হজযাত্রীরা ভিসা জটিলতায়, বিমানও বিড়ম্বনায়

এজন্য হজ এজেন্সিগুলোকে দায়ী করে ৯০টিকে নোটিস পাঠিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 June 2023, 03:18 AM
Updated : 5 June 2023, 03:18 AM

হজ এজেন্সিগুলো ভিসা প্রক্রিয়া শেষ না করায় জটিলতায় পড়েছেন হজযাত্রীরা; গত ১০ দিনে অন্তত ৬ হাজার ২২৮ জন হজযাত্রীর ভিসা না হওয়ায় শুধু বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ছয়টি হজ ফ্লাইট বাতিল করতে হয়েছে, অনেক ফ্লাইট গেছে বেশ কিছু আসন খালি রেখে।

আটকে পড়া এই হজযাত্রীরা এবার হজে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

এই পরিস্থিতির জন্য হজ এজেন্সিকে দায়ী করছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। রোববার ৯০টি এজেন্সিকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এবারের হজযাত্রীদের ভিসা সম্পন্ন না করে আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে মন্ত্রণালয়।

বিমান বলছে, সৌদি আরবে সস্তায় বাড়ি ভাড়া খুঁজতে গিয়ে এজেন্সিগুলো দেরি করছে। আর বাড়ি ভাড়ার ছাড়পত্র ছাড়া সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ হজযাত্রীদের ভিসা দিচ্ছে না।

তবে এজেন্সিগুলোর সংগঠন হজ এজেন্সিজ অব বাংলাদেশের (হাব) বলছে, ভিসা নিয়ে কোনো ‘ক্রাইসিস’ নেই।

এবছর হজে যেতে ১ লাখ ২২ হাজার ২২১ জন নিবন্ধন করেছেন। এর অর্ধেক অর্থাৎ প্রায় ৬২ হাজার যাত্রী পরিবহন করবে বিমান। বাকি অর্ধেক পরিবহন করবে সৌদি আরবের বিমান সংস্থা সৌদিয়া ও ফ্লাই নাস। সেই হিসেবে এখন পর্যন্ত বিমানের মোট হজযাত্রীর প্রায় ১০ শতাংশই ফ্লাইট মিস করে বসে আছেন।

গত ২১ মে ভোর থেকে শুরু হয়েছে হজ ফ্লাইট। প্রায় ১৫ দিন পরে এসে এখনও ৪০ হাজারের মতো নিবন্ধিত হজযাত্রীর ভিসা সম্পন্ন হয়নি বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে।

এই হজযাত্রীরা যেসব এজেন্সির, সেই ৯০টিকে রোববার নোটিস পাঠান হয়েছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হজ-১ শাখা থেকে। আগামী তিন দিনের মধ্যে তার জবাব দিতে বলা হয়েছে।

নোটিসে বলা হয়েছে, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গত ৩১ মে’র বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী এবারের সকল হজ কার্যক্রম পরিচালনাকারী এজেন্সিকে তিন দিনের মধ্যে স্ব স্ব এজেন্সির সকল হজযাত্রীর ভিসা সম্পন্ন করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল।

“যেহেতু আপনারা অদ্যাবধি আপনাদের এজেন্সির নিবন্ধিত হজযাত্রীদের ভিসা ইস্যু করেননি; যা সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনায় অসহযোগিতার সামিল।”

এতে সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনায় বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে জানিয়ে নোটিসে হুঁশিয়ার করে বলা হয়, এ ঘটনায় সরকারের হজ ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট নির্দেশনা উপেক্ষিত হয়েছে; যা হজ ও ওমরাহ ব্যবস্থাপনা আইনের পরিপন্থি।

ধর্ম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় ৯০টি হজ এজেন্সির বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে নোটিসে জানানো হয়।

বিড়ম্বনায় বিমান

রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সংস্থা বিমানের এখন প্রতিদিন পাঁচটি করে ফ্লাইট হজযাত্রীদের নিয়ে সৌদি আরব যাচ্ছে। প্রতি ফ্লাইটের ধারণ ক্ষমতা ৪১৯ জন।

কিন্তু নির্ধারিত হজযাত্রীদের ভিসা না হওয়ায় খালি যাচ্ছে বিমানের ফ্লাইট। হজযাত্রার প্রথম দিনই শুরু হয় এই জটিলতা। প্রথম দিনে বিমানের একটি ফ্লাইটেই ভিসা জটিলতায় যেতে পারেননি ১৪০ জন হজযাত্রী। ফাঁকা আসন নিয়ে উড়তে হয় বিমানের উড়োজাহাজটিকে। পরের দিনগুলোতে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। পরবর্তীকালে এই হজযাত্রীদের কী করে সৌদি আরবে পৌঁছানো যাবে, তা নিয়ে চিন্তায় বিমান কর্মকর্তারা।

বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শফিউল আজিম রোববার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভিসা না থাকায় গত ১ জুন পর্যন্ত ৬ হাজার ২২৮ জন হজযাত্রী ফ্লাইটে উঠতে পারেননি। বাতিল করতে হয়েছে ছয়টি ডেডিকেটেড হজ ফ্লাইট।

“১ তারিখে চিঠি দিয়েছি ধর্ম মন্ত্রণালয়কে। আমরা তাদের টিকিট ইস্যু করেছি, কিন্তু তারা যেতে পারছে না। প্রথম দিন থেকেই তারা এমন শুরু করেছে। আমাদের আসন খালি নিয়ে সৌদি আরব যেতে হয়েছে। এরকম চলতে থাকায় আমরা ধর্ম মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি।”

