রহকে উষ্কে দেবার জন্য যথেষ্ঠ। মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী এটি এক ধরনের অসুস্থ্যতা, যার কিছু সুস্পষ্ট লক্ষণ ব্যক্তির আচরণের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তবে আচরণগত এসব বৈশিষ্ট্যের বেশ কয়েকটি আমাদের প্রত্যেকের মাঝেই আছে। কিন্তু সেটা রোগলক্ষণ কিনা তা নির্ভর করে এসবের মাত্রার উপর। তার আগে নার্সিসিজম আসলে কী সেটা জানা জরুরী। তবে সবার আগে চলুন জেনে নেয়া যাক গ্রিক পুরাণের দেব-দেবীর কাহিনীর সাথে 'নার্সিসিজ্ম' শব্দের উৎপত্তির ইতিসটা।
স্বর্গরাণী হেরাকে কথায়-গল্পে মাতিয়ে রাখতো তাঁর আজ্ঞাবহ প্রকৃতি দেবী একো। দারুন মজার এসব দীর্ঘ গল্প শুনে হেরা
ভীষণ মুগ্ধ হতেন। আর এভাবেই কেটে যেতো অনেক সময়। এই ফাঁকে তার ভাই ও স্বামী দেবরাজ জিউস প্রমোদে মত্ত হতেন পাহাড়ে, জঙ্গলে থাকা অন্য দেবীদের সাথে।এক সময় স্বামীর এসব কীর্তি সম্পর্কে হেরা আঁচ করতে পারলেন এবং ক্ষুব্ধ হলেন একোর উপর। কারণ কৌশলী একোই তাকে গল্প শোনায় ব্যস্ত রেখে জিউসের এইসব রতিলীলার সুযোগ করে দিয়েছে। তাই শাস্তিস্বরূপ হেরা একো'র কথা বলার শক্তি কেড়ে নিলেন। এখন শুধু অন্যের কথার শেষটুকু প্রতিধ্বনি করতে পারে সে। এদিকে ঘটলো আরেক কাহিনী। নদী-দেবতা কিফিসস-এর ছেলে নার্সিসাস হরিণ শিকারে বেরিয়েছেন। দুপুর রোদে দুরন্ত এক হরিণকে ধাওয়া করার এক পর্যায়ে একো'র নজরে পড়েন তিনি। নার্সিসাসের প্রেমে
উতলা হয়ে একো নিজেকে নিবেদন করে তার কাছে। আত্ন-অহংকারী নার্সিসাস প্রত্যাখান করেন একোকে। আর এতে প্রতিশোধের দেবতা নেমেসিস রেগে গেলেন। আর শাস্তি দিলেন এই অহংকারীকে। কী সেই শাস্তি? শিকারের পেছনে ছুটে ক্লান্ত এবং তৃষ্ণার্ত নার্সিসাস এক ঝর্ণার কাছে এলেন। ঝর্ণার পানিতে নিজের প্রতিকৃতি দেখে এমনই সম্মোহিত হলেন যে, ওখানেই পড়ে রইলেন। তিনি বুঝতেই পারলেননা যে এটা তার নিজেরই চেহারা। একসময় ওখানেই ডুবে মরলেন। আর ওই জলের ধারে জন্ম নিলো ফুলের এক গাছ। ফুলের নাম নার্সিসাস। পুরানের এই ঘটনা থেকেই ইংরেজি নার্সিসিজম শব্দের জন্ম। এর মানে নিজের মধ্যে একান্ত অভিনিবিষ্টতা, নিজের সৌন্দর্য আর সক্ষমতার অতিশায়িত অনুভূতি যা নিজের প্রতি নিমগ্নতা তৈরি করে। এক কথায় একে অতিশয় আত্নপ্রেম বলা যেতে পারে। বিজ্ঞানীরা আরেক নতুন কথা শুনাচ্ছেন এখন।সেটি হলো, ঘণ্টায় ঘণ্টায় যারা ফেইসবুকে সেলফি আপলোড করেন তারাও এক ধরণের নার্সিসিস্ট। যদি তা-ই হয়, তাহলে কার্যকারণ সম্পর্কের বিবেচনায় ফেইসবুককে নার্সিসিজমের জনপ্রিয় ভাইরাস বলা যেতে পারে। জনপ্রিয় ভাইরাস।
