নতুন মোটিফের সঙ্গে এবার প্রথমবার কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার পঙতি নিয়ে করা হয়েছে প্রতিপাদ্য।
Published : 13 Apr 2024, 11:31 PM
নতুন প্রতিপাদ্য আর নতুন মোটিফে অন্ধকার তথা তিমিরকে পেছনে ফেলে নতুন বছর বরণের আয়োজনে শেষ মুহূর্তের রঙ লাগছে শিল্পকর্মে; বর্ণিল আরেকটি মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি চলছে।
ঈদ আনন্দের রেশ থাকার মধ্যেই বাংলা আরেকটি নববর্ষের দ্বারপ্রান্তে শুধু রাজধানী ঢাকায় নয়, দেশজুড়ে চলছে বৈশাখী নানা আয়োজনের পালা। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর চিরায়ত উৎসবে বর্ষবরণ রঙিন হতে শুরু করেছে ১৪৩১ সালের নতুন ভোরের আলো ফোটার আগেই।
বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য বজায় রেখে নানান নাগরিক ও সামাজিক উদ্যোগগুলোর মতো ঘরে ঘরেও চলছে নিজেদের নিজস্ব সব আয়োজনের প্রস্তুতি। বাহারি পোশাক আর খাবারে রঙিন হয়ে উঠবে পহেলা বৈশাখ। পেছনের দুঃখ, জরা আর গ্লানিকে হটিয়ে সুন্দর ও শুভ সময়কে স্বাগত জানানোর প্রতীক্ষায় সবাই।
দেশজুড়ে হাজারো সব আয়োজনের মধ্যে ঢাকার মঙ্গল শোভাযাত্রার স্থান প্রতিবারই থাকে বিশেষ কাতারে। এবারও উৎসবকে রাঙিয়ে দিতে সেই প্রস্তুতি চলছে জোরেশোরে। বরাবরের মতো সকাল ৯টায় বর্ণিল এ শোভাযাত্রা শুরুর কথা থাকলেও এবার তা ১৫ মিনিট পেছানো হয়েছে।
শনিবার দিনভর শেষ সময়ের প্রস্তুতিতে আড্ডা-গানের ফাঁকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তৈরি করছেন শোভাযাত্রার বিভিন্ন মোটিফ ও শিল্পকর্ম; দিচ্ছেন তুলির শেষ আঁচড়, কাজ চলবে রাতেও। আয়োজকরা বলছেন, এবার পাঁচটি বড় মোটিফের পাশাপাশি থাকবে অসংখ্য ছোট ছোট শিল্পকর্ম।
চারুকলার আনাচে কানাচে চলছে সেসব মোটিফ তৈরির কর্মযজ্ঞ। পাখি, হাতি ও ভোঁদরের পাশাপাশি এবার থাকছে ভিন্ন আরেকটি মোটিফ। চাকার মধ্যে ফুল দিয়ে একটি শিল্পকর্ম তৈরি করা হচ্ছে। রিকশার চিত্রকর্মকে প্রাধান্য দিয়ে বানানো হচ্ছে যেটি। রিকশার চাকা এবং রিকশার সামনে যে ফুল থাকে, সেটি বানানো হয়েছে মোটিফ আকারে। এছাড়া একটি শিশুর হাতে পাখা, এরকম একটি বড় মোটিফ থাকছে এবার।
নতুন মোটিফের সঙ্গে এবার প্রথমবারের মতো কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার পঙতি নিয়ে করা হয়েছে প্রতিপাদ্য। ‘তিমির হননের গান’ কবিতার পঙতি থেকে 'আমরা তো তিমিরবিনাশী' প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
সেই আলোকে বর্ণিল আয়োজনে ১৪৩১ বঙ্গাব্দকে বরণ করতে প্রতিবারের মতো এবারও নানা অনুষঙ্গ তৈরি করেছেন শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্টরা।
চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "এবার ঈদের ছুটিতে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের অনেকে বাড়ি চলে যাওয়ায় ভেবেছিলাম চারটা মোটিফই থাকুক। কিন্তু শিক্ষার্থীদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় আমরা পাঁচটা বড় মোটিফ গড়েছি।
”এর সঙ্গে অনেক ছোট ছোট শিল্পকর্ম থাকবে। সব মিলিয়ে আমরা প্রস্তুত, এই আনন্দযজ্ঞে সবাইকে আসার আমন্ত্রণ।”
প্রতি বছরই লোকজ মাটির পুতুল থেকে এসব মোটিফ তৈরি করা হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, "পাঁচটি মোটিফের মধ্যে আছে পাখি, হাতি, ভোঁদর এবং চাকার মধ্যে ফুল দিয়ে ভিন্ন রকম একটি শিল্পকর্ম। এটি মূলত রিকশা আর্টকে তুলে ধরা হয়েছে। রিকশার চাকা এবং রিকশার সামনে যে ফুল থাকে, সেটি বানানো হয়েছে। এছাড়া একটি শিশুর হাতে পাখা, এরকম একটি বড় মোটিফ রয়েছে।"
শনিবার চারুকলা অনুষদ ঘুরে দেখা যায়, মঙ্গল শোভাযাত্রার শিল্পকর্ম তৈরিতে ব্যস্ত সবাই। একে একে প্রস্তুত হচ্ছে শোভাযাত্রার মুখোশগুলো।
বিশাল এ আয়োজনের অর্থ সংগ্রহে ছবি, সরা আর মুখোশ বিক্রিও চলছে সমানতালে । অনুষ্ঠানের জন্য কারও আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা নেওয়া হয় না বলে শিল্পকর্ম বিক্রি করেই শোভাযাত্রার খরচ বহন করা হয়।
