আবাসিককে বাণিজ্যিক প্লট করার সুযোগ নিয়ে প্রশ্ন

গুলশান, বনানী, বারিধারা এবং উত্তরার কয়েকটি সড়কের পাশের আবাসিক প্লটকে বাণিজ্যিক প্লটে পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 May 2023, 07:16 PM
Updated : 21 May 2023, 07:16 PM

ঢাকার কয়েকটি এলাকায় আবাসিক প্লটকে বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তরের যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাতে গলদ দেখছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। আবাসিক এলাকায় বসবাসরতদের মধ্য থেকেও আসছে আপত্তি।

রাজউকের যুক্তি, বিভিন্ন আবাসিক প্লটকে এখন অবৈধভাবে বাণিজ্যিক ভবনে রূপ দেওয়া হয়েছে, নতুন সুযোগ সেই পথ বন্ধ করবে।

তবে এই সুযোগে নিতে রাজউকে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হওয়ার শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। গুলশান, বনানী, বারিধারা এবং উত্তরার কয়েকটি সড়কের পাশের আবাসিক প্লটকে বাণিজ্যিক প্লটে পরিবর্তন করার সুযোগ দিয়ে গত ৩ মে পরিপত্র জারি করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

যা আছে পরিপত্রে

  • গুলশান আবাসিক এলাকার গুলশান এভিনিউ, বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, বারিধারা আবাসিক এলাকার প্রগতি সরণি এবং উত্তরা ১ম পর্ব ও ২য় পর্বে জসীম উদদীন এভিনিউ, রবীন্দ্র সরণি, সোনারগাঁ জনপথ, গাউসুল আজম আজম এভিনিউ, গরীবে নেওয়াজ এভিনিউ, শাহ্ মখদুম এভিনিউ, শাহজালাল এভিনিউ, ঈশা খাঁ এভিনিউ ও আলাওল এভিনিউর আবাসিক প্লট বাণিজ্যিক করা যাবে।

  • রাজউকের আওতাধীন অন্যান্য এলাকার ১০০ ফুট প্রশস্ত সড়কের পাশের আবাসিক প্লটও বাণিজ্যিক হিসেবে পরিবর্তন করা যাবে।

  • অর্থাৎ, ঢাকায় রাজউকের অনুমোদিত বেসরকারি ৩৬টি আবাসিক প্রকল্প এবং প্রকল্পের বাইরের অন্যান্য এলাকায় যেখানে ১০০ ফুট প্রশস্ত সড়ক আছে, সেখানেই চাইলে আবাসিক প্লট বাণিজ্যিক করা যাবে।

খরচ কত

  • গুলশান, বনানী এবং বারিধারা এলাকায় আবাসিক প্লট থেকে বাণিজ্যিক প্লটে পরিবর্তনের জন্য প্রতি কাঠায় ফি দিতে হবে ১ কোটি টাকা। বারিধারা জে ব্লকের ক্ষেত্রে এই ফি হবে ৫০ লাখ টাকা। এছাড়া উত্তরা (১ম পর্ব ও ২য় পর্ব) আবাসিক এলাকায় এই ফি কাঠা প্রতি ৫০ লাখ নির্ধারণ করা হয়েছে।

  • সেখানে ইতোমধ্যে অবৈধভাবে বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহৃত প্লটের মালিকদের আগামী ছয় মাসের বাণিজ্যিক প্লটে পরিবর্তনের আবেদন ও প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শুরু করতে হবে। এক্ষেত্রে নির্ধারিত জরিমানাসহ পরিবর্তন ফি নিবে রাজউক। নির্ধারিত সময়ে প্লটের ধরন পরিবর্তনের আবেদন না করলে রাজউক আইনগত ব্যবস্থা নিবে।

কোন যুক্তিতে?

কী কারণে এই পদক্ষেপ- জানতে চাইলে রাজউকের চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বর্তমানে বিভিন্ন ছোট ছোট সড়কে অনেকে নানা কায়দায় বাণিজ্যিক ভবন করে নিয়েছে। তা শৃঙ্খলায় আনতে চান তারা।

“যেমন বনানী ১১ নম্বর রোড, এটা আগে ঘোষিত বাণিজ্যিক রোড। যেহেতু এটা ১০০ ফুট প্রশস্ত না এ কারণে সড়কের বাণিজ্যিক মর্যাদা কিন্তু আমরা বাতিল করে দিয়েছি। এছাড়া আবাসিক যেসব সড়কে এরইমধ্যে বাণিজ্যিক ভবন গড়ে তোলা হয়েছে সেগুলোর বিষয়েও আমরা পদক্ষেপ নেব। অবৈধভাবে যেন কেউ থাকতে না পারে।”

‘ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত’

আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক অনুমোদন একটা ‘ভয়ঙ্কর’ সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের আদিল মুহাম্মদ খান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সব সময় বলা হচ্ছে ঢাকা থেকে ভার কমাতে হবে, বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। কিন্তু হচ্ছে তার উল্টোটা। ঢাকায় নতুন যে কোনো বাণিজ্যিক এবং শিল্প উদ্যোগ এই শহরের পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে।

“এই যে প্রক্রিয়াটা করলো এতে কোনো ধরনের প্ল্যানিং এনালাইসিস নাই। ইচ্ছে হল আর আবাসিক এলাকায় কমার্শিয়াল অনুমোদন দিয়ে দিল। যারা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তারা কি সুদূরপ্রসারী কোনো চিন্তাভাবনা করে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন? নাকি কারও ডিমান্ড আছে, প্রেসার আছে সেজন্য এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে?”