নার্সিসিজম রোগের কেতাবি 'নাম নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিজওর্ডার' বা 'এনপিডি'।বাংলায় বলা যেতে পারে 'অতি আত্ম-প্রেম জনিত ব্যক্তিক আচরণ বিচ্যুতি'। এটিকে শুধু রোগ নয়, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক সমস্যা হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।মানুষের প্রধান তিন ধরণের নেতিবাচক ব্যক্তিত্বের (dark triad) অন্যতম হলো এই নার্সিসিজম। অন্য দুটি ধরণ হলো ম্যাকিয়াভিলিয়ানিজ্ম এবং সাইকোপ্যাথি। তবে নিজের প্রতি সম্মানবোধ বা নিজের পারদর্শীতার উপর আস্থা কিংবা নিজের অর্জনের প্রতি ভালোবাসাজনিত সাধারণ যে অহম, যা প্রত্যেকেরই থাকে এবং থাকা উচিৎ, তা কিন্তু নার্সিসিজম তথা এনপিডি নয়। এই অক্ষতিকর ব্যক্তিত্ববোধকে ফ্রয়েড নাম দিয়েছেন প্রাইমারি নার্সিসিজম। অবশ্য বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এটি 'হ্যাল্দি নার্সিসিজম' অর্থাৎ 'স্বাস্থ্যকর আত্ন-প্রেম' নামে পরিচিত হতে শুরু করে।
নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিজওর্ডার (এনপিডি)-এ আক্রান্তদের মধ্যে নিচের সবগুলো বা বেশিরভাগ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়ঃ
এদিকে স্বনামধন্য মার্কিন মনোচিকিৎসক এবং মনোবিশ্লেষক ডক্টর স্যান্ডি হচ্কিস-এর মতে একজন নার্সিসিস্ট-এর সাত ধরণের আচরণগত বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে, যেগুলোকে তিনি 'ডেড্লি সিন্স' বা ভয়াবহ পাপ নামে অভিহিত করেছেন। এগুলো হলোঃ
এবার আসা যাক 'হেল্দি নার্সিসিজম' প্রসঙ্গে। হেল্দি নার্সিসিজম হলো নিজের সত্তার এক সুস্থিত সত্য বা সত্যোপলব্ধি, নিজের প্রতি নিজের এবং অন্য বস্তুর আনুগত্য অর্জন, সত্তার স্বাভাবিকতা এবং পরম অহংবোধের সুসংহত অবস্থা, এবং প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা ও উম্মত্ততার মধ্যে বিরাজমান ভারসাম্য। এটি ব্যক্তির মাঝে এক ধরণের অপরিবর্তনীয়, বাস্তবধর্মী স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতা এবং পরিণত লক্ষ্য ও বিশ্বাস আর সেই সাথে বস্তু-কেন্দ্রিক সম্পর্ক গঠনের সক্ষমতা তৈরি করে। এটা অনেকটা অনিরাপত্তা ও অপর্যাপ্ততা প্রতিরোধী একধরণের আত্মবিশ্বাস। মানুষের স্বাভাবিক ব্যক্তিত্বের বিকাশে হেল্দি নার্সিসিজম অত্যাবশ্যকীয়। এতে আত্মপ্রেম অবশ্যই আছে তবে তা চারপাশের বাস্তবতাকে লীন করে এককেন্দ্রিকতা দেয়না। তাই এটি রোগের কোনো লক্ষণ নয়। এটি মানসিক সুস্বাস্থের সহায়ক।
এটা ঠিক যে, এই এনপিডি নিয়ে অনেকেই বিভিন্ন পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেছেন এবং মতামত দিয়েছেন। আর এভাবেই এর প্রকরণে যোগ হয়েছে নিত্য নতুন মাত্রা।
