কালশী মোড় পার হতে যানজটে ২০ মিনিট করে সময় আর নষ্ট হবে না মিরপুরবাসীর। যাওয়া আসার পথে বেঁচে যাওয়া সময়টা তারা কাজে লাগাবেন নিজেদের মত করে।
Published : 19 Feb 2023, 05:35 PM
রাজধানীর কালশী রোডের বাসিন্দা কাজী নাজমুন নাহারের অফিস বনানীতে। বাসে করে ইসিবি চত্বর হয়ে যান অফিসে। যাওয়া-আসার পথে কালশী মোড়ে প্রতিদিনই পড়তে হত যানজটে। তার সেই দুর্ভোগের অবসান হয়েছে।
এই পথের কালশীতে নির্মিত ফ্লাইওভার চালু হয়ে যাওয়ায় নাজমুন নাহার এখন আগের চেয়ে কিছুটা বেশি সময় পাবেন বিশ্রামের জন্য।
রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, প্রতিদিন যাত্রাপথে যাওয়া আসার সময় অন্তত ২০ মিনিট করে সময় বাঁচবে তার।
“কালশী মোড়ে অনেকগুলো রাস্তার মুখ। ইসিবির দিকে যেতে বা আসতে কালশী মোড় পর্যন্ত জ্যামে পড়তে হত। একদিন আমাদের গাড়ি ঠাঁয় ৪০ মিনিট দাঁড়িয়েছিল এখানে। ফ্লাইওভার হওয়ায় ওপর-নিচ দুভাবেই গাড়ি যাবে। নিচের সড়কটিও প্রশস্ত হয়েছে। ফলে মোড়ে যানবাহনের চাপটা কমে যাবে”, বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকালে ২ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভারটি উদ্বোধন করে আসার পরপরই শুরু হয় যান চলাচল। এর মধ্যে দিয়ে শেষ হয় মিরপুরবাসীর পাঁচ বছরের অপেক্ষার।
১ হাজার ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত স্থাপনাটি রাজধানীর সপ্তম ফ্লাইওভার। এর আগে মহাখালী, খিলগাঁও, গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী, কুড়িল, মগবাজার-মৌচাক এবং সেনানিবাস এবং বনানী এলাকায় জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার চালু হয়।
শীত শেষে প্রকৃতিতে বসন্তের হাওয়ার মধ্যে এই স্থাপনাটিকে মিরপুরবাসীর জন্য ‘বসন্তের উপহার’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম।
এই উপহার পাওয়ায় এখন মিরপুর থেকে উত্তরা বা বনানীর পথে যাত্রার সময় ও দুর্ভোগ দুটোই কমবে, কমবে গাড়ির জ্বালানি খরচ।
মেট্রোরেল ও ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ একসঙ্গে চলার কারণে গত কয়েক বছর ধরে মিরপুরের যানজট হয়ে গিয়েছিল ‘রসিকতার বিষয়’। কদিন আগে চালু হয়ে গেছে মেট্রোরেলের অর্ধেক পথ। সেই ‘সুখের আবেশের’ মধ্যেই এবার দুর্ভোগ আরও কমাল ফ্লাইওভার।
দুর্ভোগের জন্য যে মিরপুরে কমে গিয়েছিল বাসা ভাড়া, সেখানে এখন ভাড়াটেরা নাখোশ, কারণ বাড়িওয়ালারা বেশি টাকা চাইছেন।
পল্লবীর বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব আলমাস হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যানজটের কারণে একটা সময় মিরপুরে বাইরের লোকজন আসতে চাইত না। মেট্রোরেল এবং এই ফ্লাইওভার চালুর পর এখন অনেক লোক মিরপুরে আসতে চাইছেন বসবাসের জন্য।”