এমন সন্দেহ প্রকাশ করলেন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন-রিহ্যাবের একজন নেতাও; যদিও এতে আবাসন ব্যবসায়ীদের লাভ হবে বলে মনে করেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই আবাসন ব্যবসায়ী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সুযোগ দিতে হয়ত নতুন এই নিয়ম করা হয়েছে।”

এতে পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায় যানজট আরও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি গুলশান এভিনিউর উদাহরণ দিয়ে বলেন, “গুলশান এভিনিউ আবাসিক এলাকা ছিল, বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তরের সুযোগ দিয়ে ওই এলাকায় এখন যানজট বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গুলশান এক থেকে গুলশান দুই নম্বর যেতে এখন এক ঘণ্টা লেগে যায়।

“যেটা আবাসিক এলাকা সেটাকে কেন বাণিজ্যিক এলাকা করতে হবে? এমনিতেই গুলশান, বনানী এলাকায় গাড়ি নিয়ে কেউ চলাচল করতে পারে না, এত যানবাহন। আবারও যদি মূল সড়কের আবাসিক প্লটগুলো বাণিজ্যিক করে ফেলে, তাহলে তো ওই এলাকাটা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।”

“এটা করা হলে হয়ত আবাসন ব্যবসায়ীদের কিছুটা লাভ হবে, কিন্তু গাছই যদি না বাঁচে, তাহলে আপনি ফল খাবেন কী করে? এভাবে চলতে থাকলে শহরে আবাসিক এলাকা বলে কিছু থাকবে না। আমাদের শহর বাঁচবে না,” বলেন তিনি।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক এবং বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক সারওয়ার জাহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এগুলো সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণে রাজউকের ব্যর্থতার ফল।

“কোন এলাকায় কতগুলো মানুষ থাকবে, কতটা আবাসিক, কতটা বাণিজ্যিক করা হবে, সেটা ঠিক করা থাকে। কিন্তু আমাদের এখানে সবগুলোই রেসিডেন্সিয়াল এলাকা করে রেখেছে। কিছু মার্কেট করেছে। লোকসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিমান্ডও পরিবর্তন হয়। ফলে এখন তারা ধরন পরিবর্তন করছে। এছাড়া নানা রকম প্রেসার গ্রুপও কাজ করে।”

যা বলছেন বাসিন্দারা

উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা আপেল মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, উত্তরা এলাকার সড়কগুলোয় এখনই সারাদিন যানজট লেগে থাকে। আবাসিক প্লট বাণিজ্যিক করার সুযোগ দিলে তা আরও বাড়বে।

“মাস্টারপ্ল্যানে উত্তরাকে আবাসিক এলাকা হিসেবে দেখান হয়েছে। সেখানে পরিবর্তনের মাধ্যমে আবাসিক এলাকাটির ধরনই চেঞ্জ করে দেওয়া হচ্ছে।”

এটা দুর্নীতির একটি সুযোগ তৈরি করবে বলে ধারণা রাজধানীর এই বাসিন্দার। তিনি বলেন, “রাজউকের মূল কাজ ছিল মানুষের সেবা করা। কিন্তু তারা একটি চাঁদাবাজ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

“এলাকায়গুলোয় বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তরের জন্য একটা নির্ধারিত ফি দিতে হবে। কিন্তু এর বাইরেও একটি প্লটকে বাণিজ্যিক রূপান্তর করতে হলে কোটি কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়। এটাই তাদের মূল উদ্দেশ্য।”

আবাসিক এলাকাকে আবাসিক এলাকা হিসেবে ধরে রাখার পক্ষে মত দেন গত ৫ বছর ধরে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বসবাসরত সরকারি চাকুরে নূর উল্লাহ সোহেল।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আবাসিক এলাকার নির্দিষ্ট স্থানে স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কিছুর অনুমোদন দেওয়া ঠিক না। আবাসিক এলাকায় আবাসিক কার্যক্রম হবে, বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য বাণিজ্যিক এলাকা। আবাসিকে বাণিজ্যিক অনুমোদন মোটেও ঠিক না। কারণ প্রচুর যানবাহন আসে, ক্রাউড হয়।”

পরিপত্রে আরও যা

  • গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরা (১ম পর্ব ও ২য় পর্ব) আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্লটে পরিবর্তন প্রকল্প এলাকাগুলোর মাস্টারপ্ল্যান, ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ), ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ভূমি ব্যবহার সংক্রান্ত প্রচলিত আইন ও বিধি-বিধান ইত্যাদির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না।

  • সুপারিশকৃত রাস্তা বা সড়ক ছাড়া অন্য কোনো রাস্তার পাশের প্লট রাজউকের অনুমোদন ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হলে রাজউক লিজ দলিলের শর্তা অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা নেবে।

  • বারিধারা কে ব্লক ও গুলশানের নর্থ এভিনিউয়ের কয়েকটি ব্লকে কূটনৈতিক এলাকা থাকায় নিরাপত্তা সংস্থার অনাপত্তি নেওয়া সাপেক্ষে নির্ধারিত রাস্তা সংলগ্ন প্লটকে বাণিজ্যিক প্লটে পরিবর্তনের অনুমোদন দেওয়া যাবে।

  • প্লটের ধরন পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বাধ্যতামূলকভাবে সুয়্যারেজ, বর্জ্য অপসারণ এবং পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা হিসেবে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, বর্জ্য শোধনাগার, স্যয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন এবং সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

  • অনুমোদনের পর পরিবর্তিত বাণিজ্যিক প্লটে অবশ্যই অনাচ্ছাদিত স্থানের ন্যূনতম ৫০ শতাংশ শোষণযোগ্য ভূমি রাখতে হবে।