যেমন এই শতাব্দীর একজন খ্যাতনামা মনোবিজ্ঞানী সুইজারল্যান্ডের এ্যলিস মিলার, ২০১০-এর এপ্রিলে যার জীবনাবসান হয়েছে, নতুন এক অভিধা যুক্ত করেছেন যার নাম 'নার্কাস্টিক এ্যবিউজ' যা দ্বারা শিশুদের উপর বাবা-মা কর্তৃক একধরণের মানসিক নির্যাতনকে বুঝায়। এ্যলিসের ভাষায় এ ধরণের বাবা-মা হলেন 'নার্সিসিস্টিক প্যারেন্ট্স, যারা অল্প বয়ষ্ক সন্তানের স্বতঃস্ফূর্ত ইচ্ছের বিকাশকে রুদ্ধ করে নিজেদের সম্মান বৃদ্ধির প্রয়োজনে, নিজেদের অপূর্ণ ইচ্ছেকে সন্তানের ভেতর বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে যেকোন চেষ্টায় পিছপা হননা। মূলত, বাবা-মা তাদের নিজেদের রচিত ভবিষ্যৎ রূপরেখা সন্তানের উপর চাপিয়ে দেন—যা এক ধরণের নিষ্ঠুরতা। এর ফলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ ধরণের বাবা-মার সাথে শীঘ্রই সন্তানের দূরত্ব তৈরি হয়, আর তার চেয়েও ভয়ঙ্কর হলো, সন্তানের ভেতর আত্ন-হনের প্রবণতা তৈরির সম্ভাবনাও কম নয়।
কর্মক্ষেত্রেও নার্সিসিজমের উপস্থিতি লক্ষনীয়, যা কর্মচারী এবং মালিক উভয়ের মাঝেই থাকতে পারে। একে বলা হয় কর্পোরেট নার্সিসিজম। যে মালিকের কাছে প্রফিট-ই একমাত্র লক্ষ্য, কিন্তু কর্মচারীর সুবিধা-অসুবিধা, স্বাস্থ্য এবং ঝুঁকির বিষয়টি কখনোই তার মাথায় আসেনা—তিনি আসলে নার্সিসিজমের শিকার। মালিক রোগীর এধরণের সংকীর্ণ মানসিকতা স্বল্পমেয়াদে বেশ সুবিধা বয়ে আনলেও আখেরে প্রতিষ্ঠানের জন্য বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে একজন নার্সিসিস্ট কর্মচারী কর্মক্ষেত্রে আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগে অদক্ষ হয়ে থাকেন। আর তার অতি সংবেদনশীলতা তাকে একসময় সন্ত্রস্ত করে তোলে। প্রায়শঃ তিনি সহকর্মীদের স্বাভাবিক ব্যবহার/আচরণকেও ভুল বুঝে কষ্ট পান এবং খুব সজেই অনেক বেশি আক্রান্ত বোধ করেন। ফলে কর্মক্ষেত্রে তার নিজের উৎপাদনশীলতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়, যা তার অবস্থান এবং আত্ম-সম্মানবোধকে আরও বেশি আহত করে।
'কনভার্সেশনাল নার্সিসিজ্ম' বলতে কথোপকথনের সময় আত্মমগ্নতার এক বিশেষ প্রকাশকে বুঝায়। সাধারণত বন্ধু-বান্ধব, নিকট আত্নীয়-স্বজনদের মাঝে কথা বলার সময় এই আচরণ অন্যদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। একজন নার্সিসিস্ট সাধারণত কারও সাফল্য কিংবা আনন্দের গল্প শুনতে আগ্রহী নন, বা শুনলেও তিনি খুশি হতে পারেননা; বরং
