লালবাগ কেল্লা মুঘল আমলে ১৬ শতকে নির্মিত একটি অসম্পূর্ণ দুর্গ।
Published : 11 Oct 2022, 11:44 PM
মূল অবকাঠামো ও অবয়ব বজায় রেখে সতর্কতার সঙ্গে ঐতিহাসিক লালবাগ কেল্লার হাম্মামখানার সংস্কার ও সংরক্ষণ কাজ চলছে।
চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই সংস্কার কাজ শেষ হবে। আগামী বছরের মার্চে দর্শনার্থীদের জন্য এটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ‘ইউএস অ্যাম্বাসাডরস ফান্ড ফর কালচারাল প্রিজারভেশন’র অর্থায়নে বাংলাদেশের এই প্রত্নস্থানে সংস্কার চলছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী, বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী ও বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে আওতায় লালবাগ কেল্লার হাম্মামখানার সংস্কার-সংরক্ষণের এই পরীক্ষামূলক প্রকল্পটি হাতে নেয় প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর।
মঙ্গলবার সংস্কার-সংরক্ষণ কার্যক্রমের অগ্রগতি বিষয়ক পর্যালোচনা ও অংশীজনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
কেল্লার সেমিনার হলে আয়োজিত সভায় প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ইতোমধ্যে হাম্মামখানার ত্রিমাত্রিক স্থাপত্যের ডকুমেন্টেশন সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া গাঠনিক পর্যবেক্ষণ, দেয়ালের লোড বিয়ারিং ক্ষমতা, ইটের কম্প্রেসিভ শক্তি, মেঝে ফাটল দুর্বলতা, ছাদে জল অনুপ্রবেশের প্রতিকার করা হয়েছে।
প্রকল্পটি অধিদপ্তরের হেরিটেজ সেলের তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
অধিদপ্তর জানায়, এর আগে হাম্মামখানার হেরিটেজ ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট করে খসড়া সংরক্ষণ পরিকল্পনা করা হয়। অধ্যাপক ড. আবু সাঈদ এম আহমেদ, অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ ও বিদেশি বিশেষজ্ঞ ড. টি এম জে নিলান কোরে- এই তিনজনকে পরামর্শক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ত্রিমাত্রিক স্থাপত্যক ডকুমেন্টেশনের জন্য বিশেষায়িত ফার্ম হিসেবে ‘গ্লোবাল সার্ভে কনসালট্যান্টসকে নিয়োগ করা হয়।
নির্ধারিত সময়সীমা ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থাকলেও করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে কাজ শুরু হতে দেরি হয়। ফলে নির্ধারিত বাজেটের মধ্যেই ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়সীমা বাড়ানো হয়। ২০২১ সালের ২৪ মার্চ এই প্রকল্পের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছিল।
সভায় ‘হাম্মামখানার সংস্কার-সংরক্ষণ’ বিষয়ক পর্যালোচনা তুলে ধরেন স্থপতি অধ্যাপক আবু সাঈদ আহমেদ। এতে মতামত দেন প্রকল্পের পরামর্শক অধ্যাপক শাহনাওয়াজ ও নিলান কোরে।
স্থপতি আবু সাঈদ বলেন, “ঐতিহাসিক স্থাপনা সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রথম কাজ হয় ভবনের কী কী পরিবর্তন হয়েছে তা খুঁজে বের করা। আমরা দেখলাম, ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় থেকে লালবাগ কেল্লা হয়ে ওঠে ব্রিটিশ সেনানিবাস।
“তখন ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতির ছাপ পড়ে। এছাড়া ষাটের দশকে পাকিস্তান শাসনামলেও এখানে পরিবর্তন হয়। স্বাধীন বাংলাদেশেও কিছু কাজ হয়। সিমেন্ট-সুরকির প্লাস্টার ব্যবহার করা হয়। এতে স্থায়িত্ব হারায় চুন সুরকির কাঠামো। ইট-সুরকির গায়ে লেপ্টে দেওয়া সিমেন্টের প্লাস্টার সরিয়ে ফেলা ছিল আমাদের প্রথম কাজ। প্লাস্টার সরানোর পর আমরা এখানে দুটি পুরনো সিঁড়ির সন্ধান পাই। এত দিন যা আড়ালে ছিল। পুরনো সিঁড়ি বন্ধ করে নতুন সিঁড়ি বানানো হয়েছিল। আমরা নতুন সিঁড়িটি ভেঙে আবার পুরনো সিঁড়ির আদি রূপে ফিরিয়ে নিয়েছি।”
