আগে-পরে কিছু নেই? এমন প্রশ্নে তার জবাব- “যেইটা মনে চায় কইতে পারেন। কইলাম তো বিলাসী। হুদাই বিলাসী, আগে-পিছে কিছু নাই।”
Published : 08 Mar 2024, 10:08 PM
তখন মধ্যরাত। দুদিনের সরকারি ছুটি ঘিরে গাবতলী বাস টার্মিনালে চলছিল মানুষের ছোটাছুটি, হাঁকডাক। ঠিক সেই সময়ে ব্রাশ আর বালতি হাতে বাস ধুচ্ছিলেন এক বয়স্ক নারী।
রাতের বেলায় এমন দৃশ্য সচারচার চোখে পড়ে না, তাই একটু থামতে হল। কাছে গিয়ে নাম জানতে চাইতেই নাম বললেন, ‘বিলাসী’।
আগেপরে কিছু নেই- বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এমন প্রশ্নে বাসের গায়ে ব্রাশ ঘষতে ঘষতেই বললেন, “যেইটা মনে চায় কইতে পারেন। কইলাম তো, বিলাসী। হুদাই বিলাসী, আগেপিছে কিছু নাই।”
ব্রাশ ঘষা শেষ করে এবার বালতি থেকে পানি ছিটানো শুরু করলেন বিলাসী। খানিকটা রূঢ় স্বরেই বললেন, “সরেন সরেন, ভদ্র লোকগো গায়ে পানি পড়লে তো আবার চিল্লায়া মাথায় তুলবেন।”
তার সঙ্গে টুকটাক কথা চালিয়ে যেতে যেতেই ওদিকে বাসচালক আব্দুল সামাদের তাগাদা- “ও খালা চালু কইরা, বিষ্যুৎবারের বাজার। যাত্রী উঠানো হইলেই ছাইড়া দিমু।”
দ্রুত বাসের গায়ে এক বালতি পানি ছিটিয়ে আরেক বালতি আনতে ছুটলেন বিলাসী। পুরো বাস ধুতে লেগে যায় আরো ১৫ মিনিট।
কাজ করতে করতেই বিলাসী জানালেন, ছেলেমেয়ে নেই, সংসার নেই, নিজের যাওয়ার কোনো জায়গাও নেই। একাকী জীবন চালিয়ে নিতে গত এক দশক ধরেই রাতের বেলায় গাবতলী টার্মিনালে বাস ধোয়ার কাজ করছেন।
বিলাসী আগে থাকতেন মানিকগঞ্জ। চরম অভাবে পড়ে ৩০ বছর আগে আসেন ঢাকায়। জীবন চালিয়ে নিতে করেছেন অনেক কিছুই।
তার ভাষ্য, একটা বাস ধুয়ে দিলে ৮০ থেকে ১০০ টাকা মেলে। দিনের বেলায় ড্রাইভাররা বাস ধুতে দেয় না। রাতের বেলায় ঢাকায় আসা বাসগুলো ফের ট্রিপ নিয়ে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে ছোটে। সেই মুহূর্তেই কেবল সেগুলো পরিষ্কারের কাজ পান তিনি।
তবে বাস পরিষ্কার করলেন আর টাকা পেলেন, এমনও নয় বিষয়টি। এর জন্য টার্মিনালের ইজারাদারের লোককেও দিতে হয় টাকা। সব বাদ দিয়ে রোজগার থাকে আড়াইশ থেকে তিনশ টাকা।
গাবতলী টার্মিনালের পাশেই বাগবাড়ি এলাকার একটি ঘরে ভাড়া থাকেন বিলাসী। ভাড়া দিতে হয় এক হাজার টাকা। রান্না করে খান নিজেই।
আত্মীয়-স্বজন কেউ না থাকায় গাবতলীর শ্রমিকরাই এখন তার স্বজন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এই নারী বলেন, “আমার কেউ নাই। কেউ খোঁজ করে না, আমিও কারো ধার ধারি না। এখানকার এই পোলাপাইন খালা ডাকে, হ্যাগো লইয়াই থাকি।”
বিলাসীর সঙ্গে আলাপ করতে করতে জড়ো হন বাসের হেলপার কামরুজ্জামান, ভ্রাম্যমাণ চা বিক্রেতা হেলাল। তারা সবাই বেড়ে উঠেছেন গাবতলীতেই, আর তাদের সবার খালা বিলাসী।
কামরুজ্জামান বলেন, “পিচ্চিকালে যহন লেগুনায় হেলপারি করতাম, তহন থিকা খালারে দেখতাছি। পানি-টানি আইনা দেয়, গাড়ি ধুইয়া দেয়।”
নিঃসঙ্গ বিলাসী জানান, বয়স্ক ভাতা কিংবা বিধবা ভাতা- কিছুই পান না তিনি। সেসব পাওয়ার চেষ্টাও করেননি কখনো।
তার কথায়, “যদ্দিন শইল (শরীর) চলে, তদ্দিন হাত পাইতা খামু না।”
যখন শরীর চলবে না, তখন কী হবে? এমন প্রশ্নের উত্তর হয়ত জানা নেই। প্রশ্ন শুনে কেবল মুখে দিকে হা করে তাকিয়েই থাকলেন বিলাসী।