সেরা প্রমাণের চেষ্টা করেন। অন্যের কাছ থেকে নিজের প্রশংসা শোনার জন্য ভীষণ ব্যাকুল থাকেন তিনি, এবং প্রশংসাকারী ব্যাতীত অন্য কারো গুণের কথা সাধারণত তিনি স্বীকার করেননা এবং তাদের সাথে তার সখ্যও হয়না। নিজের প্রাপ্তি আর সম্ভাবনার কথা প্রচার করতে এ ধরণের রোগী এতো মরিয়া হয়ে উঠেন আর বিষয় বর্ণনায় এতো অতিরঞ্জন করে থাকেন যে অন্যেরা বিরক্ত হতে বাধ্য হন। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, মোল্লা, আইনজীবিদের অনেকের মাঝে এই ধরণের প্রবণতা সহজেই চোখে পড়ে। সমালোচনাকারী আর শত্রু এদের কাছে সমার্থক। এরা সাধারণত আত্মসমালোচনা করতে অপারগ। আত্নম্ভরিতার চর্চায় স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কোনো কিছুকে বিচারের ক্ষমতা হারিয়ে এরা সবার অলক্ষ্যে অনেকটা প্রতিবন্ধী হয়ে সমাজে বাস করতে থাকেন, বিনা চিকিৎসায়।
'সেক্সুয়্যাল নার্সিসিজ্ম' বলতে নিজের যৌনতা কিংবা প্রেমিক-সত্তার সক্ষমতাকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে কল্পনা করার প্রবণতাকে বুঝায়। কল্পনার এই নিমগ্নতা খুব দ্রুত দেহ-ভঙ্গি বা অন্যান্য বাহ্যিক আচরণে প্রকাশ পেতে থাকে। ছেলেদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এ ধরণের নার্সিসিস্টরা প্রেমকে যৌনতার প্রাপ্তি দিয়ে বিচার করতে পছন্দ করেন। এর ফলে এরা সত্যিকারের আত্মিক সম্পর্কের চর্চার ব্যাপারে উদাসীন থাকেন। নানাবিধ যৌন বিকার, নারীর উপর যৌন-নির্যাতন, পারিবারিক নির্যাতনের কারণ হিসেবে অনেক ক্ষেত্রেই সেক্সুয়াল নার্সিসিজ্ম দায়ী বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানীরা।
এখন প্রশ্ন হলো এই রোগের কবল থেকে বাঁচার উপায় কী? এ ব্যাপারে প্রথমেই বলতে হয় যে, এটি নিজে নিজে সারানো বেশ মুশকিল। প্রথমত, এটা অনেকগুলো আচরণগত বৈশিষ্ট্যের সমম্বয়ে সৃষ্ট এক ধরণের জটিল সমস্যা, যা হুট করে বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে দূর করা সম্ভব নয়, যেখানে ধূমপানের মতো অভ্যাসকে ত্যাগ করাটাই অসম্ভব মনে হয় ধূমপায়ীর কাছে। দ্বিতীয়ত, আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ সম্পর্কিত সচেতনতার মানে এই নয় যে তিনি বুঝে গেছেন করণীয় কী, কারণ রোগের ধরণ অনুযায়ী প্রতিকারের উপায় সচেতনতা দিয়ে জানা সম্ভব নয়—এজন্য দরকার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পেশাদারী অভিজ্ঞতা। সেজন্য একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট/থেরাপিস্ট-এর বিকল্প খুঁজতে যাওয়া নিতান্তই অনর্থক। তবে অন্যের দৃষ্টিভঙ্গিকে, দুঃখকে বুঝবার এবং মনোযোগি শ্রোতা হওয়ার চেষ্টা করা, নিয়মিত আত্ম-সমালোচনা করা, বই পড়া, নতুন বন্ধু তৈরি করা এবং সামাজিক কাজকর্মে খোলা মন দিয়ে অন্যদের সাথে অংশগ্রহণ করা, ইত্যাদি এই রোগের নিরাময়ে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে থাকে। আসুন আমারা নার্সিসিজ্ম থেকে নিজেরা দূরে থাকি, অন্যদেরকেও দূরে রাখি।