হাম্মামখানায় জানালাও তৈরি করা হয়েছিল উল্লেখ করে আবু সাঈদ বলেন, “হাম্মামখানা মানে তো গোসলখানা, সেখানে তো জানালা থাকার কথা নয়। পরে প্লাস্টার সরিয়ে দেখা যায় হাম্মামখানার উপরে গর্ত রয়েছে, যেটি বন্ধ করে ফেলা হয়েছিল। এই গর্ত দিয়ে মূলত উপর থেকে আলো-বাতাস আসত। আমরা জানালা বন্ধ করে দিয়ে উপরের গর্তটি খুলে দিয়েছি। এতে করে হাম্মামখানা আদিরূপে ফিরেছে।”
হাম্মামখানার একটা কক্ষের মেঝেতে কংক্রিটের ঢালাই করা হয়, সেই মেঝে ভাঙার পর সেখানে একটি চুল্লি পাওয়া যায় জানিয়ে এই স্থপতি বলেন, “চুল্লিতে মূলত পানি গরম করা হতো। হাম্মামখানায় গরম এবং ঠাণ্ডা পানির ব্যবহার ছিল। এই কক্ষটাও আদিরূপে রাখা হচ্ছে।”
এদিকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর জানায়, সংরক্ষণ পরিকল্পনা অনুযায়ী বেশ কিছু কাজ করা হয়েছে। যার মধ্যে স্প্রিংগার লেভেল পর্যন্ত ডিপ্লাস্টার, পরবর্তী সংযোজনের সমস্ত উপাদান সরানো, ইটের গাঁথুনিকে শক্তিশালী করা, দেয়ালের চারপাশের মোজাইক অপসারণ করা হয়।
বর্তমানে ভবনের বৈদ্যুতিক কাজ, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন চলমান। এছাড়া গ্লাস ফিটিংসের মাধ্যমে দর্শকের জন্য আকর্ষণযোগ্যভাবে উপস্থাপনের কাজও করা হচ্ছে। ভবনের বাইরের দিকেও প্লাস্টারের কাজ চলছে।
লালবাগ কেল্লা মুঘল আমলে ১৬ শতকে নির্মিত একটি অসম্পূর্ণ দুর্গ।
বাংলাপিডিয়া লিখেছে, যুবরাজ মুহম্মদ আজম বাংলার সুবেদার থাকাকালীন ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে এর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। কিন্তু নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার আগেই সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে দিল্লিতে ডেকে পাঠান। তার উত্তরসূরি শায়েস্তা খান ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করলেও দুর্গের কাজ সমাপ্ত করেননি। ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খানের মেয়ে বিবি পরী এখানে মারা গেলে দুর্গটিকে তিনি অপয়া হিসেবে বিবেচনা করে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন।
লালবাগ কেল্লায় একটি মসজিদ, পরিবিবির মাজার ও হাম্মামখানা রয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক ইতোপূর্বে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে ছাদ বাগান এবং পানি নিষ্কাশনের প্রত্নসাক্ষ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
১৯৯৯ সাল থেকে লালবাগ কেল্লা বাংলাদেশের অনন্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্ভাব্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। দোতলা বিশিষ্ট হাম্মামখানা ভবনটি মুঘল সুবেদারদের দরবার হল হিসেবে ব্যবহৃত হত।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর আরও জানায়, হাম্মামখানা সংস্কার ও সংরক্ষণ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো গবেষণা ও ডকুমেন্টেশনের মাধ্যমে এই ভবনের পরিপূর্ণ সংস্কার পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং ইতোপূর্বে শনাক্ত হওয়া ক্ষতি প্রশমনের নিমিত্তে কিছু সংস্কার-সংরক্ষণ কাজ সম্পাদন করা।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রতন চন্দ্র পণ্ডিতের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, বিশেষ অতিথি হিসেবে সংস্কৃতি সচিব মো. আবুল মনসুর উপস্থিত ছিলেন।
এতে প্রতিমন্ত্রী খালিদ বলেন, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সংবিধানে সাংস্কৃতিক সম্পদ ও বৈচিত্র্য রক্ষায় ম্যান্ডেট অন্তর্ভুক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দেশের সাংস্কৃতিক সুরক্ষায় যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করেছে এবং বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।”
রতন চন্দ্র পণ্ডিত বলেন, “লালবাগ দুর্গের হাম্মামখানাকে যথাসম্ভব আদিরূপে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। হাম্মামখানা ছাড়াও লালবাগ দুর্গের অন্যান্য স্থাপনাকেও পর্যায়ক্রমে সংস্কার-সংরক্ষণ কার্যক্রমের আওতায় আনা হবে।”