পল্লবী এলাকার বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, “মিরপুর থেকে উত্তরা বা বিমানবন্দর যেতে কালশী সড়ক ব্যবহার করতাম। বেড়িবাঁধ দিয়েও ঘুরে যাওয়া যায়, কিন্তু সময় লাগে বেশি। কিন্তু কালশী মোড়ে প্রায় সব সময়ই যানজট লেগে থাকত। ফ্লাইওভারের কারণে এখানে অন্তত জ্যাম লাগবে না।”
মুসলিম বাজার এলাকার বাসিন্দা ইমাদাদুল হক বলেন, “এই কালশী মোড় দিয়ে অনেক বাস চলে। যানজটের কারণে আটকে থাকতে হত। ফ্লাইওভার হওয়ায় সবারই উপকার হয়েছে। এছাড়া নিচের সড়কটিও অনেক প্রশস্ত করা হয়েছে। ফলে নিচের সড়কেও যানজট কমবে।”
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কালশী ফ্লাইওভারের কারণে ঢাকা শহরে পূর্ব-পশ্চিম সংযোগ আরও বাড়ল।
“এটা মিরপুরের মানুষের জন্য বসন্তের উপহার। এই ফ্লাইওভারের কারণে এখানে যানজট কমবে। মিরপুরের লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে বনানী, গুলশান, বিমানবন্দর, উত্তরাসহ রাজধানীর অন্য অংশের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াবে। ঢাকায় পুর্ব-পশ্চিম কানেক্টিভিটি রক্ষা করতেও এই ফ্লাইওভার দারুণ ভূমিকা রাখবে।”
ফ্লাইওভারে রিকশা, খাবারের দোকান
উদ্বোধনের পরই কালশী এবং আশপাশের এলাকার লোকজন জড়ো হন ফ্লাইওভারে। কেউ হেঁটে, কেউ রিকশায় চড়ে, অটোরিকশায়, মোটরসাইকেল এবং অন্যান্য যানবাহন নিয়ে উঠে পড়েন তারা। আইসক্রিম, ফুচকা, ঝালমুড়ি বিক্রেতারাও ভ্যান নিয়ে উঠে যান। ভ্রাম্যমাণ বাজারে পরিণত হয় উড়ালসড়কটি।
প্রথম কয়েক ঘণ্টা মানুষের এই উচ্ছ্বাসে বাধা দেয়নি পুলিশ। বেলা আড়াইটার দিকেও রিকশা, ভ্যান নিয়ে চলতে দেখা যায় মানুষকে। অনেক যানবাহন চলে আসে উল্টোপথেও।
কালশী রোডের র্যাম্প ধরে উল্টোপথে আসা একটি অটোরিকশার চালক জালাল উদ্দিনের উল্টোদিকে আসার কারণে জানতে চাইলে বলেন, “আইজকা প্রথম দিন বইলা আসলাম। কাল থাইকা তো আর আসব না। পুলিশও আসতে দিব না।”
ঢাকার পূর্ব-পশ্চিমে যোগাযোগে জোর প্রধানমন্ত্রীর
ফ্লাইওভারটি উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কালশী বালুর মাঠে আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য দেন।
সেখানে তিনি ঢাকার পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে ভালো সংযোগ না থাকা এ শহরের ‘প্রধান সমস্যা’ হিসেবে তুলে ধরেন। বলেন, তার সরকার এই সমস্যার সমাধানে অগ্রাধিকার দিয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, “ইসিবি স্কয়ার থেকে ২ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার কালশী ফ্লাইওভার এবং ৩ দশমিক ৭০ কিলোমিটার প্রশস্ত ও ছয় লেইনের রাস্তা মিরপুর, ডিওএইচএস, পল্লবী, কালশী, মহাখালী, মানিকদি, মাটিকাটা, ভাষানটেক, বনানী, উত্তরা এবং বিমানবন্দরে যোগাযোগ সহজ করবে। মেট্রোরেলের পর কালশী ফ্লাইওভার ও ছয় লেইনের সড়ক চালু হলে ঢাকার যানজট অনেকটাই কমে যাবে।”
