ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে শিশু অধিকার সংরক্ষণের আহ্বান ইউনিসেফের

সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণকারীরা বলেন, গত এক দশকে এই বিষয়ে কিছু অগ্রগতি হলেও, অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে, যেখানে তৈরি হয়েছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Feb 2023, 01:46 PM
Updated : 1 Feb 2023, 01:46 PM

সব ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে শিশু অধিকার সংরক্ষণের জন্য সরকার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কর্মী- সব পক্ষকে এক হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে ইউনিসেফ। 

‘বাংলাদেশে শিশু অধিকার ও ব্যবসায়িক নীতি’ সংক্রান্ত কাঠামো তৈরির ১০ বছর পূর্তিতে আয়োজিত দিনব্যাপী এক জাতীয় সিমম্পোজিয়ামে এই আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক এই সংস্থা। 

বুধবার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট হলে এই সিম্পোজিয়াম আয়োজিত হয়। উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম। উপাচার্য বলেন, “শিশুরা আমাদের সমাজের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সদস্য এবং তাদের রক্ষায় আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।” 

সিম্পোজিয়ামে কর্মক্ষেত্রে নারী কর্মজীবীদের সন্তানদের বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা, ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপন, শিশুশ্রম শূণ্যে আনা, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া, ব্যবসা ও কারখানার বৃদ্ধিতে শিশুদের ওপর পরিবেশ দূষণের প্রভাব কমিয়ে আনার মতো বিষয়গুলোর ওপর জোর দেওয়া হয়। 

এক দশক আগে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ব্যবহারের লক্ষ্যে ‘শিশু অধিকার ও ব্যবসার নীতি’ সংক্রান্ত এই সহায়িকা তৈরি করেছিল ইউনিসেফ, ইউএন গ্লোবাল কমপ্যাক্ট ও সেভ দ্য চিলড্রেন। 

এর উদ্দেশ্য হল কর্মক্ষেত্র, বাজার এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সবাই যাতে শিশুদের অধিকার সংরক্ষণের কথা বিবেচনায় রেখে নিজেদের কর্মপরিবেশ তৈরি করে। শিশুদের ওপর ব্যবসার কারণে সৃষ্ট নেতিবাচক প্রভাব কমানো এবং ব্যবসা পরিচালনার কেন্দ্রে শিশু অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করাই বৈশ্বিক এই কাঠামোর লক্ষ্য। 

উদ্বোধনী পর্বে  শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের ধারণকৃত ভাষণ প্রচার করা হয়। 

প্রতিমন্ত্রী বলেন, “১৪ বছরের নিচে শিশুকে শ্রমে নিয়োজিত করা যাবে না। আমরা ৪৩টি খাতকে শিশুশ্রমের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছি। সব খাত থেকে শিশুখাত নিরসনে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। শিশুশ্রম মুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে আমাদের মন্ত্রণালয়ের কাজ চলমান।”

আলোচনায় ইউনিসেফের বাংলাদেশ প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, “সরকার, বিনিয়োগকারী ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান- সব পক্ষেরই এই বিষয়ে ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়ন সম্ভব। শিশুদের প্রতি প্রতিশ্রুতি পূরণে অভিভাবক, চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানসহ সবাইকেই এমনভাবে কাজ করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বজায় থাকে এবং ব্যবসার সমৃদ্ধিতে পরবর্তী প্রজন্মের প্রয়োজনীয় দক্ষতাও অর্জিত হয়।” 

বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধিদলের রাষ্ট্রদূত ও প্রধান এইচ ই চার্লস হোয়াইটলি বলেন, “দারিদ্র্য, শোষণ ও বৈষম্য মোকাবেলায় শিশুবান্ধব ব্যবসায়িক পরিবেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা যেকোনো উদ্যোগ পরিচালনার ক্ষেত্রে শিশু অধিকার নিশ্চিতের এই কাঠামো মানতে হবে। 

“প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মীদের সন্তান যাতে অভিভাবকের সঙ্গ থেকে বঞ্চিত না থাকে সেদিকে নজর দিতে হবে।” 

বাংলাদেশে সুইডিশ রাষ্ট্রদূত আলেকজান্দ্রা বার্গ ফন লিন্ডে বলেন, “আইনগতভাবে শ্রম দেওয়ার বয়স ১৮ বছর। কিন্তু বাংলাদেশে এর চেয়ে কম বয়সের শিশুরা শ্রম দিচ্ছে। ফলে সেখানে শিশুদের ওপর নির্যাতন এবং অধিকার বঞ্চিত করার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। 

“বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় খাত গার্মেন্টস খাত, যেখানে বেশিরভাগই নারী কর্মী। এসব গার্মেন্টসে নারী কর্মীদের শিশুদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার, বুকের দুধ খাওয়ানোর জায়গা নিশ্চিত করে ব্যবসা ও কর্মসংস্থান করার ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। বন্ধুত্বপূর্ণ কর্মপরিবেশ তৈরি করতে হবে।”

বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাই কমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন বলেন, “যুক্তরাজ্য ইউনিসেফের এই কাঠামোকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। বৈশ্বিক শিশু পাচার এবং পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় শিশুশ্রম দূর করতে যুক্তরাজ্য আধুনিক শ্রম আইন করেছে। 

“বাংলাদেশেও আমরা ব্যবসায়িক খাতে শিশু অধিকার নিয়ে যথাযথ উদ্যোগ দেখতে চাই। শিশুদের অধিকার সংরক্ষণে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্য হাতে হাত রেখে কাজ করবে।” 

শিশু অধিকার সংরক্ষণে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সৃষ্ট নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সব পক্ষকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত ফারুক সোবহান বলেন, “আমাদের কাছে কাঠামো আছে, কিন্তু এর বাস্তবায়ন বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কিছু কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সচেতন হয়েছে, কিন্তু সবাই হয়নি। 

“আমাদের ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও শিশুদের অধিকারের দিকে নজর দিতে হবে। যারা এসব নিয়ে কাজ করে তাদের জন্য প্রয়োজনে অর্থ ছাড় দিতে হবে। স্কুলগুলোতে বিনামূল্যে খাবার দিতে হবে। আমরা শিশুদের শারীরিক নির্যাতন রোধের কথা বলছি কিন্তু করোনা মহামারী দেখিয়েছে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়াটাও কতোটা জরুরি। 

“এমনকী পরিবেশ দূষণের ফলে শিশুদের ওপর যে খারাপ প্রভাব পড়ছে তা রোধে সরকার, সুশীল সমাজ, এনজিওসহ জাতিসংঘের যেসব বিভাগ শিশুদের নিয়ে কাজ করে, তাদের সবাইকেই সচেতন হতে হবে।” 

সিম্পোজিয়ামে বেসরকারি খাত থেকে ইউনিলিভার, গ্রামীণফোন, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, ডিবিএল গ্রুপ এবং বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরাও অংশ নেন।