শোভাযাত্রা পেছাল ১৫ মিনিট
রমনার বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষ করে চারুকলা অনুষদ থেকে শুরু হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রায় যেন সবাই যোগ দিতে পারেন, সেজন্য পূর্ব নির্ধারিত সময় থেকে ১৫ মিনিট পেছানো হয়েছে সময়; শুরু হবে সকাল সোয়া ৯টায়।
শোভাযাত্রাটি শাহবাগ মোড় হয়ে শিশুপার্কের সামনে দিয়ে ঘুরে ফের শাহবাগ হয়ে টিএসসিতে গিয়ে শেষ হবে। পরে বকুলতলার মঞ্চে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলবে বাউল গান।
এ বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার পোস্টার বানাতে একটি কর্মশালা হয়েছিল, সেখান থেকে এ বি এম শাফিউল আলমের আঁকা পোস্টারটি নির্বাচন করা হয়।
মঙ্গল শোভাযাত্রা গবেষণা ও প্রসারকেন্দ্র আয়োজিত কর্মশালা এবং মুক্ত আহ্বানে পাওয়া পোস্টার থেকে এটি বাছাই করেন চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসান হোসেন, শিল্পী তরুণ ঘোষ ও শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্য।
কর্মশালার ২৮টি পোস্টার নিয়ে এদিন চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। এটি উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এএসএম মাকসুদ কামাল।
প্রদর্শনী ঘুরে দেখার পর সাংবাদিকদের সামনে এসে তিনি প্রস্তুতিসহ সার্বিক বিষয়ে কথা বলেন। শোভাযাত্রা ১৫ মিনিট পেছানোর তথ্যও দেন তিনি। বলেন, "এবার যে প্রতিপাদ্য রয়েছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই মোটিফ এবং শিল্পকর্মগুলো তৈরি করা হয়েছে।"
গত শতকের আশির দশকে সামরিক শাসনের অর্গল ভাঙার আহ্বানে পহেলা বৈশাখে চারুকলা থেকে যে শোভাযাত্রা বের হয়েছিল; সেটিই পরে মঙ্গল শোভাযাত্রায় রূপ নেয়। ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতিও পায় এ কর্মসূচি।
সাধারণত চারুকলা অনুষদের শেষবর্ষের শিক্ষার্থীরা মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের প্রস্তুতির দায়িত্ব পালন করে থাকে। সে অনুযায়ী এবার অনুষদের ২৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতির মূল দায়িত্বে রয়েছেন। তারা শোভাযাত্রার বিভিন্ন মোটিফ ও শিল্পকর্ম তৈরি করছেন।
‘নিরাপত্তার নামে শোভাযাত্রা যেন ঢেকে না যায়’
বিগত কয়েক বছর ধরেই নানা ধরনের হুমকির কারণে জোরদার করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রার নিরাপত্তা। বিগত বছরে দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুরো শোভাযাত্রাটি ঘিরে রাখে। এতে এটি 'আইনশৃংখলা বাহিনীর প্যারেড' মনে হয় বলে কয়েকদিন আগে মন্তব্য করেছিলেন অভিনেতা রামেন্দু মজুমদার।
এবার নিরাপত্তার নামে পুরো শোভাযাত্রাটি ঢেকে ফেলা হবে কি না? এমন প্রশ্নে উপাচার্য সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলেছি, তারা যেন নিরাপত্তার জন্য যেটুকু দরকার, তা করেন। আবার শোভাযাত্রার গাম্ভীর্য বা নান্দনিকতা যেন ব্যাহত না হয়। প্রশাসন আমাদের জানিয়েছে, তারা সেটি বিবেচনায় রাখবে। আশা করি এবার নিরাপত্তার নামে শোভাযাত্রাটি ঢেকে ফেলা হবে না।"
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কোনো নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হলে কোথায় অভিযোগ জানাবে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, “টিএসসিতে উন্মুক্ত প্যান্ডেলে আমাদের প্রক্টরিয়াল বডি বসবে। সেখানে ব্যানারে ফোন নম্বরও লেখা থাকবে। আমাদের প্রক্টরিয়াল বডিকে জানালে আমরা যথাযথ প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নেব।"
আরও পড়ুন:
মঙ্গল শোভাযাত্রায় এবার জীবনানন্দ যোগ
নববর্ষ উদযাপনে নারীর হেনস্তা হলে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা: র্যাব ডিজি