জনসভায় প্রধানমন্ত্রী কালশী বালুর মাঠকে একটি বিনোদন পার্ক হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দেন, যেখানে শিশু ও তরুণদের জন্য খেলার মাঠ এবং বয়স্কদের চলাচলের জন্য হাঁটার পথ থাকবে।
ঢাকা উত্তর সিটির উন্নয়নে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ২০১১ সালে ঢাকা শহরকে দুই ভাগ করার পর গত ১২ বছরে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ২৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
ঢাকার দক্ষিণ অংশকেও সরকার ‘বঞ্চিত করছে না’ বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। বলেন, সিটি করপোরেশনে গত কয়েক বছরে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি মূল্যের ১৬টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে।
এসব প্রকল্পের আওতায় রাজধানীর সৌন্দর্য বর্ধন, পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, ফুটপাথ নির্মাণ ও উন্নয়ন, সড়ক, সেতু ও ফ্লাইওভারের পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ রাজধানীর যোগাযোগ ও অবকাঠামোর উন্নয়ন করা হয়েছে।
চওড়া হলো নিচের সড়ক, ফুটওভার ব্রিজে চলন্ত সিঁড়ি
প্রকল্পের আওতায় ইসিবি চত্বর থেকে কালশী পর্যন্ত ৩ দশমিক ৭০ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত হয়েছে। চার লেইন থেকে বাড়িয়ে ছয় লেইন করায় নিচ দিয়ে চলাচলকারী গাড়িগুলোও পাবে বাড়তি সুবিধা।
প্রকল্পের আওতায় দুটি ফুটব্রিজ নির্মাণ, একটি পিসি গার্ডার ব্রিজ সম্প্রসারণ, একটি পাবলিক টয়লেট নির্মাণ, দুটি পুলিশ বক্স, ৭ দশমিক ৪০ কিলোমিটার আরসিসি ড্রেন ও সসার ড্রেন নির্মাণ, ১ দশমিক ৭৬ কিলোমিটার পাইপ ড্রেন নির্মাণ, সাইকেলের জন্য আলাদা লেইন এবং ছয়টি বাস বে এবং যাত্রী ছাউনি করা হয়েছে।
ফ্লাইওভার এলাকায় দুটি ফুটব্রিজ করা হয়েছে, তাতে থাকবে চলন্ত সিঁড়ি। সাইকেলের জন্য আলাদা লেইন রয়েছে।
নিচের সড়ক ছয় লেইনের হলেও ফ্লাইওভারটি চার লেইনের, র্যাম্প পাঁচটি। ইসিবি চত্বর থেকে কালশী মোড় পর্যন্ত ফ্লাইওভারটি চার লেইনের। সেখান থেকে কালশী রোড এবং ডিওএইচএস মুখী মূল ফ্লাইওভারটি দুই লেইনের।
কালশী মোড় থেকে কালশী সড়কের দিকে নেমেছে দুই লেনের একটি র্যাম্প। ডিওএইচএস প্রান্তের র্যাম্প দিয়ে যানবাহন ওঠানামা করতে পারবে। আর একটি র্যাম্প নেমেছে সাগুফতা হাউজিংয়ের কাছে, সাগুফতা থেকে আরেকটি র্যাম্প দিয়ে ওঠা যাবে ফ্লাইওভারে।
মিরপুর ডিওএইচএস প্রান্ত এবং ইসিবি চত্বরের দিকের প্রান্ত থেকে ফ্লাইওভারে ওঠা যাবে। কালশী রোড প্রান্ত দিয়ে নামার সুযোগ রয়েছে, ওঠা যাবে না।
ইসিবি চত্বর থেকে মিরপুর পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন এবং কালশী মোড়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্প একনেকের অনুমোদন পায় ২০১৮ সালের ৯ জানুয়ারি।