Also Read: ভিসা জটিলতা: হজযাত্রার প্রথম দিনেই ‘ফ্লাইট মিস’ ১৪০ জনের

হজ মৌসুমে কোন দেশ থেকে কতগুলো ফ্লাইট কখন সৌদি আরব যাবে, সেই সময়সূচি আগে-ভাগেই নির্ধারণ করে দেয় সৌদি কর্তৃপক্ষ। ব্যস্ত শিডিউলের কারণে ডেডিকেটেড হজ ফ্লাইটগুলোকে হজযাত্রীদের নামিয়ে দিয়েই খালি চলে আসতে হয়, ফিরতি যাত্রী তোলার সুযোগ নেই।

এই অবস্থায় আটকে পড়া হজযাত্রীদের জন্য নতুন করে শিডিউল পাওয়াও কঠিন বলে জানান বিমানের এমডি শফিউল।

তিনি বলেন, “আমাদের তো ৬২ হাজার হাজি সাহেবকে নিয়ে যেতে হবে। সেটার জন্য আমরা একটা শিডিউলড স্লট সৌদি আরব থেকে অনুমোদন করিয়েছি। এই শিডিউল অনুযায়ী যেতে না পারলে তো সমস্যা। ১ জুন পর্যন্ত ৬ হাজার ২২৮ জন যেতে পারেননি। কোনো কোনো ফ্লাইট খালি চলে যাচ্ছে। এভাবে জমে গেলে তো পরে সৌদি আরবের অতিরিক্ত স্লট না পেলে তাদের পরিবহন করা যাবে না।

“এজেন্সিগুলো এখন যাত্রী দিচ্ছে না, তারা তাদের সুবিধামতো হাজি সাহেবদের পাঠাতে চায়। অথচ আমাদের শিডিউল অনুযাযী হাজি সাহেবদের পাঠাতে তারা দায়বদ্ধ ও ওয়াদাবদ্ধ। এত লাভ তো পাইপাই করে হিসেব করলে হবে না।”

তবে এখন থেকেও যদি যদি এজেন্সিগুলো যাত্রী পাঠায়, তাহলেও সমস্যা কাটিয়ে নেওয়া যাবে বলে জানান তিনি।

শফিউল বলেন, “প্রতিদিন আমাদের পাঁচটা ফ্লাইট যাচ্ছে বোয়িং ৭৭৭। একেকটি ফ্লাইটের ধারণ ক্ষমতা ৪১৯ জন। আমরা যে ক্যাপাসিটি লসটা করছি, তাতে সরাসরি বিমান ও সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে হাজি সাহেবদের সংখ্যাটা জমে যাচ্ছে।

“এখনও আমাদের নিয়মানুযায়ী যদি হাজি সাহেবদের দিয়ে দেন, তাহলে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা না। সব মিলিয়ে আমরা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিটিং করেছি। এখন এজেন্টরা যদি নিয়ম মেনে চলে, তাহলে ইনশাল্লাহ আমরা তাদের সৌদিতে পৌঁছাতে পারব।”

এবার জুন মাসের একেবারে শেষ দিকে হজ অনুষ্ঠিত হবে। তর আগে ২২ জুন হজযাত্রীদের নিয়ে পৌঁছবে বিমানের শেষ ফ্লাইটটি।

সমস্যা বাড়ি ভাড়া? যা বলছে হাব

এজেন্সিগুলো সৌদি আরবে বাড়ি ভাড়া কমাতে আগে হজযাত্রী পাঠাতে চাইছে না বলে বিমান সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

বিমানের এমডি শফিউল আজম বলেন, “এজেন্সিগুলো তাদের সুবিধামতো কোথায় সস্তা বাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে, কোথায় কম টাকায় রাখা যাবে, এসব খুঁজছে।

“ভিসা না পাওয়ার কারণও এটা। বাড়ি ভাড়া দেখাতে না পারলে সৌদি কর্তৃপক্ষ তাদের ভিসা দেবে না। এটা দেশের হজ-ওমরাহ নীতির পরিষ্কার লঙ্ঘন।”

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে হাব সভাপতি শাহাদাত হোসাইন তসলিম দাবি করেন, সমস্যা ততটা গুরুতর বলে তারা মনে করছেন না।

তিনি রোববার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভিসার সমস্যাটা ৫-৬ দিন আগের কথা। ভিসা পান নাই বা পাবেন না, এমন কোনো কথা নেই।”

তাহলে ভিসা না পাওয়ায় অনেকের ফ্লাইট মিসের বিষয়টি তুলে ধরলে তসলিম বলেন, “সৌদি আরব থেকে বলা হয়েছিল যে, যাতে দ্রুত হাজি সাহেবদের ভিসা করে ফেলা হয়। এটা আসলে একটা তাগিদপত্র, আমরাও এজেন্সিগুলোকে সেই পত্র দিয়েছি। সৌদি সরকার আমাদের সরকারকে একটা তাগিদ দিয়েছে।”

কারও ভিসা আটকে থাকবে না দাবি করে তিনি বলেন, “এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। ফ্লাইট শুরু হয়েছে পরে আমাদের ভিসা প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। যার ফ্লাইট আরও ১৫ দিন পরে, তার ভিসা হয়ত আরও দু-একদিন পরে হবে।

“এজেন্সিগুলো একটু হাতে সময় রেখে এসব করে। কারণ কেউ এই সময়ে অসুস্থ হয়ে গেলে আর কিছু করার থাকে না। উনার তো সব টাকা খরচই হয়ে গেল। এটা (ভিসা) নিয়ে কোন ক্রাইসিস নেই।”

ভিসার সমস্যার কারণে ফ্লাইট খালি যাচ্ছে- এমন তথ্য জানালে তসলিম বলেন, “এটা বলতে পারবে বিমান। আমার এ বিষয়ে কিছু বলা ঠিক না।”