করতেন ডাকাতি, জেলে গিয়ে ভিড়লেন জঙ্গি দলে

র‌্যাব বলছে, ২০০৭ সালের আগে ডাক বিভাগে চাকরি করতেন রণবীর। পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতি করতেন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Jan 2023, 10:22 AM
Updated : 24 Jan 2023, 10:22 AM

নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান ওরফে মাসুদ ওরফে রণবীর প্রথম জীবনে ছিলেন ‘ডাকাত’। কারাবন্দি অবস্থায় আরেক জঙ্গি সংগঠন জেএমবির শীর্ষনেতাদের সংস্পর্শে এসে তিনিও উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়েন বলে র‌্যাব কর্মকর্তাদের ভাষ্য।

সোমবার কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকা থেকে গোলাগুলির পর ৪৪ বছর বয়সী রণবীরসহ দুজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় র‌্যাব। গ্রেপ্তার অন্যজন হলেন জঙ্গি সংগঠনটির ‘বোমা বিশেষজ্ঞ’ আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলম ওরফে টয়।

ওই অভিযান নিয়ে মঙ্গলবার ঢাকার কারওয়ানবাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গ্রেপ্তার রণবীর ও বাশারের বিষয়েও বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার রণবীর জামাতুল আনসারের শূরা সদস্যও। তার বাড়ি সিলেটে।

“২০০৭ সালের আগে ডাক বিভাগে চাকরি করতেন রণবীর। পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতি করতেন। ডাকাতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা হয়। সেইসব মামলায় ২০০৭ পরবর্তী সময়ে কয়েক দফায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করেন রণবীর।

“কারাগারে থাকাকালে বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের সঙ্গে তার সদ্ভাব হয়। জেএমবির শীর্ষ নেতাদেরও সংস্পর্শেও আসেন তিনি। একপর্যায়ে তিনি জঙ্গিবাদের দীক্ষা নিয়ে জেএমবিতে যুক্ত হন।”

র‌্যাব বলছে, কারাগার থেকে জামিনে বের হওয়ার পর জেএমবির জন্য কাজ শুরু করেন রণবীর। মূলত জেএমবির যেসব সদস্য কারাগারে আছেন, তাদের পরিবারের দেখভাল করতেন তিনি। কারাবন্দি জেএমবি সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগও রক্ষা করতেন।

জামাতুল আনসারের এখনকার শূরা সদস্য এবং অর্থ ও মিডিয়া শাখার প্রধান মোশাররফ হোসেন ওরফে রাকিবের সঙ্গে ২০১৭ সালে পরিচয় হয় রণবীরের। রাকিবের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হিসেবে জামাতুল আনসারে যোগ দেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিক বলেন, কারাগারে গিয়ে সাধারণ অপরাধীদের জঙ্গিবাদে জড়ানোর আরো ঘটনা শোনা যাচ্ছে। তাহলে কারাগার উগ্রবাদী দীক্ষার নিরাপদ জায়গা হয়ে উঠেছে কি না।

জবাবে র‌্যাবের পরিচালক বলেন, “বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থা, কারা কর্তৃপক্ষ সবাইকে বলা হয়েছে। তারা কাজ করছে। জানা মতে তারা বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।”

নতুন জঙ্গি দলে রণবীর ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভূমিকা পালন করছিলেন জানিয়ে র‌্যাবের পরিচালক বলেন, “সিলেট অঞ্চলে সংগঠনের দাওয়াতি ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমসহ সামরিক শাখার সদস্য নির্বাচন করতেন তিনি। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি সংগঠনের সামরিক শাখার বিভিন্ন নীতি নির্ধারণী বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিলেন।

“সংগঠনের আমীরের নির্দেশনায় কুমিল্লার পদুয়ার বাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি শূরা কমিটির সভার আয়োজন করেন তিনি। এসব সভায় সংগঠনের সামরিক শাখার কার্যক্রমসহ বিভিন্ন নীতি নির্ধারণী বিষয়ে সিদ্বান্ত গৃহীত হয়।”

২০২১ সালে পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী দল কেএনএফ বা বমপার্টির সঙ্গে জামাতুল আনসারের যে ‘প্রশিক্ষণ চুক্তি’ হয়, সেখানেও সংগঠনের আমীর ও অন্যান্য শূরা সদস্যদের সঙ্গে রণবীর উপস্থিত ছিলেন বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, “অর্থের বিনিময়ে তাদের প্রশিক্ষণ, থাকা-খাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে তিন বছর মেয়াদী লিখিতভাবে চুক্তি হয়। তাদের সামরিক প্রশিক্ষণের রূপরেখা নির্ধারণ করেন রণবীর। এক বছর পূর্বে তিনি সামরিক শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি সামরিক শাখার দায়িত্ব নেওয়ার পর পার্বত্য এলাকায় প্রশিক্ষণের দায়িত্ব একজনকে দেন, সমতলের দায়িত্ব দেন আরেকজনকে।

“বিভিন্ন সময় তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে গেছেন প্রশিক্ষণের জন্য। পাশাপাশি তিনি আত্মগোপনে থাকার সময় ‍সিলেট-কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সামরিক শাখার সদস্য বাছাই ও নিয়োগ করেছেন।”

র‌্যাবের পরিচালক বলেন, ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে সিলেট থেকে চার তরুণের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় রণবীর যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শেষে নিখোঁজ চার তরুণকেই সামরিক শাখায় যুক্ত করেন তিনি।

“তার নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণের জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেনা হত। পাহাড়ে র‌্যাবের অভিযান শুরু হলে রণবীর সিলেট, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আত্মগোপন করে ছিলেন। কিছুদিন আগে আত্মগোপনের জন্য কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় তিনি অবস্থান নিয়েছিলেন।”

‘মাদ্রাসা শিক্ষক থেকে বোমার কারিগর’

র‌্যাবের পরিচালক বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া আবুল বাশার মৃধার গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈরে। মধ্য চল্লিশের বাশার চট্টগ্রামের হাটহাজারীর একটি মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা করে শিক্ষকতায় যুক্ত ছিলেন।

“তিনি দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হুজির সঙ্গে ছিলেন। হুজির সদস্য থাকা অবস্থায় ঝালকাঠির নলছিটি এলাকার নাশকতার মামলায় ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন বছর কারাভোগ করেন বাশার।”

র‌্যাব বলছে, ২০১৬-১৭ সালের দিকে জামাতুল আনসারের আমীর মাহমুদের মাধ্যমে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেন বাশার। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য ঘর ছাড়েন।

“তিনি পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছ বিভিন্ন ধরনের বোমা তৈরির বিষয়ে বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণ নেন। তিনি আইইডিসহ বিভিন্ন ধরনের বোমা বানাতে দক্ষ। পরে তিনি জামাতুল আনসারের নতুন রিক্রুটদের বোমা তৈরির বিষয়ে প্রশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন,”বলেন র‌্যাবের পরিচালক।

গত অক্টোবরে র‌্যাব যে ৫৫ জনের তালিকা প্রকাশ করে, তাতেও বাশারের নাম ছিল। পাহাড়ে র‌্যাবের অভিযান শুরু হলে বাশার ৫৫ জনের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সিলেটে রণবীরের কাছে যায়। রণবীরের সঙ্গেই কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় আত্মগোপন করেন পরে। সেখান থেকে র‌্যাব তাদের গ্রেপ্তার করে।